আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কী শুনলাম, আর কী দেখলাম

‘বাজারে গরুর দাম আজ একেবারেই কম। বিক্রেতারা গরুর দাম এমনিতেই কম হাঁকাচ্ছেন। আর ক্রেতাদেরকেও খুব বেশি দামাদামি করতে হচ্ছে না...। ’ আজ রোববার সকালে খাবারের টেবিলে বসে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের খবর শুনে নাখালপাড়ার মাসুদুজ্জামান বেশ খুশি হলেন। কিছুক্ষণ পরই ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে তিনি যাবেন গরুর হাটে।

কোরবানির জন্য গরু কিনবেন। মাসুদুজ্জামান ও তাঁর স্ত্রী—দুজনই দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত বছর তিনি কোরবানির জন্য গরু কিনেছিলেন ৪২ হাজার টাকা দিয়ে। আর গরুটিও ছিল বেশ মোটাতাজা। এবার কোরবানির জন্য মাসুদুজ্জামানের গরু কেনার বাজেট ৫০ হাজার টাকা।

যেহেতু সবকিছুরই দাম বেড়েছে, নিশ্চয়ই গরুর দামেও তার একটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু সকালে টিভি চ্যানেলের খবরটি তাঁর আশা আরও বাড়িয়ে দিল। স্ত্রীকে বললেন, ‘এবারও গত বছরের দামেই গরু কিনতে পারবে। শোনো, টিভির খবরে কী বলছে। ’ স্ত্রী তাঁকে বললেন, ‘পুরো টাকাটাই নিয়ে যাও।

’ সকাল ১০টা নাগাদ বাসা থেকে বেরিয়ে ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন আগারগাঁওয়েরতালতলা গরুর হাটে। বেশ ফুরফুরে মেজাজ। বের হওয়ার সময় স্ত্রীকে বলে এসেছেন, ‘কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ফিরব। ’ কিন্তু গরুর হাটে এসে মাসুদুজ্জামানের মাথা ঘুরে যাওয়ার অবস্থা। হায়! হাটে হাতেগোনা মাত্র কয়েকটি গরু! এটা কি ঈদের গরুর হাট? রাস্তায় অফিসের একজন সহকর্মীর সঙ্গে দেখা হলো মাসুদুজ্জামানের।

সেই সহকর্মী তাঁকে জানালেন, গতকাল শনিবার রাত নয়টা থেকে তিনি বিভিন্ন হাটে ঘুরছেন। বিকেলে টিভির খবর শুনে ছুটে গিয়েছিলেন খিলক্ষেত গরুর হাটে। টিভির খবরে বলেছে, ওখানে নাকি গরুর দাম একেবারেই কম। রাত নয়টার দিকে সেখানে গিয়ে দেখেন, গরুর চেয়ে মানুষের সংখ্যা কয়েকগুণ বেশি। শেষ পর্যন্ত আজ সকালে গাবতলী থেকে ৬৫ হাজার টাকা দিয়ে একটি গরু কিনেছেন ।

সহকর্মীর মুখ দেখে মাসুদুজ্জামান বুঝতে পারছেন, একে তো সারা রাত ঘুম নেই, তার পর বেশি দাম দিয়ে গরু কিনেছেন—দুটি প্রভাবই পড়েছে সহকর্মীর চেহারার ওপর। এবার ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় মাসুদুজ্জামান ছুটলেন গাবতলী গরুর হাটে। রাস্তায় প্রচণ্ড জ্যাম। টেকনিক্যাল মোড়ে রিকশা ছেড়ে দিয়ে হেঁটে চললেন হাটের দিকে। রাস্তায় যে কয়টি গরুর দাম জিজ্ঞেস করেছেন, তা শুনে ক্রমেই ফ্যাকাশে হচ্ছে মাসুদুজ্জামানের মুখ।

হাটের বাইরেই কয়েকটি গরুর দাম জিজ্ঞেস করলেন। বাছুরের চেয়ে একটু বড়। আর বিক্রেতারা এগুলোর দাম হাঁকাচ্ছেন ৭০-৮০ হাজার টাকা! ভিড় ঠেলে হাটের ভেতরে ঢুকলেন। শুরুতেই ১ নম্বর হাসিল ঘর। অনেকেই গরু কেনার পর হাসিল দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন।

এখানে বিভিন্ন ক্রেতার কাছে গরুর দাম শুনে মাসুদুজ্জামানের মনে বেশ রাগ হলো—টিভির ওই প্রতিবেদকেরা কেন ভুল সংবাদটি বারবার পরিবেশন করেছেন? সবাইকে বিব্রত করে কী লাভ তাদের? যা হোক, এবার নিজের জন্য গরু কিনতেই হবে। প্রায় ঘণ্টাখানেক বাজার ঘুরলেন। দেখলেন, গরুর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। কেউ কেউ বলছেন, বিকেলের দিকে গরু না এলে হয়তো সন্ধ্যার পর হাট একেবারেই গরুশূন্য হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মাসুদুজ্জামানের মনে আশঙ্কা বেড়েই চলেছে—শেষ পর্যন্ত এবার কোরবানির জন্য গরু কিনতে পারবেন তো? ছেলের মুখটিও কেমন যেন বদলে গেছে।

হাটে যাওয়ার পর মাসুদুজ্জামান জানতে পারলেন, গতকাল সন্ধ্যার সময়ও যে গরুটি হাসিলসহ ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে, আজ সকালে সেই আকারের কিংবা তার চেয়েও ছোট আকারের গরুর দাম চাওয়া হচ্ছে ৭০-৮০ হাজার টাকা! বাজারের এতটা তারতম্য কেন হবে! এটা কীভাবে সম্ভব? এই বাজারকে অর্থনীতির কোনো তত্ত্ব দিয়ে বিচার করা যাবে? হঠাত্ এক গরু-বিক্রেতার সঙ্গে একটু ভাব জমে উঠল মাসুদুজ্জামানের। সেই বিক্রেতা তাঁকে জানালেন, গত বছর তিনি একাই এই কোরবানির হাটের জন্য ৪৬টি গরু এনেছিলেন। এর মধ্যে আটটি বড় আকারের গরু শেষ পর্যন্ত বিক্রি করতে পারেননি। ১২টি গরু বিক্রি করে তাঁর ক্ষতি হয় প্রায় দুই লাখ টাকা। বাকি ২৬টি গরু বিক্রি করে যে লাভ করেছেন, তা উল্লেখযোগ্য নয়।

তাই এবার আগে থেকেই কোরবানির হাটের জন্য গরু কম আনার সিদ্ধান্ত নেন। এবার তিনি গরু এনেছেন ২২টি। বেলা একটা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ১৮টি। আর যে লাভ হয়েছে, তাতে গত বছরের ক্ষতি পুষিয়ে গেছে। তিনি আশা করছেন, বাকি চারটিও বিকেলের আগেই বিক্রি হয়ে যাবে।

এ ছাড়া এবার গরুর দাম বাড়ার আরেকটি কারণ হিসেবে তিনি বললেন, যেখান থেকে তাঁরা গরু সংগ্রহ করেন, সেখানেও দাম কিছুটা বেড়েছে। আর রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসার পথে তাঁকে বিভিন্ন পয়েন্টে গরুপ্রতি অনেক টাকা চাঁদা দিতে হয়েছে। তা ছাড়া গরুর খাবারের দামও বেড়েছে। সবকিছুর প্রভাব পড়েছে গরুর হাটে। আর এর জন্য ভুক্তভোগী হচ্ছেন সাধারণ ক্রেতারা।

মাসুদুজ্জামান এবার গরুর দাম বাড়ার কারণগুলো জেনে গেলেন। তাঁর মনে হলো গতকাল টিভির খবরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়ার কথা, ‘কোথাও কোনো চাঁদাবাজি হচ্ছে না...। ’ শেষ পর্যন্ত এই বিক্রেতার কাছ থেকে মাসুদুজ্জামান এবার কোরবানির জন্য একটি গরু কিনতে সমর্থ হলেন। হাসিলসহ গরুটির দাম পড়েছে ৫২ হাজার টাকা। আর এবারের গরুটি গত বছরের চেয়ে অনেক ছোট।

পকেটে কিছু বাড়তি টাকা ছিল, তাই আর অসুবিধা হয়নি। বিক্রেতার হাতে টাকা দেওয়ার আগে মাসুদুজ্জামান ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘গরুটা পছন্দ হয়েছে?’ ছেলে বলল, ‘বাবা, এবার কি সবাই কোরবানি দিতে পারবে?’ মাসুদুজ্জামানের মুখে কোনো শব্দ নেই। ভিড় ঠেলে গরু নিয়ে চলে এলেন সেই ১ নম্বর হাসিল ঘরের সামনে। ছেলের হাতে গরুর রশিটি ধরিয়ে দিয়ে গেলেন হাসিল দিতে। তার পাশেই একজন গরু কিনতে এসেছেন সাভার থেকে।

সাভারে নাকি গরু নেই। বাসায় আসার পথে অনেক পথচারীরই রাস্তায় তাদের গরুর দাম জিজ্ঞেস করছিলেন। কিন্তু মাসুদুজ্জামানের মুখে কোনো কথা নেই, ছেলের প্রশ্নটি তার মনে আরও অনেক প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।