আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অকুপাই ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনের প্রেক্ষাপট: মার্কিন পুজিবাদের সাম্প্রতিক সংকট

“The worker need not necessarily gain when the capitalist does, but necessarily loses when the letter loses…the workers suffers in his very existence, the capitalist in the profit on his dead mammon.” –Karl Marx, Economic and Philosophic Manuscripts of 1844. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে এ পর্যন্ত ১০টি মন্দা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যার সবগুলোকেই মার্কিন পুজিবাদ বিভিন্ন উপায়ে কোন রকমে সামাল দিয়ে দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। সামরিকায়ন, যুদ্ধ, সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যের বিস্তার, রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তা, প্রযুক্তিগত উন্নয়ণ, শ্রমিক ছাটাই, মজুরী হ্রাস ইত্যাদি নানান উপায়ে বিভিন্ন সময় পুজিবাদী অর্থনীতির এই সংকট উত্তোরণ ঘটানো হয়েছে। কিন্তু এবারের সংকট ভিন্ন। ইতিপূর্বে কাজে লাগানো কৌশলগুলোর কোনটাই যেন কাজ করছেনা এবার। কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা প্যাকেজ মার্কিন ফাইনান্সিয়াল অর্থনীতিতে ঢালা হয়েছে।

ইরাক ও আফগানিস্তানের দুই দুইটা যুদ্ধে আরো কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার খরচ করা হয়েছে। কিন্তু ফলাফল কি? আগষ্ট ২০০৭ থেকে জুন ২০০৯ পর্যন্ত বড় বড় কর্পোরেশনগুলোকে বেইল আউট এর জন্য খরচ করা অর্থের মাধ্যমে প্রাথমিক ভাগে পুরোপুরি পতনের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হলেও পরের দুই বছর, জুন ২০০৯ থেকে জুলাই ২০১১ পর্যায়ে দেখা যায় গোটা অর্থনীতি যেন থমকে আছে- ধ্বস এড়ানো গেলেও ব্যাবসা ও অর্থনীতিকে স্লথ গতি থেকে বের করা যাচ্ছে না, লাখ লাখ ছাটাই হওয়া শ্রমিকের জন্য কর্মসংস্থানেরও কোন ব্যাবস্থা হচ্ছে না। জুলাই ২০১১ থেকে আবার পতনের দিকে যাত্রা। বছরের প্রথম ভাগে প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ০.৪% এবং কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি ছিল শূণ্য। গোটা শ্রমিক বাহিনীর প্রায় ৫ ভাগের ১ ভাগ অর্থাত ৩ কোটি শ্রমিক হয় একেবারে বেকার অথবা অর্ধ বেকার।

সরকারি হিসেবেই পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ও ক্ষমতাবান দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি ৬০ কোটি মানুষ দারিদ্র সীমার নীচে বাস করছে। এরই মধ্যে আবার নয়া উদারনৈতিক পুজিবাদী অর্থনৈতিক নিয়মে রোল উঠেছে রাষ্ট্রের ব্যায় সংকোচনের। ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় খাতে ৬ লক্ষ শ্রমিক ছাটাই করা হয়েছে, ডাক বিভাগ থেকে আরো ১ লক্ষ ২০ হাজার ছাটাই ও ৩০০০ হাজার পোষ্ট অফিস বন্ধ করে দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে। উইসকোনসিন, ওহাইও, ইন্ডিয়ানা, আরিজোনা, মিশিগান সহ অনেক রাজ্যে সরকারি খাতে শ্রমিক সংগঠন ভেঙে দেয়ার তৎপরতা চলছে। সেখানে দরিদ্রদের অর্থ ও খাদ্য সহায়তা, স্বাস্থ্য সেবা, মেডিকেয়ার, মেডিকএইড, ছাত্রদেরকে শিক্ষা সহায়তাসহ সকল প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা মূলক প্রোগ্রাম বাতিল করা হচ্ছে।

অর্থাৎ কর্পোরেট ফাইন্সিয়াল প্রভুদেরকে বেইল আউট করার বেলায় যে রাষ্ট্রের অর্থের অভাব হয়না সেই রাষ্ট্রই আবার ব্যায় সংকোচনের নামে দরিদ্র জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়। আপাত অর্থে এরকম একটি পরিস্থিতিই অকুপাই ওয়ালষ্ট্রিট আন্দোলনের বাস্তবতা তৈরী করেছে যে আন্দেলনের প্রাথমিক লক্ষ হলো কর্পোরেট আমেরিকার ফাইনান্সিয়াল প্রভুদের ক্ষমতা খর্ব করা। কিন্তু মার্কিন পুজিবাদী অর্থনীতির ফাইনান্সিয়ালাইজেশান এবং ফাইনান্সিয়াল খাতের আধিপত্য যদি এই সংকটের দৃশ্যমান কারণ হয় তাহলে প্রশ্ন থেকে যায় এই ফাইনান্সিয়ালাইজেশনটাই বা ঘটলো কেন, ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের সংকটই বা তৈরী হলো কিভাবে আর তা থেকে বেরিয়ে আসতেই বা পারছে না কেন মার্কিন পুজিবাদ? সংকটের নতুন রুপ: কর্মসংস্থানবিহীন সংকট-উত্তরণ বা জবলেস রিকভারি পুজিবাদী অর্থনীতিতে মন্দা কেটে যাওয়ার সাধারণ লক্ষণ হলো জমে থাকা পণ্য নতুন করে বিক্রী শুরু হয়, ব্যাবসায় নতুন বিনিয়োগ হয়, উৎপাদন চক্র চালু হয়, ছাটাই করা শ্রমিকদেরকে আবার নিয়োগ দিতে শুরু করে মালিকেরা। ঐতিহাসিক ভাবে দেখা গেছে সাধারণত রিকভারি শুরু হওয়ার পর ৩ থেকে ৪ মাস লাগে কর্মসংস্থানের সংখ্যা সংকট-পূর্ব অবস্থায় ফিরে আসতে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের মন্দাগুলোতে এর ব্যাতিক্রম দেখা যাচ্ছিল।

১৯৯১ সালের মন্দার সময়ই এই মৌলিক পরিবর্তনের সকল লক্ষণ দেখা যায়। তখন রিকভারি শুরু হওয়ার পর ১৮ মাস লেগেছিল সংকট-পূর্ব অবস্থায় আসতে। প্রাথমিক অবস্থায় বিষয়টি পুজিবাদী অর্থনীতিবিদদের উদ্বিগ্ন করে তুললেও ডট.কম বাবল বা কম্পিউটার-ইন্টারনেট-স্যাটেলাইট-টেলিকমিউনিকেশন-সফটওয়ার ইত্যাদি প্রযুক্তিগত বিকাশের মাধ্যমে মন্দা কাটানোর নেশায় তারা সেটা ভুলেও যায়। কিন্তু কয়েক বছর যেতে না যেতেই ২০০০-২০০১ সালে এসে ডট.কম বাবল এর বিস্ফোরণ ঘটে। পুজিবাদী অর্থনীতিতে আবারও ধ্বস নামে।

শত শত কম্পানি যেগুলো ৯০ দশকের ডট.কম বাবলে করে বাতাসে ভাসছিল একেবারে পথে বসে যায়। প্রযুক্তি পণ্যের অতি-উৎপাদন ফলে যে সংকট শুরু শুরু হয় সেটা গৃহায়ণ, গাড়ি শিল্প, ইলেক্ট্রনিক্স সহ গোটা অর্থনীতিরই সাধারণ সংকটে পরিণত হয়। কিন্তু এই মন্দার চেয়েও ভয়ংকর বিষয় হলো মন্দা পরবর্তীতিতে ২০০১-২০০৪ সালে যে রিকভারি হয়, সেই রিকভারি ১৯৯১ সালের রিকভারির চেয়েও ধীরগতিতে কর্মসংস্থান পুনপ্রতিষ্ঠা করে-১৮ মাসের জায়গায় সেবার পুরো ৪৮ মাস লাগে সংকট-পূর্ব অবস্থায় ফিরে যেতে। কিন্তু যে পদ্ধতিতে এই মন্দার উত্তোরণ ঘটানো হয় সেটা পরবর্তীতে ২০০৭ সালে শুরু হওয়া মন্দার প্রেক্ষিত তৈরী করে দিয়েছিল, যার জের এখনও চলছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ গোটা পুজিবাদী অর্থনীতিতে। পুজিবাদী রিয়েল ইকোনোমি’র অতি-উৎপাদনের সংকট থেকে উত্তোরণের জন্য সে সময় গোটা অর্থনীতি ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়।

অর্থাৎ কলকারখানায় লাভজনক বিনিয়োগের সংকটের ফলে জমে থাকা অলস পুজি এবার ঝাপিয়ে পড়ে শেয়ার বাজারের ফাটকাবাজির দিকে। ঋণে ঋণে সয়লাব হয়ে যায় গোটা অর্থনীতি। সরকারি ভাগে ব্যাংকগুলোকে দেয়ার ঋণের সুদের হার ৫.৫% থেকে ১% এ নামিয়ে আনা হয়। শুরু হয় বন্ধকী ঋণের কারবার। মধ্যবিত্ত নিম্ন বিত্তকে উৎসাহিত করা হয় বাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ গ্রহণে এবং সেই ঋণ দিয়ে তার দৈনন্দিন আর্থিক সংকট থেকে উত্তরণে।

সেই ঋণকে এরপর সিকিউরিটিস এ পরিণত করে ব্যাংক এবং হেজ ফান্ডগুলো সেই মর্টগেজ ভিত্তিক সিকিউরিটিসগুলোকে একত্রিত করে ইকুইট বন্ড, মেজানাইন বন্ড, ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড ইত্যাদি বিভিন্ন গ্রেডিং এর প্যাকেজে পরিণত করে এবং শেয়ার বাজারে বেচা-বিক্রি শুরু করে। হু হু করে বাড়তে থাকে বাড়ির দাম, সেই সাথে মর্টগেজ ভিত্তিক সিকিউরিটস এর দাম। জন্ম হয় হাউসিং বাবল বা গৃহায়ণ বুদবুদের। সাময়িক কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এই ফাইনান্সিয়াল বুদবুদ ২০০১ সালের মন্দা থেকে মার্কিন অর্থনীতিকে সাময়িক ভাবে বের করে নিয়ে আসলেও চীরকাল তো আর ঘর-বাড়ি আর সেই ঘর-বাড়ি ভিত্তিক সিকিউরিটিস এর দাম বাড়তে থাকতে পারে না । একসময় চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়তি হয়ে যায় এবং বাস্তব কারণেই অধিকাংশ নিম্ন আয়ের মানুষ বন্ধকী ঋণের(যে ঋণের সুদ প্রথমে কম কিন্তু পরে ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে- যেটাকে বলা হয় এডজাস্টেবল রেট) কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যর্থ হয়।

বাড়ির দাম কমতে থাকে। তখন দেখা যায়, সেই বাড়ি বন্ধক রেখে নেয়া ঋণের উপর ভিত্তি করে যে সিকিউরিটিসগুলো শেয়ার বাজারে বিকিকিনি হচ্ছিল সেগুলোর এর দাম বাড়ির বাস্তব বাজার মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ফলে সেই শেয়ার আর কেউ কিনতে চাইল না। যখন সবকিছু ভালয় ভালয় চলছিল তখন কেউ সেই শেয়ারগুলোর ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। কিন্তু এখন বাড়ির দর পড়তে থাকায় সেই সব বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মূল্যের সিকিউরিটিস গুলো আক্ষরিক অর্থেই টয়লেট পেপারে পরিণত হলো।

কেননা ফাইনান্সের দুনিয়ায় এখন আর কোন মূল্য নেই, ভবিষ্যতে উচ্চমূল্য পাওয়ার আশা না থাকায় এগুলো আর কেউ কিনতে চাইছে না। বিস্ফোরণ ঘটে হাউসিং বাবল বা গৃহায়ণ বুদবুদের। (এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখার জন্য দেখুন: “আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারের পতন ও ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের সংকট” ) বড় বড় কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর হাতে থাকা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের অসংখ্য মর্টগেজ ভিত্তিক সিকিউরিটিস রাতারাতি মূল্য হারালো। তখন মার্কিন রাষ্ট্র জনগণের ট্যাক্সের অর্থে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করে এদের মূল্যহীন সিকিউরিটিস গুলো কিনে নিয়ে এসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে রক্ষা করলো যেটাকে বলা হয় বেইল-আউট। মার্কিন পুজিবাদ এভাবে কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বেইল আউট করলেও জনগণকে ঠিকই বন্ধকী ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে ব্যার্থ হওয়ার দায়ে ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করা হলো।

সেই সাথে ব্যায় সংকোচনের নামে শ্রমিক ছাটাই-স্বাস্থ্য-শিক্ষা-খাদ্য সহায়তা খাতে বরাদ্দ কমানোর ধাক্কা তো আছেই। এভাবে কর্পোরেটদের বেইল-আউট করে অর্থনীতি পুনরুজ্জীবনের যে চেষ্টা চালানো হলো তাতে অর্থনীতি সাময়িক ভাবে বাড়তে শুরু করল ঠিকই কিন্তু নতুন কোন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াই। এবং এইবারের জবলেস রিকভারি বা কর্মসংস্থান বিহীন সংকট-উত্তোরণের সংকট এর আগে উল্ল্যেখিত ১৯৯০ এবং ২০০১ সালের মন্দা পরবর্তী জবলেস রিকভারির সংকটের চেয়ে আরো ভয়াবহ। জবলেস রিকভারির কারণ: সংকটের আগে এবং সংকটের সময় উৎপাদনশীলতা (বা শ্রম শোষণের হার) বাড়ানোর জন্য যে প্রযুক্তির ব্যাবহার করা হয় তা আবার পুজিবাদী অর্থনীতির বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম অধিদপ্তর প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে দেখা যায় ২০০৯ সালের থার্ড কোয়ার্টারে উৎপাদনশীলতা বেড়েছে ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে ১৩.৬% এবং অন্যান্য খাতে ৯.৫%।

ঐ তিন মাসে উৎপাদন বেড়েছে ৪% যদিও মোট শ্রমঘন্টার পরিমাণ কমেছে ৫%। পুজিবাদী বিশ্লেষকরাই এখন বর্ণনা করছেন কেমন করে মালিক শ্রেণী উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য যন্ত্রপাতি কেনার মধ্যদিয়ে শ্রমিক ছাটাই করেছে এবং ইন্ডাষ্ট্রিয়াল রিজার্ভ আর্মি বা বেকার শ্রমিকের সংখ্যা বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা অবশ্য এই পর্যন্ত এসেই থেমে যায়, বলতে ভুলে যায় যে, এভাবে ক্রমান্বয়ে উৎপাদনশীলতা ও কর্মদক্ষতা বাড়াতে বাড়াতে পুজিবাদী অর্থনীতি এমন একটা অবস্থায় এসে পৌছায় যে অতিউৎপাদন আর বেকারত্বের চাপে একসময় একেবারে থমকে যায়। এই মুহুর্তে ব্যাংকারদের হিসাব বাদ দিয়ে শুধু পুজিমালিকদের কাছেই ২ হাজার বিলিয়ন ডলারের বেশি পুজি জমে আছে যেটা তারা বিনিয়োগ করছে না কারণ জনগণের কাছে ব্যায় করার মতো অর্থ নাই অর্থাৎ তাদের সম্ভাব্য উৎপাদিত পণ্যের বাজার নাই, মুনাফাও নাই। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ৪৪৭ বিলিয়ন ডলারের নতুন একটা বিল উত্থাপন করেছেন গত ৭ সেপ্টম্বর ২০১১ তে।

দুই দিন পর নিউ ইয়র্ক টাইমস এর হেডলাইন হয়: “মালিকেরা বলছেন নতুন কর্মসংস্থানের জোয়ার আসবে না”। মালিকেরা বলছে তারা নতুন নিয়োগ দেবে না কারণ বাজারে বাড়তি পণ্যের চাহিদা বা জনগণের পর্যাপ্ত ক্রয়ক্ষমতা নেই ফলে বাড়তি কর্মসংস্থানের সুযোগও নেই। কিন্তু মুশকিল হলো নতুন কর্মসংস্থান না হলে তো লোকের ক্রয় ক্ষমতাও বাড়বে না, বাজারের চাহিদাও বাড়বে না! ক্রমহ্রাসমান মুনাফার হার, অতি উৎপাদন ও পুজিবাদের চরম সংকট: পুজিবাদের যতই বিকাশ ঘটতে থাকে ততই যন্ত্রপাতির তুলনায় শ্রমিকের চাহিদা কমতে থাকে। কারণ প্রতিযোগীতায় টিকে থাকার জন্য পুজিপতিকে বিভ্ন্ন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যাবহারের মাধ্যমে কম সময়ে বেশি উৎপাদনের দিকে অর্থাৎ শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর দিকে ঝুকতে হয়। যে পুজিপতি তার অন্য প্রতিযোগীদের আগেই বিভিন্ন প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি ব্যাবহারে মাধ্যমে কম সময়ে তার প্রতিযোগীর তুলনায় বেশি পণ্য উৎপাদন করতে পারবে অর্থাৎ উৎপাদনশীলতা বাড়াতে পারবে তার মুনাফার পরিমাণও প্রতিযোগীতার তুলনায় বেশি হবে কারণ এখন সে একজন শ্রমিকের কাছ থেকে একই মজুরীতে বা খরচে প্রতি ঘন্টায় আগের চেয়ে বেশি পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করিয়ে নিতে পারে।

ফলে তার পক্ষে একই সময়ে বাড়তি পণ্য উৎপাদন করে সেটা বাজারে বিক্রি করে বাড়তি মুনাফা অর্জন সম্ভব হয়। কিন্তু এর ফলে একই সাথে দুটো ঘটনা ঘটে: একদিকে একই পরিমাণ্য পণ্য উৎপাদনের জন্য এখন আগের চেয়ে কম সংখ্যক শ্রমিকের প্রয়োজন হয়, ফলে শ্রমিক ছাটাই হয়, ইন্ডাষ্ট্রিয়াল রিজার্ভ আর্মি বড় হতে থাকে অন্যদিকে মুনাফার হার কমতে থাকে। মুনাফার হার নির্ধারিত হয় বিনোয়োগের তুলনায় মুনাফার পরিমাণ দ্বারা। যদি ১০০ টাকা বিনিয়োগ করে ১০ টাকা মুনাফা করা যায় তাহলে মুনাফার হার ১০%। যদি ১০০০ টাকা খরচ করে নতুন যন্ত্রপাতি কিনে উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে ২০ টাকা মুনাফা করা যায় তাহলে মুনাফার হার ২%।

প্রথম ক্ষেত্রের চেয়ে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মুনাফার পরিমাণ বেশি হলেও যেহেতু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেশি, তাই মুনাফার হার কমে গেছে। যেহেতু শ্রমিকের উদ্বৃত্ত শ্রম থেকেই মুনাফা তৈরী হয়, ফলে প্রতি ঘন্টায় একজন শ্রমিকের শ্রমের মাধ্যমে আগের চেয়ে বেশি পণ্য উৎপাদনের ফলে প্রতিটি পণ্যে আগের তুলনায় কম উদ্বৃত্ত শ্রম বা মুনাফা থাকে। এই নতুন হ্রাসকৃত মুনাফার হারে বেশি মুনাফা অর্জনের জন্য পুজিপতিকে আগের চেয়ে ক্রমশ বেশি পরিমাণ পণ্য বিক্রিয় করতে হয়। কিন্তু বেশি পণ্য কিনবে কে? ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিজার্ভ আর্মি বড় হওয়ার কারণে সমাজের তো ক্রয় ক্ষমতা তুলনামূলক ভাবে কমতে থাকে অর্থাৎ উৎপাদনের তুলনায় ক্রয় ক্ষমতা কমে যায়, দেখা দেয় অতি উৎপাদনের সংকট। এভাবে পুজিবাদের বিকাশের প্রয়োজনে যে উৎপাদনশীলতার বিকাশ ঘটানো হয় সেই উৎপাদনশীলতাই একসময় পুজিবাদের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়।

পুজিবাদী অর্থনীতিতে প্রতিনিয়ত এই দ্বন্দ্ব চলতে থাকে এবং নানান ভাবে কখনও একচেটিয়া করণের মাধ্যমে, কখনও বড় পুজি ছোট পুজিকে হজম করার মাধ্যমে, কখনও যুদ্ধ বাধিয়ে, কখনও ঋণ সরবরাহ বাড়িয়ে, কখনও ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের মাধ্যমে পুজিবাদ এ দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করার চেষ্টা করে। কিন্তু গত কয়েক দশকে প্রযুক্তিগত বিপ্লব, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, ক্রমহ্রাসমান মুনাফার হার, অতি উৎপাদনের সংকট ইত্যাদি সবকিছু মিলিয়ে পুজিবাদ এখন এমন একটা পরিস্থিতিতে উপনীত হয়েছে যে এখন কোন ভাবেই আর এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। মন্দা কাটানোর জন্য ঋণ সরবরাহ ও ফাইনান্সিয়ালাইজেশানের মাধ্যমে কৃত্রিম ভাবে ক্রয় ক্ষমতা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টা করা হলেও হাউসিং বাবলের বিস্ফোরণ ও ঋণের ঢল থেমে যাওয়ার পর দেখা গেল বাজার অবিক্রিত পণ্যে সয়লাব হয়ে আছে। কারখানাগুলোর যে পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করার ক্ষমতা আছে তার সম পরিমাণ পণ্য উৎপাদন করলে পণ্য অবিক্রিত থেকে যাবে বলে কারখানাগুলো উৎপাদন ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম উৎপাদন করছে। গাড়ি কারখানাগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ২০০৮ সালে ছিল ১ কোটি ৮৩ লক্ষ কিন্তু ২০০৯ সালে দেখা গেল তারা মাত্র ১ কোটি ১০ লক্ষ গাড়ি বাজারজাত করার পরিকল্পনা করছে।

বিক্রয় যোগ্য বাড়তি বাড়ির পরিমাণ ছিল সে সময় ১৩ লক্ষ। একই ভাবে স্টিল, মাইক্রোচিপ ইত্যাদি অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের ক্ষেত্রেও অতি উৎপাদনের নানান লক্ষণ দেখা যায়। বস্তুত গৃহায়ণ কিংবা অটোমোবাইলের মতো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলোতে অতি উৎপাদনের সংকট সাধারণ ভাবে বিভিন্ন খুচরা যন্ত্রপাতি, কাচামাল ইত্যাদি শিল্পেও অতি উৎপাদনের সংকট তৈরী করে। এরকম সংকট জনক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার জন্য লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র খুজতে লগ্নী পুজি একসময় সারা দুনিয়াকে তার বিনিয়োগের ক্ষেত্র বানিয়েছে। একসময় এভাবে প্রান্তস্থ দেশগুলো থেকে, যেখানে পুজিবাদ তুলনামূলক কম বিকশিত ফলে পুজিবাদের সংকটও অপরিণত, সেখানে পুজি রপ্তানির মাধ্যমে বিপুল মুনাফা আহরণ করেছে এবং তার বিনিময়ে নিজ দেশের অর্থনৈতিক সংকট ও শ্রেণী সংগ্রামকে সামাল দিয়েছে।

কিন্তু বর্তমানে ব্শ্বিায়িত দুনিয়ায় ইতোমধ্যেই সারা দুনিয়ার প্রায় সমস্ত লাভজনক ক্ষেত্রে পুজিবাদী অর্থনীতির নিয়মের আওতায় চলে আসা, নতুন বৈশ্বিক শ্রম বিভাজন, ম্যানুফ্যাকচারিং এর লাভজনক আউট সোর্সিং ইত্যাদির ফলাফল স্বরুপ পুজি রপ্তানি এখন সাম্রাজ্যবাদী দেশের শ্রমিক শ্রেণীর অবস্থা উন্নয়ণের বদলে মজুরী হ্রাস, শ্রমিক ছাটাই, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ব্যায় হ্রাস ইত্যাদি কাজে ব্যাবহ্রত হচ্ছে। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে পুজিবাদী অর্থনীতির কেন্দ্রে থাকা দেশগুলোতে শ্রেণী সংগ্রাম জোরদার হয়ে উঠার পরিস্থিতি তৈরী হওয়াই স্বাভাবিক। স্পেন, গ্রীস, ইতালি, ইংল্যান্ড সহ গোটা ইউরোপ এবং মার্কিনযুক্তরাষ্ট্র সহ দুনিয়ার দেশে অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট মুভমেন্টের দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়া, জনপ্রিয় হয়ে উঠা তারই স্বাক্ষ্য বহন করে। এখন এই আন্দোলন কোন পথে যাবে, কতটুকু সার্থক হবে তা নির্ভর করবে কতটা সফল ভাবে আন্দোলনকারী শক্তিগুলো সত্যিকার শত্রু হিসেবে কেবল একচেটিয়া পুজিবাদের কর্পোরেট ফাইনান্সিয়াল চেহারাই নয়, খোদ পুজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যাবস্থাকেই চিহ্নিত ও তার বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি ও ধারাবাহিক আক্রমণ রচনা করতে পারবে তার উপর। তবে যাই ঘটুক না কেন এ আন্দোলন ইউরোপ আমেরিকার মতো ধনী দেশগুলো সহ গোটা বিশ্বের তরুণ প্রজন্মের চিন্তা জগতে এক বৈপ্লবিক আলোড়ন যে তৈরী করছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ রাখার কোন কারণ নেই।

কৃতজ্ঞতা: মূলত Fred Goldstein এর CAPITALISM AT A DEAD END- Job Destruction, Overproduction and Crisis In the High Tech Era লেখাটি অবলম্বন করে এই লেখাটি তৈরী করা হয়েছে। Click This Link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১০ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।