আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার স্বপ্ন শুধু আমার

১. সজীব ছোট্টবেলা থেকেই বেশ ভাল ছবি আঁকে। বেশ কয়েকটি ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় সে অংশগ্রহণ করে পুরষ্কার জিতে নিয়েছে। তাঁর মা ও বাবা দু’জনেই ছোটবেলা থেকে এ ব্যাপারে বেশ উৎসাহ দিয়েছেন কিন্তু যতই সজীব বড় হচ্ছে উৎসাহের মাত্রা আস্তে আস্তে করে কমছে। বিশেষত সজীব ইন্টারমিডিয়েট পড়ার পর থেকেই বাবা সত্যি বলতে কি একটু নিরুৎসাহিতই করতেন। আরে বাবা ছবি টবি তো অনেক হলো, এখন কি আর এগুলোর সময় আছে? যখন সজীব ভর্তি যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে বুয়েটে মেকানিক্যাল ইঞ্জীনিয়ারিং এ ভর্তি হলো, তখন বাসার সবাই ব্যাপক খুশী।

কিন্তু সজীবের মুখ মলিন। কিরে সজীব কি হয়েছে? বাবা ডেকে বললেন। সজীবের মুখে কোন রা নেই। কি ব্যাপার? কথা বলছিস না কেন? সজীব দেয়ালের দিকে তাকিয়ে যন্ত্রের মত বলে ফেললো বাবা আমি আর্ট কলেজ এ পড়বো…তোমাদের না জানিয়ে পরীক্ষা দিয়েছিলাম…। বাবার একটু সময় লাগলো ব্যাপারটা হজম করতে।

তার চিন্তাশক্তি কিছুক্ষনের জন্য হারিয়ে গেল। তারপর যখন চিন্তাশক্তি ফিরে পেলেন, তখন তা খাটিয়ে দেখতে পেলেন ৫/৬ বছর পরের সজীবের অবস্থা। তিনি দেখতে পেলেন ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো একটি বেশ নিম্নমানের নির্জীব পুরুষ, যার কোন চালচুলো নেই। অয়েল পেইন্টিং নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে কিন্তু একটিও বিক্রি হচ্ছে না। বড় জোর কোন স্কুল বা কলেজে আর্টের শিক্ষক হিসেবে চাকুরী।

তিনি আর সময় নষ্ট করলেন না। সজীবের মাথা হেঁট করে থাকা চেহারার দিকে তাকিয়ে ৮.৭ রিকটার স্কেলের কম্পন তুলতে পারে এরকম বাঁজখাই গলায় বললেন, এই মুহুর্তে আমার সামনে থেকে বিদায় হও। ইহ জীবনে যেন এই কথা আর না শুনি। ২. সজীবের আরেক সহপাঠী তৃণার অবস্থা সজীবের চেয়ে খুব একট ভাল নয়। তৃণা ছোট বেলা থেকে তুখোড় বিতর্ক করে।

অনেক পদক টদক জিতে একে বার তুলকালাম অবস্থা। তাঁর খুব শখ সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নেয়া। টেলিভিশন গুলোতে যখন সে দেখে দারুণ স্মার্ট মেয়েরা বিভিন্ন বিষয়ে দুর্ধর্ষ সব রিপোর্টিং করছে, সে তখন রোমাঞ্চিত হয়। কিন্তু তৃণার রোমাঞ্চ টিভির পর্দাতেই আটকে থাকে কারণ তাঁর মায়ের বড় শখ তৃণা ডাক্তার হবে। ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা বিভাগ পাওয়ার পর সেটা বাসায় জানাতেই মা পুরো দু’দিন না খেয়ে ছিলেন।

তৃণার আর কিছু করার ছিলো না, প্রবল বিতৃষ্ণা নিয়ে ডাক্তারীতে ভর্তি হয়ে গেল। ৩. আমার কৈশোর বেলার এক বন্ধু। সে ছোট বেলা থেকে বিজ্ঞান চর্চায় বেশ উৎসাহী ছিল। সে যখন ফোর অথবা ফাইভে পড়ে তখন থেকে সে পুকুর থেকে শ্যাওলা তুলে এনে এক্সপেরিমেন্ট করতো বড় ভাইয়ের বায়োলোজি বই পড়ে। কিন্তু ক্যাডেট কলেজ কর্তৃপক্ষ তাঁকে ক্লাস নাইনে সায়েন্স পড়তে দিলো না, কারণ সে সায়েন্স পড়ার অযোগ্য বিবেচিত হয়েছে ক্লাস এইটের অংক পরীক্ষায় খারাপ করার জন্য ।

এই খবরে বেচারা এত মুষড়ে পড়লো যে তাঁর কিছুটা মানসিক বৈকল্যের মত হয়ে গিয়েছিল এবং সেটি এখনো পুরোপুরি কাটেনি। আমার আরেক বন্ধু বুয়েটে বেশ ভাল রেজাল্ট করে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেলো। কিন্তু কিসের কি? তাঁকে বাসা থেকে সমন জারি করা হলে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং না পড়লে কিন্তু বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে। কারণ আজ থেকে ১০/১২ বছর আগে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের বেশ রমরমা অবস্থা ছিল। আমার বন্ধু বেচারার সেই মুহুর্তে বাসা থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার কোন ইচ্ছা ছিল না।

তাই চোখ কান বুজে সিভিলাইজড সন্তানের মত সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ফেললো। ৪. এরকম অনেক ঘটনা আছে। আমি জানি বাবা-মা সন্তানের ভাল চায়। ভাল চাওয়াটা বলতে সবার আগে সন্তানের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার কথা চিন্তা করা হয়। সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই চিন্তা আসে কোন চাকুরীতে বেতন বেশী।

এই জন্য আমরা দেখি আজকে সবচেয়ে বেশী মেধাবীরা ব্যবসায় প্রশাসনের দিকে ছুটে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মত দুরন্ত প্রতিভাধরদের মধ্যে কেউ হয়তো হতে পারত এক বিশাল জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ার অথবা দুনিয়া কাঁপানো পদার্থবিদ। কিন্তু সে হয়তো হবে এক সময় কোন বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানীর কাঁড়ি কাঁড়ি টাকায় কেনা এক কর্মী যার মূল্য লক্ষ্য হবে ধুমপানকে জনপ্রিয় করে তোলা যাতে কোম্পানীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়ে মোটা অংকের বোনাস পাওয়া যায়। ৫. শুধু অর্থ নয়, সামাজিক সন্মানও বেশ বড় একটা বিষয়। আমার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএ তে বিবিএ পড়ছে এটা যেমন একজন বাবা-মা যেমন একটি বেশ আত্মতুষ্টি ভরিয়ে এবং গর্ব মিশিয়ে বলতে পারেন তেমনি কেউ যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে পড়াশোনা করে তার বাবা-মা ততটাই মিন মিন করে বলেন।

সাহিত্য নিয়ে পড়ছে, তার মানেই হলো এতো কোন কাজের না। শিল্প সাহিত্য আছে বলেই যে আমরা এখনও মানুষ, এই বোধটাই অনেকটা হারিয়ে গেছে। শিল্প সাহিত্য মানে হলো মাঝে মধ্যে গান টান গাওয়া, কবিতা শোনা, দু’একটা উপন্যাস , প্যাকেজ নাটক এই আরকি। এ নিয়ে আবার পড়াশোনার কি আছে? যারা আর কিছুই পারে না, আর কোন ভাল বিষয় পায় না তাঁরাই এগুলো নিয়ে পড়ে। অভিভাবকদের এই চিন্তা ভাবনা তাঁরা যখন আরোপিত করেন সন্তানের মধ্যে তখন তা পুরো সমাজের জন্য একটি অশনি সংকেত হয়ে দাঁড়ায়।

আমাদের সাংস্কৃতিক বিকাশের ক্ষেত্রে হিন্দী ভাষার আগ্রাসনের চেয়ে এই ধ্যান ধারণার ক্ষতিকর দিক কোন অংশেই কিন্তু কম নয়। ৬. অনেক সময় পুরো সিদ্ধান্ত সন্তানের উপর ছেড়ে দেয়া বিপদজনক। ১৮/১৯ বয়সে অফিসিয়ালি প্রাপ্ত বয়স্ক হলেও জীবনের সবচেয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য অনেকেই কিন্তু মানসিক ভাবে পরিণত নয়। সে জন্য বাবা-মা এবং অভিভাবকদের উচিৎ তাঁর সংগে আলোচনা করে তাঁর মানসিক গঠনটা বোঝার চেষ্টা করা। আমার কাছে মনে হয় একেকটা মানুষের ব্যক্তিত্ব, বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা একেকটি পেশা বা কাজের জন্য নির্দিষ্ট ।

যেই ব্যক্তি তাঁর জন্য নির্দিষ্ট কাজ বা পেশা বেছে নিতে পারেন তিনিই হন সবচেয়ে বেশী সাফল্য মন্ডিত। আমি কিভাবে বুঝবো কোন কাজটি আমার জন্য নির্দিষ্ট? সহজ উপায় হলো নিজের মস্তিষ্ককে জিজ্ঞেস না করে হৃদয়কে জিজ্ঞেস করা। নির্ঘাত উত্তর আসবে যেটি করতে আমার সবচেয়ে ভাল লাগে। আমরা বলি পরিশ্রম না করলে সফল হওয়া যায় না। খুবই খাঁটি কথা।

কিন্তু আমরা যাদের সত্যিকারের সফল দেখি তাঁরা কিন্তু আসলে কাজগুলো করছেন অনেকখানিই ভালবেসে। এই পরিশ্রমটাই কিন্তু তাঁদের কাছে আনন্দ এবং বিনোদন। আমরা দূর থেকে দেখে ভাবি লোকটা কি অমানবিক পরিশ্রমটাই না করছেন নাওয়া খাওয়া ভুলে। খুবই সত্যি কথা। কিন্তু আমরা ভুলে যাই এই হাঁড়ভাংগা পরিশ্রমএর মধ্যে মিশে আছে নিজের পছন্দের কাজটুকু করতে পারার এক গভীর তৃপ্তি।

৭. অনেকে হয়তো বলবেন বাংলাদেশের বাস্তবতায় নিজের পছন্দের বিষয়ে পড়তে চাওয়ার মত বিলাসিতা অনেকেরই করা সম্ভব হয় না। যেখান বাজার চড়া বিষয়ে পড়ে চাকুরী পাওয়ার কোন নিশ্চয়তা নেই সেখানে কার ঠেকা পড়েছে একটা বিষয় নিয়ে পড়ার যা পড়ে সারা জীবন বেকার থাকার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। বিশেষ করে একজন গরীব চাষীর কথা চিন্তা করা যেতে বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কথা চিন্তা করা যেতে পারে যারা শুধু মাত্র তাঁর সন্তান একটু ভাল লেখাপড়া করে একটা ভাল চাকুরী নিয়ে সংসারের হাল ধরবে সে আশায় আছে। সে জন্য রক্ত জল করে টাকা পয়সার যোগান দিচ্ছেন। তাঁদেরকে বোঝানো একটু কঠিন যে পছন্দের বিষয় নিয়ে পড়ার কথা।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে আসলে বলা মুশকিল কি করা উচিৎ। অন্তত আমার জানা নেই এর উত্তর কি হতে পারে। কিন্তু যেসব পরিবারের সামান্যতমও অর্থনৈতিক সাচ্ছল্য আছে, তাঁদের উচিৎ তাদেঁর সন্তানদের এই স্বাধীনতা টুকু দেয়া। ৮. এর মধ্যে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ভর্তি যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে ভর্তিচ্ছু তরুন তরুনীরা চষে বেড়াচ্ছে দেশময়।

তারপর একসময় ফল প্রকাশ হবে। অভিভাবকদের অনুরোধ করবো, কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার আগে আপনার সন্তানদের সাথে একটু কথা বলুন। তাঁদের মন মানসিকতা বোঝার চেষ্টা করুন। তাঁদের উপর আপনার ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পছন্দ চাপিয়ে না দিয়ে একটু আলোচনা করুন। তাঁরা নিজেরাই হয়তো জানে না তাঁদের কি পছন্দ করে।

তাঁদের একটু সাহায্য করুন। আজকের একটি সিদ্ধান্ত কিন্তু তাঁর জীবনের গতিপথ বদলে দেবে। এই সময়টা খুব সাবধানে সময় নিয়ে আগাতে হবে। খুব সাবধানে। ছাত্র ছাত্রীদের বলছি।

জীবন একটাই। এই জীবন তোমাকেই টেনে নিয়ে যেতে হবে, তাই এই জীবন কোনদিকে গেলে অর্থপূর্ন (অর্থ দ্বারা পূর্ণ নয়) হবে সেটি কিন্তু তোমাকেই বুঝতে হবে। এই বোঝার প্রক্রিয়াটিতে অভিভাবকরা বড় জোর তোমাকে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু সিদ্ধান্ত তোমাকে নিজেকেই নিতে হবে। কারন কোন ভুল সিদ্ধান্তের জের তোমাকেই বয়ে বেড়াতে হবে সারা জীবন ধরে। ৯. তৃণা এবং সজীবকে দিয়ে শুরু করেছিলাম, তৃণা এবং সজীবকে দিয়েই শেষ করি।

তৃণা এখন একটি সরকারী হাসপাতালে কাজ করে আর সন্ধ্যায় প্রাইভেট প্র্যাকটিস। সেদিন কাজের ফাঁকে হঠাৎ টিভি চ্যানেলে চোখ আটকে গেল। তারঁ কলেজের বন্ধু পন্নী রাহা একটা রিপোর্ট করছে, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে আইভী রহমানের সাক্ষাৎকার। পণ্ণী আর তৃণা দু’জন সব সময় এক সাথে থাকতো আর সাংবাদিকতা নিয়ে তাঁদের স্বপ্ন ভাগাভাগি করতো। পন্নীর নাম ডাক এখন ব্যাপক।

পন্নী প্রথম সারির একটি চ্যানেলের টপ রিপোর্টার। তৃণাকে কেন যেন হঠাৎ একটা বিষন্নতা আঁকড়ে ধরলো। টিভি বন্ধ করে শূন্য দৃষ্টিতে দেয়াল বরাবর তাকিয়ে থাকলো। সজীব এখন একটা প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করে। মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংটা নমঃ নমঃ করে শেষ করেছিল।

ক্লাস টাস তেমন একটা করতো না। তার শৈল্পিক মনের সৃজনশীলতার যে আকুতি সেটি ইঞ্জিনিয়ারিং কখনই মেটাতে পারেনি। তাই রেজাল্ট ও তেমন একটা ভাল হয়নি। সেদিন রাগীবের সাথে দেখা হল। রাগীব সজীবের ছোট্ট বেলার বন্ধু, দু’জন একসাথে বিভিন্ন ছবি আঁকা প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করত যেগুলোতে সজীবের আঁকা ছবির ধারে কাছে কেউ আসতে পারতো না।

। সেই রাগীবের আজকে একক চিত্র প্রদর্শনী হচ্ছে । শিল্পী মহলে সবাই তাঁকে আজকে এক নাম চেনে। আর সজীবের দিন চলে যাচ্ছে। শুধু প্রায়ই যখন শোবার ঘরের দেয়ালে টাঙ্গানো দশ বারো বছর আগের আঁকা অয়েল পেইন্টিং এর দিকে তাকায়, বুকের গভীর থেকে কেমন যেন একটা হাহাকার মেশানো দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.