বরং দ্বিমত হও, আস্থা রাখ দ্বিতীয় বিদ্যায়। প্রথম পর্ব : ফুল তোলা, প্রেমলিপি ও পত্র দেওয়া
দ্বিতীয় পর্ব : বরকামনা, পত্রপাঠ, হৃদয় দান ও বিবাহের প্রস্তাব
তৃতীয় পর্ব : বিবাহের আয়োজন, মুসলমান কন্যার সাথে জয়ার ভাব, দুঃসংবাদ ও চন্দ্রার অবস্থা
(১২) শেষ
নির্ম্মাইয়া পাষাণশিলা বানাইলা মন্দির।
শিবপূজা করে কন্যা মন কর স্থির। ।
অবসরকালে কন্যা লেখে রামায়ণ।
যাহারে পড়িলে হয় পাপ বিমোচন। ।
জন্মথ থাকিব কন্যা ফুলের কুমারী। *
একনিষ্ট হইয়া পূজে দেব ত্রিপুরারী। ।
শুধাইলে না কয় কথা মুখে নাহি হাসি।
একরাত্রে ফুটা ফুল ঝুইরা হইল বাসি। ।
এমন কালেতে শুন হইল কোন কাম।
যোগাসনে বৈসে কন্যা লইয়া শিবের নাম।
।
বম্ বম্ ভোলানাথ গাল-বাদ্য করি।
বিহিত আচারে পূজে দেব ত্রিপুরারী।
বৈশাখ মাসেতে হয় রবি খরতর।
গাছেতে পাকিল আম অতি সুবিস্তর।
।
বারতা লইয়া আসে পত্রে ছিল লেখা।
চন্দ্রাবতী সঙ্গেতে করিতে আইল দেখা। ।
এই পত্রে লিখিয়াছে দুঃখের ভারতী।
জয়ানন্দ দিছে পত্র শুন চন্দ্রাবতী।
পত্রে পড়ীল কন্যা সকল বারতা।
পত্রেতে লেখ্যাছে নাগর মনের দুঃখ কথা। ।
“শুনরে প্রাণের চন্দ্রা তোমারে জানাই।
মনের আগুনে দেহ পুড়্যা হইছে ছাই। ।
অমৃত ভাবিয়া আমি খাইয়াছি গরল।
কন্ঠেতে লাগিয়া রইছে কাল-হলাহল। ।
জানিয়া ফুলের মালা কালসাপ গলে।
মরণে ডাকিয়া আসি আন্যাছি অকালে। ।
তুলসী ছাড়িয়া আমি পূজিলাম সেওরা।
আপনি মাথায় লইলাম দুঃখের পসরা।
।
জলে বিষ বাতাসে বিষ না দেখি উপায়।
ক্ষমা কর চন্দ্রাবতী ধরি তোমার পায়। ।
একবার দেখিব তোমায় জন্মশেষ দেখা।
একবার দেখিব তোমার নয়নভঙ্গি বাঁকা। ।
একবার শুনিব কন্যা মধুরসবাণী।
নয়নজলে ভিজাইব রাঙ্গা পা দুইখানি। ।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
পুণ্যমুখ দেখ্যা আমি জুড়াইব অন্তরা। ।
শিশুকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের মালা।
তোমারে দেখিতে কন্যা মন হইল উতালা।
।
জলে ডুবি বিষ খাই গলায় দেই দড়ি।
তিলেক দাড়াইয়া তোমার চান্দমুখ হেরি। ।
ভাল নাহি বাস কন্যা এই পাপিষ্ঠ জনে।
জন্মের মতন হইলাম বিদায় ধরিয়া চরণে। ।
এই দেখা চক্ষের দেখা এই দেখা শেষ।
সংসারে নাহিক আমার সুখশান্তির লেশ। ।
একবার দেখিয়া তোমার ছাড়িব সংসার।
কপালে লেখ্যাছে বিধি মরণ আমার। । ”
পত্র পড়ি চন্দ্রাবতী চক্ষের জলে ভাসে।
শিশুকালের স্বপ্নের কথা মনের মধ্যে আসে।
।
এক বার দুই বার তিন বার করি।
পত্র পড়ে চন্দ্রাবতী নিজ নাম স্মরি। ।
নয়নের জলে কন্যার অক্ষর মুছিল।
এক বার দুই বার পত্র যে পড়িল। ।
“শুন শুন বাপ আগো শুন মোর কথা।
তুমি সে বুঝিবে আমি দুঃখিনীর ব্যথা। ।
জয়ানন্দ লেখে পত্র আমার গোচরে।
তিলেকের লাগ্যা চায় দেখিতে আমারে। । ”
“শুন গো প্রাণের কন্যা আমার কথা ধর।
একমনে পূজ তুমি দেও বিশ্বেশ্বর।
।
অন্য কথা স্থান কন্যা নাহি দিও মনে।
জীবন মরণ হইল যাহার কারণে। ।
নষ্ট হইল পুজার ফুল ছুঁইল যবনে।
না লাগে উচ্ছিষ্ট ফল দেবের কারণে। ।
আছিল গঙ্গার জল অপবিত্র হইল।
বিধাতা সাধিছে বাদ সব নষ্ট হইল। ।
তুমি যা লইছ মাগো সেই কাজ কর।
অন্য চিন্তা মনে স্থান নাহি দিও আর। ।
পত্র লিখি চন্দ্রাবতী জয়ের গোচরে।
পুষ্পদূর্ব্বা লইয়া কন্যা পশিল মন্দিরে।
যোগাসনে বসে কন্যা নয়ন মুদিয়া।
একমনে করে পূজা ফুলবিল্ব দিয়া। ।
শুকাইল আঁখির জল সর্ব্ব চিন্তা দূরে।
একমনে পূজে কন্যা অনাদি শঙ্করে।
।
কিসের সংসার কিসের বাস কেবা পিতামাতা।
পূজিতে তুলিল কন্যা শৈশবের কথা।
জয়ানন্দ চুলি কন্যা পূজয়ে শঙ্করে।
একমনে ভাবে কন্যা হর বিশ্বেশ্বরে।
শান্তিতে আছয়ে কন্যা একনিষ্ঠ হইয়া।
আসিল পাগল জয়া শিকল ছাড়িয়া। ।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী তোমারে শুধাই।
জীবনের শেষ তোমায় একবার দেখ্যা যাই।
।
আর না দেখিব তোমায় নয়ন চাহিয়া।
দোষ ক্ষমা কর কন্যা শেষ বিদায় দিয়া। । ”
কপাটে আঘাত করে শিরে দিয়া হাত।
বজ্রের সমান করে বুকেতে নির্ঘাত। ।
যোগাসনে আছে কন্যা সমাধিশয়নে।
বাহিরের কথা কিছু নাহি পশে কানে। ।
পাগল হইয়া নাগর কোন কাম করে।
চারিদিকে চাহিয়া দেখে নাহি দেখে কারে। ।
না খোলে মন্দিরের কপাট নাহি কয় কথা।
মনেতে লাগিল যেমন শক্তিশেলের ব্যথা।
।
পাগল হইল জয়ানন্দ ডাকে উচ্চৈস্বরে।
“দ্বার খোল চন্দ্রাবতী দেখা দেও আমারে। ।
না ছুঁইব না ধরিব দূরে থাক্যা খাড়া।
ইহজন্মের মতন কন্যা দেও মোরে সাড়া। ।
দেবপূজার ফুল তুমি গঙ্গার পানি।
আমি যদি ছুই কন্যা হইবা পাতকিনী। ।
নয়ন ভরে দেখ্যা যাই জন্মশোধ দেখা।
শৈশবের নয়ান দেখি নয়ানভঙ্গি বাঁকা। । ”
না খোলে মন্দিরের দ্বার মুখে নাহি বাণী।
ভিতরে আছরে কন্যা যৈবনে যগিনী।
।
চারি দিকে চাইয়া নাগর কিছু নাহি পায়।
ফুট্যাছে মালতীফুল সামনে দেখতে পায়। ।
পুষ্প না তুলিয়া নাগর কোন কাম করে।
লিখিল বিদায়পত্র কপাট উপরে।
“শৈশবকালের সঙ্গী তুমি যৈবনকালের সাথী।
অপরাধ ক্ষমা কর তুমি চন্দ্রাবতী। ।
পাপিষ্ঠ জানিয়া মোরে না হইলা সম্মত।
বিদায় মাগি চন্দ্রাবতী জনমের মত। । ”
ধ্যান ভাঙ্গি চন্দ্রাবতী চারিদিকে চায়।
নির্জন অঙ্গন নাহি কারে দেখতে পায়। ।
খুলিয়া মন্দিরের দ্বার হইল বাহির।
কপাটে আছিল লেখা পড়ে চন্দ্রাবতী।
(এই লাইনটি নেই)
অপবিত্র হইল মন্দির হইল অধোগতি।
কলসী লইয়া জলের ঘাটে করিল গমন।
করিতে নদীর জলে স্নানাদি তর্পণ।
।
জলে গেল চন্দ্রাবতী চক্ষে বহে পানি।
হেনকালে দেখে নদী ধরিছে উজানি। । **
একেলা জলের ঘাটে সঙ্গে নাহি কেহ।
জলের উপরে ভাসে জয়ানন্দের দেহ। ।
দেখিতে সুন্দর নাগর চান্দের সমান।
ঢেউয়ের উপর ভাসে পুন্নুমাসীর চান। ।
আঁখিতে পলক নাহি মুখে নাই সে বাণী।
পারেতে খাড়াইয়া দেখে উমেদা কামিনী। । ***
স্বপ্নের হাসি স্বপ্নের কান্দর নয়ান চান্দে গায়।
নিজের অন্তরের দুষ্কু পরকে বুঝান দায়।
।
* জন্মথ : আজন্ম আইবড়
** ধরিছে উজানি : উজান বয়ে চলছে
*** উমেদা : উন্মত্ত ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।