আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিনেমা ও সমাজ:একজন সাধারণের বিশ্লেষণ

লেখক সিনেমা ও সমাজ:একজন সাধারণের বিশ্লেষণ ফারুক আহমেদ ছোটবেলায় সিনেমা হলে গিয়ে অনেক ছবি দেখতাম। চলচ্চিত্র হাসাতে পারে আবার কাঁদাতেও পারে। প্রভাব সৃষ্টি করতে না পারলে মানুষকে হাসানো বা কাঁদানো যায় না। সেই থেকে বুঝেছিলাম, সমাজ জীবনে সিনেমার প্রভাব সামান্য নয়। এখন জীবন অনেক জটিল হয়েছে, চিন্তাও আগের মতো অত সহজ নেই, সেই কারণেই হবে হয়তো সিনেমা আগের মতো অত ভালো লাগে না।

কিন্তু তাই বা বলি কি করে। আগের ভালো লাগা সিনেমা যদি হাতের কাছে পেয়ে দেখতে বসি তবে তাতো ভালোই লাগে। আবার এখনকার নির্মিত কিছু সিনেমা যে ভালো লাগে না তাও নয়। কিছু সিনেমা ভালো লাগে, আবার কিছু সিনেমা কোনোমতেই ভালো লাগে না। সিনেমা বিশ্লেষণ করতে না পারলেও এর কারণটা বুঝতে পারি।

যেসব সিনেমা আমাদের জীবনের কথা বলে, চারপাশের কথা বলে, দূর অতীত থেকে নিয়ে সমাজ জীবনের গতিধারার মধ্য দিয়ে সামনের জীবনের অনিবার্যতার ইঙ্গিত দেয়, সেসব সিনেমাই আসলে ভালো লাগে। এসব সিনেমার মধ্য দিয়ে আমরা আমাদের অতীত, বর্তমান ভবিষ্যতকে দেখতে পাই। নিজেকেই নিজে যেন অন্য অবস্থান থেকে দেখা। আর যেসব সিনেমা অতীত থেকে নিয়ে জীবনের গতিধারায় যা অনিবার্য নয়, অথচ সাময়িক লোভ-লালসা, ভোগ-বিকৃতি আরোপের মাধ্যমে মস্তিষ্ক এবং স্নায়ুর ওপর চাপ সৃষ্টি করে, সেসব সিনেমা দীর্ঘস্থায়ী চিন্তার, আনন্দের, বেদনার অণুরণন ঘটাতে পারে না। এখন সে রকম সিনেমারই জোয়ার।

সমাজ জীবনের অনিবার্যতার স্রোতধারার অবিরাম প্রবাহ, সেই অনিবার্যতার বাধা, সংকট, সমাজ জীবন প্রবাহের চালিকাশক্তি প্রভৃতির চিত্রই মানুষকে হাসায় কাঁদায় আর এগুলোই তো বিনোদন। জীবনের সঙ্গে যা সম্পর্কিত নয় তা মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে চাপই সৃষ্টি করতে পারে, মানুষকে বিনোদনের আনন্দ দিতে পারে না। সিনেমা সম্পর্কে সূক্ষ্মজ্ঞান আমার নেই। সাধারণ যে বিচারবোধ আছে তাই দিয়েই সিনেমা দেখি এবং ভালো-মন্দ সেভাবেই বুঝি। সাধারণ বুঝ থেকে কিছু সিনেমা মনে হয় ইতিহাসনির্ভর।

এসব সিনেমায় অতীতের কিছু মানুষকে দেখানো হয়, যাঁরা বর্তমানেও অন্যভাবে বিরাজমান। সেসব মানুষকে আমরা একভাবে জানি এবং চিনি। তাঁরা আমাদের মনে একভাবে বিরাজ করেন। যেমন, ফকির লালন শাহ। তাঁর অস্তিত্ব আমাদের মাঝে সবসময় বিরাজমান।

কোনো সিনেমায় যখন কেউ অভিপ্রায়মূলকভাবে আমাদের অস্তিত্বের মধ্য থেকে তাঁকে টান দেয়, তখন সে সিনেমার মান অন্য বিচারে যতই ভালো হোক না কেন, আমরা সাধারণভাবে তাকে ভালো বলতে পারি না। সম্প্রতি গৌতম ঘোষের পরিচালনায় লালন ফকিরের ওপর ‘মনের মানুষ’ নামে একটি সিনেমা বানানো হয়েছে। এ সিনেমাটি দেখলে মনে হয় লালন ফকিরের মতো মানুষের ওপর একালের কারো অভিপ্রায় আরোপ করা হয়েছে। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। অতীতের গতিধারা থেকে ভবিষ্যতের দিকে কারো অভিপ্রায় থাকতে পারে তাও হতে হয় গতিধারার মধ্য থেকে অনিবার্যতার দিকে প্রবাহের সূত্র থেকে।

এর বাইরে কোনোকিছু আরোপ করলে তা ভালো বলা যাবে না। বর্তমানে বলিউড সিনেমা নামে প্রচলিত যেসব সিনেমা, তা মানবজীবনে ভোগ আর বিকৃতি আরোপের নিন্দিত অভিপ্রায় ছাড়া আর কিছু নয়। ভোগ, বিকৃতি একধরনের সামাজিক ব্যাধি। সে কারণে তা তাৎক্ষণিকভাবে মানুষকে টানে। স্নায়ুর ওপর, মস্তিষ্কের ওপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে ব্যক্তি মানুষকে এবং সমাজকে বিকৃতির দিকে নিয়ে যায়।

সমাজের স্বাভাবিক এবং অনিবার্য গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত করে। সমাজের অগ্রগতিকে ব্যহত করে, বিলম্বিত করে। বিকৃতির একটি সাধারণ আকর্ষণ থাকে, তা সে যতই তাৎক্ষণিক হোক। আর এই সাধারণ আকর্ষণকেই কাজে লাগায় কিছু লোভি সাহিত্যিক, রাজনীতিক গোছের লোক। তাঁরা নিজেরাও নানা ধরনের বিকৃতির সস্তা জনপ্রিয়তার মধ্যদিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

এসব জনপ্রিয়তার সুযোগ নিয়েই তাঁরা আবার নানা যুক্তির মধ্য দিয়ে সমাজকে ভোগে আর বিকৃতিতে ভাসিয়ে নিজেরা তার মধ্যদিয়ে কিছু হাতিয়ে নেয়ার অভিপ্রায়ে কাজ করছেন। সম্প্রতি তাদেরই অনেকের নিকট থেকে বলিউডের সব ধরনের সিনেমা বাংলাদেশের হলগুলোতে সরাসরি প্রদর্শণের প্রস্তাব এসেছে এবং তদবির চলছে । অর্থাৎ ভারেতর সিনেমা হলগুলোতে বলিউডের ছবি মুক্তি পাওয়া মানেই বাংলাদেশের হলগুলোতেও তা মুক্তি পাবে । এ নিয়ে কেউ এর পক্ষে আবার কেউবা বিপক্ষে মত দিচ্ছেন । দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের শাসকশ্রেণীর রাজনীতির প্রধান কর্মসূচিই হলো সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের কর্মসূচি।

সে কারণে বলিউডের সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমা হলগুলোতে প্রদর্শনের আয়োজনের বিরোধিতা সরকারের দিক থেকে দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে মনে হয় না। যাঁরা এর বিরোধিতা করছেন তাঁরা কতখানি নীতিগতভাবে এবং কতখানি নিজেদের স্বার্থের কারণে করছেন, তার ওপর নির্ভর করবে এ বিরোধিতার ভবিষ্যৎ। বলিউডের ভোগ-বিকৃতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে দেশীয় ঢালিউডের ভোগ-বিকৃতির পক্ষে দাঁড়ালে কখনোই তা নীতিগত বিরোধিতা হবে না। চিৎকার করে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন ঠেকানো মুশকিল। আসলে সেদিক দিয়ে দেখলে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বলে কিছুই পাওয়া যাবে না।

একটি নীতির জায়গায় দাঁড়াতে হবে। তা হলো সমাজ প্রগতির অনিবার্যতার নীতি। কোনটি অনিবার্য এবং কোনটি অনিবার্য নয় তা নিরুপণের নীতি। কোনটি সমাজ প্রগতি এবং কোনটি সমাজ প্রগতি নয়- তা নির্ধারণের নীতি। আর তা নির্ধারণের উপায় সাময়িক স্বার্থের কারণে আপাত ভাগ হয়ে থাকা একই পক্ষের বিভিন্ন অংশের মধ্যে পারস্পরিক আলোচনা আর বসাবসির মধ্য দিয়ে হবে না।

এর জন্য দরকার রাজনীতি সচেতন গণসংগঠন এবং গণপ্রতিরোধ। এর বাইরে আর যাই হোক না কেন, একই পক্ষের আপাত বিরাজমান বিভিন্ন অংশগুলো শেষপর্যন্ত নিন্দিত স্বর্গের দিকেই ধাবিত হবে এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.