আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘মুরগীর উপরে হাতির নাচন’

চাই শুধু নিরবিচ্ছিন্ন নিরপত্তা নিজেকে বিকশিত করার জন্য। । মাহবুব মিঠু। । মনে হচ্ছে রাজনীতিতে সংঘাত অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

বিদেশে শেখ হাসিনার শান্তির মডেল উপস্থাপন এবং সমসাময়িক সময়ে জোটবদ্ধ বিরোধী দলের সাথে আলোচনায় না বসার ইঙ্গিত এ বছরের শ্রেষ্ট কৌতুক বলে স্বিকৃতি পাবে নিশ্চয়। নিজের দেশ এবং জনগণকে জলন্ত উনোনের উপরে রেখে বিদেশে শান্তির ফেরী করা সত্যি হাস্যকর। তিনি বলেছেন, রাজাকারদের সাথে বিএনপি জোট বাধায় তার পক্ষে আলোচনায় বসা সম্ভব না। দায়িত্বের চাপে তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, কয়েক বছর আগেও বিএনপিকে হঠাতে রাজাকারদের সাথে নিজের এবং দলের অনেক বড় নেতার কি সখ্যতাই না ছিল। এখনো পুরানো পত্রিকা ঘাটলে কিংবা জামাত শিবিরের বদৌলতে ইন্টারনেটে ঢু মারলেই আপনারা দ্বিতীয় জোকসটা পেয়ে যাবেন।

ভূতের মুখে রাম নাম শুনতে মাঝে মাঝে ভালই লাগে। অসহনীয় নাগরিক কষ্টের মধ্যেও একটুখানি হেসে নেয়া যায়। নিজ দেশে রাজনৈতিক অনৈক্য, বিভাজিত জাতি, অপহরণ, গুপ্ত হত্যা, পুলিশী নির্যাতন, আইন বহির্ভূত হত্যা এবং যার সব কটির সংগে সরকারের মদদ জড়িত সেখানে সেই সরকারের প্রধান গিয়েছেন বিশ্বের দরবারে শান্তির বারতা নিয়ে। গত ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০১১ দলীয় অফিসের সামনে চার দলীয় জোটের মহাসমাবেশটা ছিল আরো একটা বড় কৌতুক। কয়েক বছর আগে যারা বিএনপিকে গলা ধাক্কা দিয়ে নামাতে আওয়ামিলীগের সংগে গাট বেধেছিল, তারাই এখন প্রধান মিত্র।

সবচেয়ে নির্মম কৌতুকটি হচ্ছে, মুক্তিযোদ্ধা খোকা সাহেব এবং শিবিরের সভাপতির একই মঞ্চে অবস্থান এবং বক্তৃতা দেয়া। এই খোকাই স্বাধীনতার সময় ঢাকাকে শত্রুমুক্ত করতে নেতৃত্বে ছিলেন। স্বাধীনতার প্রায় চল্লিশ বছর পরে সেই খোকার হাত ধরেই একই চক্র এবার পতনের খাদের কিনার থেকে সামনে এসে দাড়াল। এতো সব কৌতুকের বাইরে ভয়াবহ খবর হচ্ছে, সমাবেশের মাধ্যমে বুঝা গেল সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে ফাইনাল রাউন্ড মুখোমুখী হওয়া এখন সময়ের ব্যপার শুধু। ক্ষমতার শান্তিপূর্ণ পালা বদলের ধৈর্য যেমন বিরোধী দলের নেই, তেমনি ক্ষমতা ছেড়ে দেবার কোন সদ ইচ্ছেও কেন জানি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোন কালেই ছিল না।

ক্ষমতায় এসে প্রথম দু/তিন বছর ’যেমন ইচ্ছা তেমন সাজোর’ মতো সরকারী দল যা ইচ্ছা তাই করবে। এরপরে শুরু হবে সরকার এবং বিরোধী দলের মধ্যে ভয়ানক লড়াই। ক্ষমতার পট পরিবর্তনের একই ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে বেশ কয়েক দশক ধরে। চিরাচরিত ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা বজায় রাখার যুদ্ধের মৌসুম শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান সরকার খুব বেশী সাফল্য দেখাতে না পারলেও জনগণ কিছুটা গা সওয়া হয়ে গিয়েছিল অনিয়ম এবং ভোগান্তিতে।

কিন্তু ক্ষমতাকে ’চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ করার জন্য পরিবেশ তৈরী হবার আগেই তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়ে সরকার বিরোধী দলের হাতে মোক্ষম একটা অস্ত্র তুলে দিয়েছে। বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ মিছিলে বাধা, পুলিশ এবং দলীয় লোক দ্বারা নির্যাতন ইত্যাদির মাধ্যমে আন্দোলনকে গতি দেওয়া হয়। দ্রব্য মূল্যের সীমাহীন বৃদ্ধি, অপহরন এবং গুপ্তহত্যা, পুলিশ এবং র্যা বকে মাত্রাতিরিক্তভাবে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার এবং এদের দ্বারা জন নিরাপত্তাকে হুমকীর মধ্যে ফেলে দিয়ে আন্দোলনের প্রতি একটা নিরব জন সমর্থন তৈরী হয়েছে। নিবর্তনের এই ধারা যদি পরবর্তীতে বিরোধী দল ক্ষমতায় এসে অব্যাহত রাখে তাহলে কি অবস্থা হবে ভাবলেই আতংকিত হবার কথা। একটা সংগঠিত অস্ত্রধারী বাহিনী রাষ্ট্রের ছত্রছায়ায় থেকে বারবার দলীয় উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবার কারনে ধীরে ধীরে জনগণ এদের সহজ এবং নিরাপদ শিকারে পরিণত হয়েছে।

এটা আমাদের ভাগ্যের লিখন যে, যাদের নিরাপত্তা দেবার কথা, ইতিহাস বলে তাদের দ্বারাই জনগণ নিপীড়িত হয়েছে সবচেয়ে বেশী। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে নিপীড়নের এই সংস্কৃতি উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গিয়েছে। গাছের আপেল খাওয়ার মতো পুলিশ রাস্তা থেকে যাকে তাকে ধরে বড় সন্ত্রাসী বানিয়ে নির্যাতন করছে। উদ্দেশ্য একটাই টাকা খাওয়া। দেখার কেউ নেই।

এর বাইরে, একদিকে জামাত শিবিরের নাক বের করে উপরে ওঠার চেষ্টা অন্যদিকে যুদ্ধপরাধী বিচার নিয়ে সরকারের সন্দেহজনক আচরণ সংঘাতের একটা নতুন মাত্রা যোগ করেছে। সরকারের ততপরাতায় মনে হয় না যে তারা যুদ্ধপরাধীদের বিচার চায়। শুরুতেই দুটো বিষয়কে কেন্দ্র করে সরকার যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছেন। প্রথমত: ট্রাইবুনালের স্বচ্ছতা এবং বিশেষ করে একজন বিচারপতিকে নিয়ে বিতর্ক। দ্বিতীয়ত: যুদ্বপরাধী সনাক্তকরণ প্রক্রিয়ায় রয়েছে বিশাল আকারের পক্ষপাতিত্ব।

নিজ দলের অপরাধী এবং আত্নীয়দের অভিযোগের বাইরে রাখায় পুরো বিচার প্রক্রিয়াটাই কলুষিত হয়ে পড়েছে। জামাত যেমন ইসলামকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে অবস্থান পোক্ত করতে চায়, একইভাবে এখন আ:লীগ যুদ্ধপরাধীদের বিচারের নামে বিরোধী দল নিপীড়নে নেমেছে। সরকারের কিছু আচনরনও যুদ্ধপরাধীদের প্রতি কিছুটা হলেও জনক্ষোভ হ্রাসে সাহায্য করছে। পুলিশের বুটের নীচে জামাত কর্মীর ছবিটা বেশ মানবিক আবেদন পেয়েছে। কয়েকদিন পরেই একই দিনে পত্রিকায় দুটো ছবি জনমনে প্রশ্ন উদ্রেক করেছে।

জামাত নেতা আজহার এবং তাসনিমকে হ্যান্ডকাফ এবং ডান্ডাবেরী পরিয়ে আদালতে হাজির করা হয়। এই ছবিটির নিচে আরেকটি ছবিতে দেখা গেলো সাঈদীকে স্বাভাবিকভাবে ট্রাইবুনালে হাজির করা হয়েছে। ছবি দুটো অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। যে কিনা মানবতাবিরোধী অপকর্মের সংগে জড়িত তাকে স্বাভাবিকভাবে ট্রইবুনালে হাজির করা হলে কোন প্রেক্ষিতে বাকী দুজন জামাত নেতাকে হ্যান্ডকাফ এবং ডান্ডাবেরী পড়ানো হলো সেটা একটা রহস্য। বুটের ছবি ব্যবহার করে জামাত শিবির যেমন সহানুভূতি পাবার চেস্টা করেছে, এবারও সেটা করছে এবং করবে।

এভাবে কেন যে আমরা অতি বাড়াবাড়ি করে বারবার ঘরের ফসল শত্রুর হাতে তুলে দেই কে জানে। জোটের সমাবেশে বিরোধী নেত্রী একটা প্রশ্ন তুলেছেন। জামাত যেহেতু নিষিদ্ধ দল নয় তাই তাদের মিছিল মিটিং এ সরকারের বাধা দেবার কোন এক্তিয়ার নেই। কথাটার একটা আইনগত বৈধতা আছে। কিন্তু তিনি চেপে গেছেন যে, জামাতের মিছিলটা ছিল জঙ্গী মিছিল এবং সেখানে বিনা উস্কানীতে পুলিশের উপরে হামলা চালানো হয়।

সঠিক সময়ে যুদ্ধপরাধীদের বিচার না করে ক্ষমা করার ফলে আজ কি অনভিপ্রেত কথা শুনতে হলো বিরোধী নেত্রীর মুখ থেকে। শিবিরের রাজনীতি আইনত: নিষিদ্ধ নয় সে কথা ঠিক। কিন্তু যে দল একাত্তরের যুদ্ধপরাধী নিয়ে গড়া এবং যারা এখনো স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকান্ডের সংগে জড়িত তাদের সাথে নিয়ে আন্দোলনে যাওয়া কতোটুকু নৈতিক সেটা জনগন জানতে চায়। একটা স্বিদ্ধান্ত এখন নিতেই হবে জামাতের রাজনীতি করা বিষয়ে। জনগণের মতামতের ভিত্তিতে সর্বদলীয়ভাবে স্বিদ্ধান্ত নেবার সময় এসেছে যে, শুধু কি যুদ্ধপরাধীদের বিচার আমাদের উদ্দেশ্য নাকি জামাত শিবিরের রাজনীতিও নিষিদ্ধ করা দরকার।

যদি তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হয় তবে সেটা কিসের ভিত্তিতে হবে সেটাও বের করতে হবে। এই গোষ্ঠী স্বাধীনতার বিরোধীতাকারী এই যুক্তিটাই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু এতো সরল যুক্তি দিলে নাম পাল্টিয়ে তারা পুরানো খেলায় মেতে উঠবে একই কায়দায়। এই জটিল প্রশ্নের সমাধান না করে বারবার ছোটবেলার ইংরেজী পড়ার মতো কঠিন অংশটুকু বাদ দিয়ে পড়ার মতো এড়িয়ে থাকা যাবে না। তাহলে ইস্যুটি বারবার সামনে এসে চোখে কাটা হয়ে বিধবে।

সমাবেশের আরেকটি কথা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। খালেদা জিয়া বিশ্বকে অনুরোধ করেছেন, র্যা ব এবং পুলিশকে ট্রেনিং না দেবার জন্য। সাথে সাথে আরো বলেছেন, যারা নিজ দেশের জনগণকে নির্যাতন করে তাদের যেন জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে না নেয়া হয়। এর মাধ্যমে তিনি জনগণের মনের কথাই তুলে ধরেছেন। কিন্তু তিনি একটা কথা এড়িয়ে গেছেন যে, কালো পোশাকের এই র্যা ব সৃষ্টি তাদের আমলেই।

তখনো তারা বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করতো। এ্যামনেষ্টির আবেদনের পরে আশংকা ব্যক্ত করে আমি আগের একটা লেখায় বলেছিলাম, পুলিশকে জনগনকে নির্যাতন করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নচেত খুব শীঘ্রই জাতিসংঘের মিশনে তাদের না নেবার দাবী উঠবে। বিরোধী দলের নেত্রীর মুখ থেকে কথাটা আসায় আমার আশংকাই সত্য প্রমাণিত হলো। বিগত কয়েক সপ্তাহের রাজনৈতিক গতি প্রবাহ এবং বিশেষ করে শেষ হওয়া জোটের সমাবেশ থেকে একটি কথাই বুঝা গেল ভবিষ্যত দিনগুলি বাঙলাদেশের মোটেও ভাল যাবে না।

বিএনপি বলে দিয়েছে তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচন নয়। ওদিকে একদিন পরে আ: লীগের সাধারন সম্পাদক বলেছেন, না, নির্বাচন তাদের অধীনেই হবে। কোন আলোচনা ছাড়াই আ:লীগ বর্তমান দুই নির্বাচন কমিশিনারের মেয়াদ শেষে নিজের ইচ্ছামতো দুই জন কমিশনার নিয়োগ দিতে যাচ্ছে। জেনে বুঝে এমন প্রহসনের নির্বাচনে যাওয়াটা তো অর্থহীন। বিরোধী দলের সমাবেশের প্রতুত্তরে সরকারী দল এবং তাদের মহাজোট শো ডাউন করতে যাচ্ছে অচিরেই।

দুই দলের এই গুতোগুতির ফাকে তাদের বগলের নীচে জামাতের তেল মাখানো মাথা উকিঝুকি মারছে। যে কোন সময় সুরুত করে সামনে চলে আসবে। একদিকে ক্ষমতা দখল এবং ক্ষমতা আকড়ে থাকার লড়াই অন্যদিকে জামাত শিবিরের টিকে থাকার লড়াই- সব মিলিয়ে আগামীতে ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে জাতির সামনে। ব্যতিক্রম কিছু না ঘটলে ভয়াবহ সংঘাত অনিবার্য। অনেকেই টেসের ’হোয়েন দ্যা এ্যালিফ্যান্ট ড্যান্স’ উপন্যাসটা পড়ে থাকবেন।

এটা উনার প্রথম উপন্যাস কিন্তু বেশ জনপ্রিয়তা পায়। উনি একজন ফিলিপিনো আমেরিকান। ২য় মহাযুদ্ধে তার বাবার অভিজ্ঞতার উপরে ভিত্তি করে লেখা এই উপন্যাসটি। টাইটেলের হাতি হচ্ছে আমেরিকা এবং জাপান এবং মুরগী হচ্ছে অসহায় ফিলিপিনো অধিবাসীরা। লেখিকার বাবা যুদ্ধের ফলাফল বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলে When the েহােয়ন দ্যা এিলফ্যান্ট ড্যান্স, দ্যা Wচিকেন মাষ্ট বি কেয়ারফুল’ উপন্যাসের জাপান আমেরিকার মতো বড় দুই দলের ক্ষমতার মসনদ দখলের লড়াই এবং সেই সংগে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির জঙ্গীবাদ বিস্তারের চেষ্টার জাতাকলে জনগণ পিষ্ট হতে যাচ্ছে আবারো।

পুনশ্চ: এতো সব জেনেও জনগণ মুরগী হবার জন্য প্রস্তুত। এ কারনেই দু’দলের জনসভায় কখনো লোকের কমতি হয় না। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।