আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ ১৯২২ সালটি ছিল হাছন রাজার মৃত্যুর বছর। তার মানে, আজ আমরা তাঁর যেসব গান শুনছি, তা সবই ১৯২২ সালের আগে রচিত। কি আশ্চর্য! আশ্চর্য হওয়ার কারণ- হাছন রাজার গান শুনলে মনে হয় যেন এই মরমী সাধক গানগুলি আজই রচনা করেছেন ।

বাংলায় ‘আবহমান’ বলে একটা কথা আছে না? হাছন রাজার গানের কথা ভাবলে আবহমান বাংলার কথাও উঠে আসে যেন । হাছন রাজা আবহমান বাংলার অতি শুদ্ধ এক মরমী কবি। হাছন রাজার গান ছন্দময় এবং সুরেলা তো বটেই, সেই সঙ্গে প্রকাশভঙ্গি অত্যন্ত সহজ অথচ গভীর অর্থপূর্ণ । এই যেমন : নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে হাছন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে। কিন্তু কে পিয়ারি? আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠি।

পিয়ারির সঙ্গে হাছন রাজার কি সম্পর্ক? হাছন রাজা পিয়ারির প্রেমে কেনই-বা মজলেন? কি তার প্রেক্ষাপট? কেনই-বা হাছন রাজার বাঁকা দু নয়নে নেশা লাগল? একি নিছক মানবমানবীর প্রেম? না অন্য কিছু? এই নেশার প্রকৃত অর্থই-বা কি? এসব প্রশ্নে আমরা কৌতূহলী হয়ে উঠি। জীবনভর হাছন রাজা কি খুঁজেছিলেন তা আমরা জানি। জীবনভর হাছন রাজা যাকে খুঁজেছিলেন জীবদ্দশায় তাকে খুঁজে পেয়েছিলেন বলে আমাদের মনে হয়। নইলে তিনি কেন গাইবেন- ছটফট করে হাছন দেখিয়া চাঁনমুখ হাছনজান- এর মুখ দেখি জন্মের গেল দুখ। (হাছন+জান=হাছনজান=পিয়ারি?আরেকটু তলিয়ে দেখা যেতে পারে।

জান=অন্তর। যেখানে বাউলের প্রাণের মানুষ বাস করেন। কাজেই হাছনজান পিয়ারিকে প্রাণের (বা মনের ) মানুষের মূর্ত রূপ ভাবতে পারি কি? আবার হাছনের জান কে হাছনের কলবও ভাবা যায়। ) কিন্তু হাছন রাজার মতো একজন বিষয়-অনাসক্ত আল্লাহভক্ত মানুষের প্রেম তো আর আর আট/দশজনের মতো নিছক প্রেম নয়। হাছন রাজার প্রেম মোর দ্যান দ্যাট।

হাছন রাজার প্রেম হল ইশক! কাজেই পিয়ারির প্রকৃত স্বরূপের প্রতি আমরা মনোনিবেশ করতে পারি। মনে হয় পিয়ারি আধ্যাত্মিক কোনও সত্তার প্রতিরূপ। মর্তের কেউ নয়। উপরন্ত, পিয়ারি অত্যন্ত খুবসুরত নারী। অর্থাৎ চাঁদের মতো সুন্দরী নারী।

কেননা, ছটফট করে হাছন দেখিয়া চাঁনমুখ কিন্তু সে সৌন্দর্য কেবলি নারীর দেহজ রূপের মধ্যে সীমিত কি? নিশ্চয় না। তাহলে? সে রূপ আরও দূরবর্তী মায়াবী পর্দার অন্তরালের অপার্থিব কিছুর ইঙ্গিত দেয়। কিন্তু, কি সেই ইঙ্গিত? আমাদের মনে হয়, কেউ একজন পিয়ারির রূপ ধরেছে। কে সে? সে-যাকে হাছন রাজা খুঁজেছিলেন জীবনভর। যাকে দেখে- হাছনজান-এর রূপটা দেখে ফালদি ফালদি ওঠে চিরাবারা হাছন রাজার বুকের মধ্যে ফোটে।

(‘চিরাবারা’ শব্দটির মানে কিন্তু বোধ গম্য হল না। তাতে অবশ্য গানটির স্বরূপ উদঘাটনে বিন্দুমাত্র বিঘ্ন ঘটেনি। বাউল গানের কিছু শব্দ উহ্যই থাকুক না কেন। কিন্তু‘চিরাবারা’ কি কোনও ফুলের নাম? পদ্ম? সুনামগঞ্জের ভাষায় কোনও ফুলের নাম? যা বুকের মধ্যে ফোটে? ... লালন ও হাছনের প্রতি ভক্তির নিদর্শন স্বরূপ আমাদের কুষ্ঠিয়া এবং সুনামগঞ্জের ভাষা শেখা উচিত। ভবিষ্যতে সেরকমই ঘটবে আশা করি।

) হাছনজান (পিয়ারি) কে দেখে সংশয়ী হাছন রাজার সংশয় ঘুচে গিয়েছিল বলে ভাবতে ভালো লাগছে। জীবনের কোনও এক পর্যায়ে মরমী হাছন পিয়ারিকে দেখে আনন্দে লাফিয়ে উঠেছিলেন। বুকের ভিতরে স্বর্গীয় প্রেমের অভিঘাত/কম্পন টের পেয়েছিলেন। পিয়ারির চাঁদমুখ বলে দেয় যে এ জীবন অর্থহীন নয়। জীবনের মানে আছে, এবং সে মানে অত্যন্ত গূঢ় এবং গভীর।

জীবন-মৃত্যুর ওপারে এক লোকোত্তর সত্তা রয়েছে- যার কথা ভাবতে বসলে নেশা ধরে যায়; সংসারে বৈরাগ্য আসে, ভবের হাটের বিকিকিনি তুচ্ছ মনে হয়। সেই নামহীন সত্তার অস্তিত্ব সর্ম্পকে এতকাল সংশয় ছিল হাছনের । আজ পিয়ারিকে দেখে, প্রকারন্তরে এক অপরূপা নারীর রূপমাধুর্য দেখে সব সংশয় ঘুচে গেল। এক মায়াবী নারী যোগবলে হাছনকে এলমে তাসাউফ-এর পথ (সুফিবাদের পথ) দেখাল। এভাবে সমস্ত সংশয় ঘোচার আনন্দে হাছন রাজা গান ধরলেন: নেশা লাগিল রে বাঁকা দুই নয়নে নেশা লাগিল রে হাছন রাজা পিয়ারির প্রেমে মজিল রে।

আজ থেকে শত বছর আগে হাছন রাজার চোখে নেশা লেগেছিল। সে নেশা আজও আমরা অনুভব করি যেন ... উৎসর্গ: হাসান সাইমুম ওয়াহাব (সিমু) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।