আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশবান্ধব কিনা প্রশ্ন উঠেছে : যাচাইবাছাই ছাড়াই বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে

[img|http://media.somewhereinblog.net/images/thumbs/masudalom_1316669823_1-smithville.jpg বাংলাদেশে বনায়নের নামে কোনো প্রকার যাচাইবাছাই ছাড়াই পরিবেশের অনুপযোগী বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে। এতে পরিবেশের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির পাশাপাশি দেশের জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, গাছ লাগাতে উত্সাহ দেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ভুল স্লোগানের কারণে দেশবাসী বিদেশি গাছের দিকে ঝুঁকেছে। সরকারের পক্ষ থেকে কখনই বলা হয় না ‘বেশি করে দেশি গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। জাতীয় পরিবেশ নীতি-১৯৯২ এখনও অনুসৃত হচ্ছে।

কিন্তু এই নীতিমালার কোথাও দেশি গাছ লাগিয়ে জীববৈচিত্র্য রক্ষার কথা বলা হয়নি। সঙ্গত কারণেই দেশের জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের প্রক্রিয়া থেমে নেই। ইউক্যালিপটাসের সর্বনাশা আগ্রাসনের পর এবার লাগানো হচ্ছে পাউলোনিয়া নামের আরও ক্ষতিকর গাছ। বাংলাদেশের একটি প্রতিষ্ঠান চীন থেকে এই গাছটি আমদানি করে দেশে বনায়নের একটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। গাছগুলো লম্বায় ১০ থেকে ২৫ মিটার হতে পারে।

ইংরেজিতে এই গাছকে প্রিন্সেস ট্রি, ফক্সগ্লোভ ট্রি, রয়্যাল ট্রি নামেও ডাকা হয়। হৃদয়াকৃতির পাতা, ফুলগুলোও দেখতে সুন্দর। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) দেয়া তথ্যমতে, ১৮৪০-এর দশকের দিকে সৌন্দর্য বর্ধনশীল বৃক্ষ হিসেবে এটি সেখানে যায়। কিন্তু সেই বৃক্ষই আজ আমেরিকার শত্রু। ইউএসডিএ এর মধ্যেই একে ‘বিষাক্ত আগাছা বৃক্ষ’ বলেছে।

আর নিউ ইংল্যান্ডের বৃক্ষপ্রজাতির মধ্যে এটি একমাত্র গাছ, যেটি আগ্রাসী হিসেবে তালিকাভুক্ত। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরাও এটাকে ইনভেসিভ প্ল্যান্ট (আগ্রাসী উদ্ভিদ) বলে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাসান বলেন, পরিবেশের ওপর একেক গাছের একেক ধরনের প্রভাব পড়ে। আমাদের নিজস্ব পরিবেশের উপযোগী গাছ লাগানোর পরামর্শ সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে সরকারকে দেয়া হয়। কিন্তু কেন যে তা কোনো সরকারই মানে না, তা বুঝতে পারি না।

তিনি বলেন, গাজীপুর অঞ্চলটা একবার ঘুরে এলে বোঝা যায়, যে কোনো আগ্রাসী প্রজাতির গাছ স্থানীয় জীববৈচিত্র্য, খাদ্যশৃঙ্খল আর আন্তঃপ্রজাতিক সম্পর্কের বারোটা বাজিয়ে দেয়। কারণ, ইউক্যালিপটাসের কারণে আমাদের দেশীয় প্রজাতির গাছ ঠিকমতো বেড়ে উঠতে পারছে না। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীমউদ্দিন বলেন, একটি গাছ আমাদের জীববৈচিত্র্যের সহায়ক কিনা, আগে তা নিশ্চিত হওয়া দরকার। আমরা এমনিতেই ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি নামের বিদেশি গাছ লাগিয়ে বিতর্কের জন্ম দিয়েছি। তিনি বলেন, আমি মনে করি, যে কোনো বিদেশি প্রজাতি (উদ্ভিদ অথবা প্রাণী) আমদানির আগে অবশ্যই নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নেয়ার ক্ষমতা, বাস্তুসংস্থানের ওপর এর প্রভাব বিবেচনা এবং প্রয়োজনবোধে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করতে হয়।

পাউলোনিয়া গাছ আমদানির কথা শোনা যাচ্ছে। আমদানির আগে এ গাছটি আমাদের জীববৈচিত্র্যের অনুকূল হবে কিনা, সেটা নিশ্চিত হতে হবে। তিনি বলেন, মাটি, পানি, আলো, বাতাস ও পরিবেশের উপাদানে ব্যবধান থাকার কারণে বিশ্বের সব অঞ্চলে সব ধরনের গাছ লাগানো যায় না। কারণ, স্থানীয় যে সব গাছে যে সব প্রাণী বাস করতে পারে, সেসব প্রাণী প্রাকৃতিকভাবেই সেখানে আবির্ভূত হয়। আবার সব গাছে সব পাখি বাসা বাঁধে না, সব গাছের ফল সব প্রাণীও খায় না।

তাই পৃথিবীর যেখানে যে ধরনের গাছ জন্মে সেখানে ঠিক সেই ধরনের প্রাণীরই আবির্ভাব হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের (বিইজেএফ) চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘বেশি করে গাছ লাগান পরিবেশ বাঁচান’ এই ভুল স্লোগানের পরিবর্তে ‘বেশি করে দেশি গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’ দিতে হবে। কারণ দেশি বনাঞ্চল ধ্বংস করে বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায় বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকায় বন বিভাগ সামাজিক বনায়নের নামে ব্যাপক হারে বিদেশি গাছ লাগাচ্ছে। এসব বিদেশি গাছের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ইউক্যালিপটাস, একাশিয়া, মেহগনি, শিশু ও সেগুন। ভুল প্রচারণায় উত্সাহিত হয়ে ব্যক্তি পর্যায়েও প্রচুর বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে।

ব্রিটিশরা এক সময় বাণিজ্যিক স্বার্থে শালবন তৈরি করেছিল। তাদের সংরক্ষিত বনায়ন দরকার ছিল। কিন্তু সেই ধারাবাহিকতার বাইরে পা দিতে পারেনি আমাদের স্বাধীন সরকারগুলো। তাই ব্রিটিশরা চলে যাবার পরও এ পর্যন্ত যত প্রকার সংরক্ষিত বনায়ন হয়েছে সেখানে দেশি গাছের চেয়ে বিদেশি গাছ বেশি লাগানো হয়েছে। বিইজেএফ চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশে এখন যে পরিমাণ বন আছে তার আশি ভাগই সংরক্ষিত বনায়ন, যেগুলো আসলে বনই নয়।

এতে জীববৈচিত্র্য তো দূরের কথা জীবই থাকে না। তিনি দেশের উপকূল, উত্তরাঞ্চল ও সিলেটের হাওড় এলাকায় দেশীয় জীববৈচিত্র্যের উপযোগী গাছ লাগানোর পরামর্শ দেন। এদিকে ওয়েবসাইটে পাওয়া একাধিক তথ্যে দেখা যাচ্ছে, পাউনোলিয়াকে ‘মোস্ট হ্যাটেড প্ল্যান্ট’ (সবচেয়ে ঘৃণিত উদ্ভিদ) আখ্যা দিয়ে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি পাইনোলিয়া গাছ থেকে বছরে দুই কোটি বীজ বাতাস, পানি ও প্রাণির সাহায্যে দুই মাইল দূরেও সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই আগ্রাসী গাছের বিস্তার থামিয়ে দেয়ার কোনো প্রাকৃতিক পদক্ষেপ নেই। এটির গভীর মূল মাটি থেকে এতো বেশি পরিমাণ নাইট্রেট, পানি ও অন্যান্য পুষ্টি উপাদান শুষে নিতে পারে, যা আশপাশের গাছের জন্য ভয়াবহ পরিণাম ডেকে আনে।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের সড়কের দুই ধারে লাগানো গাছের প্রায় ৯৯ শতাংশ হলো এসব বিদেশি গাছ। বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্য হ্রাসের এটিও অন্যতম কারণ। বিদেশি গাছে আমাদের পাখি ও প্রাণিরা থাকতে পারে না বলেই তারা ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, দেশি গাছের বদলে বিদেশি গাছ দিয়ে কোনো এলাকা ছেয়ে ফেললে সে এলাকার প্রাণীকুলের খাদ্যের উত্স ও আবাস ধ্বংস হয়, পরিণামে তারা সেখান থেকে বিলুপ্ত হয়। তার মতে, বনায়নের নামে সারা বাংলাদেশে বিদেশি গাছেকে ছড়িয়ে দেয়া মোটেও ঠিক হচ্ছে না।

বন আর বনায়ন এক জিনিস নয়। গাছ লাগিয়ে বন তৈরি করা যায় না। বন প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠে। রাজধানীর দিকে তাকালেও এখন বিদেশি গাছের আগ্রাসন দেখা যায়। বিমানবন্দর থেকে বনানী, মহাখালী, জাহাঙ্গীর গেট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের সড়ক পার হয়ে বিজয় সরণি, ফার্মগেট, মানিক মিয়া এভিনিউ ধরে নগরীর সব জায়গায় যে সব গাছ লাগানো হচ্ছে, তার শতভাগই বিদেশি।

কোথাও দেশজ ও ফলজ উদ্ভিদ লাগানো হয়নি। বরং সৌন্দর্য বাড়ানোর নামে সড়কের পাশের দেশীয় বয়সী গাছগুলো কেটে ফেলা হচ্ছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ১৪ মিলিয়ন হেক্টরের মধ্যে বনভূমি আছে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন হেক্টর। গাছপালা আছে এক-তৃতীয়াংশ বনভূমিতে, বাকিটা বিরান। আবার এর মধ্যে রয়েছে ০.২৭ মিলিয়ন হেক্টর গ্রামীণ বন।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.