আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি: জীবনানন্দ দাশ

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ

বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে টের পাওয়া গেল পৃথিবীর সর্বনাশ হয়ে গেছে। ওজোন লেয়ার ফুটো হয়ে যাচ্ছে, কার্বন ছড়িয়ে পড়ায় মেরুঅঞ্চলের বরফ গলে গলে যাচ্ছে; আর সেই অস্বাভাবিক গলনের ফলে স্ফীত হয়ে উঠছে সমুদ্রের উপরিতল । এবং এ সমস্ত অশুভ প্রতিক্রিয়ার ফলে পরবর্তী একশো বছরেই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলটি তলিয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে।

যে দক্ষিণ বাংলায় একদিন বেঁচে ছিলেন কবি জীবনানন্দ দাশ। এবং এই ভাবনার অনুষঙ্গে আমার মনে হল: আমরা জীবনানন্দের মতো হইনি বলে অকালেই পৃথিবীটা ক্রমশ বুড়িয়ে মরে যাচ্ছে। জীবনানন্দ যেমন নিবিড় ভাবে প্রকৃতি-পরিবেশকে ভালোবেসেছিলেন-মানুষের পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই প্রকৃতি- পরিবেশের প্রতি সেরকম নিবিড় ভালোবাসা অনুপস্থিত ছিল। কেন? প্রকৃতি- পরিবেশের প্রতি আমজনতার হৃদয় প্রগাঢ় অনুভূতিশীল হয়ে ওঠেনি বলে? কেন হয়ে ওঠেনি? গাছের পাতা ছিঁড়তেও এশিয়ার প্রাচীন ঋষিগনের হাত কাঁপত-তাহলে গাছের গুঁড়িতে কীভাবে ইস্পাতনির্মিত করাতের দাঁত বসায় মানুষ! মহামহিম ঈশ্বর মানুষের জন্য প্রকৃতিঘনিষ্ট কৃষিজীবন কামনা করেছিলেন। কেননা, জলভেজা মাটিতে প্রাণবীজের অলীক স্ফরণধ্বনিটি মানবের কানে শ্র“ত না হলে নিরাকার ঈশ্বরের উপস্থিতির ইঙ্গিতটি বড় একটা অর্থবহ হয়ে ওঠে না।

এই উদ্দেশ্যেই তিনি ‘ইডেন গার্ডেন’-এর সম্প্রসারিত কংক্রীটিকরণ চাননি। ধরণীর বুকে দেখতে চাননি হংকং-সাংহাই-লন্ডন-নিউইর্য়ক প্রভৃতি তস্কর- কৃত্রিম জনপদ। সভ্যতার দোহাই দিয়ে যে শহরগুলি ইস্পাতের শিকড় ছড়িয়ে দূরবর্তী জলভেজা মাটির রস শোষন করে ফুলে ফেঁপে ওঠে আর এভাবেই গ্রামীনজীবনের প্রাণ নিংড়ে নিঃস্ব করে তোলে । এই সমূহ সর্বনাশ এড়াতে মহামহিম ঈশ্বরের ইচ্ছে ছিল মানুষ চিরকাল হয়ে থাকুক প্রাকৃতিক .. সে পান করুক ঝর্নার জল, আহার করুক বৃক্ষের ফলমূল এবং এভাবে রহস্যময় নীল নভোতলে পৃথিবী নামক গ্রহটির উপরিভাগে নিঃস্ব সম্রাটের মতন বেঁচেবর্তে থাকুক । মার্কিন কবি এমারসন বলেছিলেন:God does not have to reveal the truth but that the truth could be intuitively experienced directly from nature. মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন: “মানুষের দাঁত পরীক্ষা করিয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে: মাংস মানুষের স্বাভাবিক খাদ্য নহে।

” তাহলে? অপার প্রজ্ঞাহেতু জীবনানন্দ ঈশ্বরের অভিপ্রায়টি অনুভব করতে পেরেছিলেন। যে কারণে আমৃত্যু জীবনানন্দ ছিল প্রকৃতির উপাসক এক নির্জন পুরোহিত। প্রকৃতির উপাসকের জীবন হয় ব্যতিক্রমী। জীবনানন্দের জীবনও ছিল ব্যাতিক্রমী। গ্রামীণ জীবনের যে সাধারণ দৃশ্য সচরাচর আমজনতা এড়িয়ে চলে কিংবা গুরুত্ব বোঝে না গ্রামের সেই প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলিই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন কবি ।

দেখেছেন:‘হিজলের জানালায় আলো আর বুলবুলি করিয়াছে খেলা। ’ আর, আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল প’ড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভিতরে; যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফেরে আরো নীল আকাশের তল ...(মৃত্যুর আগে) জীবনভর কবি তৃষ্ণার্তের মতো পান করেছেন পূর্ব বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের রুপরস । ‘জামরুলতলা’ গল্পে কবি লিখেছেন: শালিকগুলো এক-একবার ভিড় পাকিয়ে আকাশ বাতাসের কাছে বিষম নালিশ জানিয়ে যায়; তীরের মত উর্ধ্বশ্বাসে আকাশের পথে ছুটতে- ছুটতে মাছরাঙা খেলা ছেড়ে চিৎকার করে ওঠে, আমার জানালার পাশে একটা মুহুরি গাছ ঘেরা। তেলাকুচার জঙ্গলের ভিতর দুর্গা টুনটুনির জীবন বেশ নরম; কিন্তু লতার গন্ধ-মমতার ছায়ায় কোকিল তৃপ্ত হয়ে পড়ে থাকে না। সে গাছের থেকে গাছে, ডালের থেকে ডালে, ছায়ায়, রোদে, না জানি কী খুঁজে মরে সে! শান্তি নাই! ‘চোখ গেল’-র একঘেয়ে ডাক কিছুক্ষণ পরে আর ভালো লাগে না, একটা ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিতে পারলে বাঁচি।

এক-একটা কোকিলও যখন জানলার কাছাকাছি ছাতিম গাছটার ডালে বসে নিঃসঙ্কোচে আত্মানুরঞ্জনে নির্বিবাদে ডাকতে থাকে তখন তাকে স¤প্রীতিকর অতিথি বলেই যেন মনে হয় বেশি। ” আক্ষেপ এই-মাত্রাতিরিক্ত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে এই জলজ-সবুজ অঞ্চলটিই চলতি শতকেই তলিয়ে যাওয়ার আশংকা তৈরি হয়েছে । বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে গলে যাচ্ছে মেরু অঞ্চলের বিশাল বিশাল বরফের চাঁই আর বরফ গলনের ফলে ফুলে ফেঁপে উঠছে সমুদ্রের উপরিভাগ । এবং এ সমস্ত অশুভ প্রতিক্রিয়ার ফলে কবিতীর্থটি বিলীন হয়ে যাবে বঙ্গোপসাগরের লোনা জলে। বিশ্বপ্রকৃতির মাঝে মানুষের জন্য নিরাকার ঈশ্বরের যে উদ্দেশ্য নিহিত ছিল-সেই উদ্দেশ্যের প্রতি সঙ্গতিপূর্ণ আচরণ মানুষ কখনোই করেনি, এখনও করছে না; সে অরণ্যবন উজার করছে সভ্যতার প্রয়োজন মেটাতে।

আসলে সভ্যতার প্রয়োজন মেটাচ্ছে না, বরং বাড়তি লাভের আশায় অস্বাভাবিক ধনমেদ সঞ্চয় করছে। এখনও করছে। অরণ্যবনের সৌন্দর্য উপভোগ করছে না মানুষ। জীবনানন্দ। ইনি অরণ্যবনের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন।

অল্পতেই সন্তুষ্ট ছিলেন তিনি প্রাচীন এশিয় ঋষিদের মতো । অপার প্রজ্ঞাহেতু জীবনানন্দ ঈশ্বরের অভিপ্রায়টি অনুভব করতে পেরেছিলেন। যে কারণে আমৃত্যু জীবনানন্দ ছিল প্রকৃতির উপাসক এক নির্জন পুরোহিত। প্রকৃতির উপাসকের জীবন হয় ব্যতিক্রমী। জীবনানন্দের জীবনও ছিল ব্যাতিক্রমী।

আমরা তাঁকে প্রাকৃতিক বিজ্ঞানীও বলতে পারি। ‘জীবনানন্দ ও অন্ধকারের চিত্রনাট্য’ গ্রন্থে জহর সেনমজুমদার লিখেছেন,‘ ...বাতাস-পাখি-রোদ-জল-গাছ ইত্যাদি যা কিছু অনিমেষভাবে ব্যক্ত হচ্ছে, তার সম্মিলিত মমার্থের কাছে পৌঁছোতে চেয়েছেন জীবনানন্দ নিজস্ব প্রকৃতিচেতনার মাধ্যমে। ’(পৃষ্ঠা, ২১৪) জীবনানন্দ মানুষের বিনাশপ্রবণ আত্মঘাতি সত্তা লক্ষ করেছেন। একটি গল্পে লিখেছেন গা শিউরে ওঠা কথা...“ ... একদিন রাতের পৃথিবী এদেরই (মানে জোনাকিদের) হবে। এদের আর ওই নিমগাছের লক্ষ্মীপেঁচার আর ওই গোয়ালের নীচের ইঁদুরের।

মানুষের শেষ হাড়গোড় তখন ঝোপে জঙ্গলে বিস্মৃত। এই আমার মনে হয়। সে খুব সুন্দর দিন হবে তাহলে। তখন খুব নীরব ঠান্ডা, ঘন নিবিড় নারকোলের পাতায় নিবিড় জোনাকির মালায় মালায় ভরা সে খুব চমৎকার শান্তির রাত আসবে তখন। একদিন আসবেই।

মানুষ তখন থাকবে না। ” জীবনানন্দ কেন প্রকৃতির মাঝে মানুষকে চান না? কেন তিনি মানুষের বিনাশ কামনা করছেন? এ কোন্ জীবনানন্দ? জীবনানন্দকে ‘আমাদের সময়ের শ্রেষ্ঠ কবি ও দার্শনিক’ বলে অবহিত করা হয়েছে। একুশ শতকে আজ আমরা পরিবেশ বিপর্যয় রোধ করতে জলবায়ূ সম্মেলন করছি। অথচ বিংশ শতকের মাঝামাঝি এই প্রজ্ঞাবান কবি মানুষ বিনাশপ্রবণ রুপটি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন । কবি ঠিকই জানতেন: মানুষের হা হা লোভের বলি হবে পৃথিবীর প্রকৃতি? সজল প্রকৃতির জরায়ূ ছিঁড়ে মানুষ বার করবে প্লাস্টিক-কার্বন? তাই তিনি লিখেছেন: “ ... একদিন রাতের পৃথিবী এদেরই (মানে জোনাকিদের) হবে।

এদের আর ওই নিমগাছের লক্ষ্মীপেঁচার আর ওই গোয়ালের নীচের ইঁদুরের। মানুষের শেষ হাড়গোড় তখন ঝোপে জঙ্গলে বি¯তৃত। এই আমার মনে হয়। সে খুব সুন্দর দিন হবে তাহলে ... আজ কবির জন্মদিন। আজ আমার মনে হচ্ছে ...আমরা জীবনানন্দের মতো হইনি বলে অকালেই পৃথিবীটা ক্রমশ বুড়িয়ে মরে যাচ্ছে।

জীবনানন্দকে নিয়ে চমৎকার একটি লেখার লিঙ্ক

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।