আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিডনি বেচাকেনা ও বাস্তবতা

আতাউর রহমান কাবুল আতাউর রহমান কাবুল ইমেইল : সাম্প্রতিক সময়ে কিডনি বেচাকেনার সঙ্গে জড়িত বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর এটি ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। প্রশাসনসহ চিকিত্সক মহলকেও বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে। গত বৃহস্পতিবার কিডনি বেচাকেনা চক্রের সঙ্গে জড়িত জনৈক আজমকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেফতার করেছে ডিবি পুলিশ। পরে জানা যায়, এই আজম দীর্ঘদিন যাবত অবৈধভাবে কিডনি বেচাকেনা করে আসছিল, সে-ই এ চক্রের মূল হোতা। এর আগে গত ২৮ আগস্ট জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের আবদুস ছাত্তার (৪০), গোলাম মোস্তফা (৩৭) এবং আবদুল করিম ওরফে ফোরকান (৩৫) নামে কিডনি বেচাকেনা চক্রের চার দালালকে আটক করে পুলিশ।

এছাড়াও গত ৬ সেপ্টেম্বর বাগেরহাট জেলা থেকে সাইফুল মোল্লা নামে আরেক দালালকে আটক করা হয়। এরা পুলিশকে জানায়, তারা বহুদিন ধরে এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। কিন্তু আসলেই কি একজন চাইলেই আরেকজনের প্রয়োজনে কিডনি বিক্রি করতে পারে? এটা কি বিক্রয়যোগ্য বিষয়? এই বিষয়গুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাই বা কী? এ নিয়েই আমাদের অনুসন্ধানী মূল প্রতিবেদন। অঙ্গ সংযোজনের ইতিবৃত্ত বিংশ শতাব্দীর একটি বিস্ময়কর চিকিত্সাপদ্ধতি মানবদেহে অঙ্গ সংযোজন। এর মাধ্যমে লাখ লাথ মরণাপন্ন মানুষের জীবন দীর্ঘায়িত করা ছাড়াও জীবনযাত্রার মান উন্নত করা সম্ভব হয়েছে।

মানবদেহে কিছু অত্যাবশ্যক অঙ্গ (ঠরঃধষ ঙত্মধহ) আছে, এর যে কোনো একটির কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেললে বা নষ্ট হয়ে গেলে জীবনাবসান অবধারিত। যেমন : ফুসফুস, হৃিপণ্ড, কিডনি, যকৃত্, অগ্ন্যাশয়, বোনম্যারো ইত্যাদি। তাই চিকিত্সা বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এসব বিকল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংযোজনে মুমূর্ষু রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার এক যুগান্তকারী চিকিত্সা পদ্ধতি ট্রান্সপ্লান্ট বা সংযোজন। ১৯৫৪ সালে সর্বপ্রথম এক যমজ মানবসন্তানের কিডনি অপরজনের শরীরে সফল সংযোজনের মাধ্যমে পৃথিবীতে শুরু হয় কিডনি সংযোজনের পদযাত্রা। কিডনি সংযোজন সাধারণত দু’ভাবে করা যায়: মৃত ব্যক্তির কিডনি নিয়ে সংযোজন এবং নিকটাত্মীয়ের যে কোনো একটি কিডনি নিয়ে সংযোজন।

পরিসংখ্যানে দেখা যায়, জীবিত আত্মীয়ের কিডনি সংযোজিত ব্যক্তিদের এবং ক্যাডাভারিক (মরণোত্তর) অরগান সংযোজক ব্যক্তিদের এক বছর বেঁচে থাকার হার যথাক্রমে ৯৫ এবং ৮৮ ভাগ। কিন্তু পাঁচ বছর বেঁচে থাকার হার প্রায় ৮৭ ভাগ। কিডনি সংযোজনের শর্ত দাতা হিসেবে একজন সম্পূর্ণ সুস্থ ব্যক্তি স্বেচ্ছায় তার কোনো নিকটাত্মীয়, যার দুটো কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে, তাকে একটি কিডনি দান করতে পারেন। এই কিডনি সংযোজনকে জীবিত নিকটাত্মীয়ের মধ্যে কিডনি সংযোজন বা লাইফ রিলেটেড কিডনি প্রতিস্থাপন বলা হয়। কিডনি দেয়ার আগেই তাদের রক্তের গ্রুুপ ও টিস্যু টাইপ পরীক্ষা করিয়ে নেয়া হয়।

যখন দেখা যায়, কোনো আত্মীয় দাতার সঙ্গে রোগীর মিল আছে, তখন আত্মীয় কিডনিদাতার সব রকম পরীক্ষা করা হয়। কিডনিদাতার বয়স অবশ্যই ১৮ বছর, অর্থাত্ এইজ অব কনসেন্টের ওপর বা ৬০ বছরের নিচে হতে হবে। তার ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার ও কিডনি রোগ থাকা চলবে না এবং দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ ভালো থাকতে হবে। মানবদেহ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইনে যা আছে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে গত এপ্রিল ১৯৯৯ ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯’ নামে একটি আইন পাস করা করা হয়। এতে বলা হয়েছে, সুস্থ ও সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন যে কোনো ব্যক্তি তার দেহের এমন কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যা বিযুক্তির কারণে তার স্বাভাবিক জীবন-যাপনে ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা নেই তা কোনো নিকটাত্মীয়ের দেহে সংযোজনের জন্য দান করতে পারবেন।

এখানে ‘অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ’ অর্থ মানবদেহের কিডনি, হৃিপণ্ড, যকৃত, অগ্নাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চক্ষু, চর্ম ও টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গ বোঝানো হয়েছে। ১৮ বছরের কম ও ৬৫ বছরের বেশি বয়সের কোনো ব্যক্তি অঙ্গ দান করতে পারবেন না। তবে রিজেনারেটিভ টিস্যুর ক্ষেত্রে দাতা ও গ্রহীতা ভাই-বোন সম্পর্কের হলে এ শর্ত কার্যকর হবে না। আর গ্রহীতাকে ২ থেকে ৭০ বছর বয়সের মধ্যে হতে হবে। এদের মধ্যে ১৫ থেকে ৫০ বছরের ব্যক্তিরা অগ্রাধিকার পাবেন।

কিডনির ক্ষেত্রেও নিজ ইচ্ছায় কেবল মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে কিডনি দান করতে পারবেন। এদের মধ্যে কিডনি না পাওয়া গেলে আপন চাচা, মামা, ফুফু অথবা খালা কিডনি দিতে পারবেন। এর বাইরে কেউ কাউকে কিডনি বা অন্যান্য অঙ্গ দান করতে পারবেন না। তাছাড়া একজন কিডনিদাতার উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস বা কিডনিতে অন্য কোনো ধরনের অসুখ থাকা চলবে না। তার দুটি কিডনিই সুস্থ থাকতে হবে এবং তাকে স্বেচ্ছায় কিডনি দান করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।

আইনে বলা হয়েছে, মানব দেহের যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ক্রয়-বিক্রয় বা এর বিনিময়ে কোনো ধরনের সুবিধা লাভ, কিডনিদাতার ওপর কোনো ধরনে চাপ প্রয়োগ, পত্রিকায় কিংবা টেলিভিশনে সেই উদ্দেশে কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন প্রদান বা অন্য কোনোরূপ প্রচারণা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোনো ব্যক্তি এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অথবা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনি অনূর্ধ্ব সাত বছর এবং অন্যূন তিন বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। আর কোনো চিকিত্সক এই আইনের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে তিনিও বর্ণিত এ দণ্ডে দণ্ডিত হবেন এবং এছাড়াও চিকিত্সক হিসেবে তার রেজিস্ট্র্রেশন বাতিলযোগ্য হবে। এছাড়াও এ আইনে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দাতা ও গ্রহীতার রক্তের গ্রুপ ও টিস্যু টাইপসহ সব প্রয়োজনীয় তথ্য লিখে একটি রেজিস্টার সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশে কিডনি সংযোজনের প্রেক্ষাপট ১৯৮২ সালে তত্কালীন আইপিজিএমআর বর্তমানে বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল ইউনিভার্সিটি)-তে কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে দেশে প্রথম কিডনি সংযোজন শুরু হয়।

অস্ত্রোপচারের পর তিন সপ্তাহের মধ্যে রোগী সুস্থ হয়ে উঠলেও দুর্ভাগ্যক্রমে পরবর্তী দুই সপ্তাহের মধ্যে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সে রোগী মারা যায়। ১৯৮২ সালে আরও একজন রোগীর শরীরে কিডনি সংযোজন করা হয়, যিনি অস্ত্রোপচারের পর নয় মাস সুস্থ জীবনযাপন করেন। ১৯৮৮ সাল থেকে বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (সাবেক পিজি হাসপাতাল) কিডনি সংযোজন শুরু হয়েছে। ২০০৪ সাল থেকে ইব্রাহিম মেমোরিয়াল ডায়াবেটিক হাসপাতাল বা বারডেমে, ২০০৬ সাল থেকে কিডনি ফাউন্ডেশনে, ২০০৮ থেকে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনি ডিজিজেস অ্যান্ড ইউরোলজি বা নিকডু’তে কিডনি সংযোজন চলছে। এসবের পাশাপাশি বর্তমানে ইউনাইটেড হাসপাতাল, এ্যাপোলো হাসপাতাল, পপুলার হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ল্যাবএইড হাসপাতাল, আল মারকাজুল হাসপাতালে কিডনি সংযোজন হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এতে সফলতার হার শতকরা ৮০-৯০ ভাগ। বহির্বিশ্বে কিডনি বেচাকেনা ২০০৭ সালে পকিস্তান সরকার আইন করে নিষিদ্ধ করলেও পাকিস্তানের প্রত্যন্ত দরিদ্র গ্রামগুলোতে কিডনি কেনাবেচা চলে অবাধে। এক হিসেবে দেখা গেছে, পাকিস্তানে প্রতি বছর দুই হাজার কিডনি প্রতিস্থাপন হয়। এরকম প্রত্যঙ্গ বেচাকেনার হাট হিসেবে সারা দুনিয়ায় দুর্নাম কুড়ানোর কারণে ২০০৭ সালে সরকার অর্থের বিনিময়ে এ ধরণের কারবার আইন করে বন্ধ করে দেয়। এদিকে চীনেও জমজমাট হয়ে উঠেছে মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবৈধ ব্যবসা।

বিশেষ করে কিডনি। প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে চলছে নানা অঙ্গ-প্রতঙ্গের বেচাকেনা। জানা গেছে, কিডনি বিক্রেতার সিংহভাগ চরম দরিদ্র ও অভিবাসী শ্রমিক। চীনের কয়েকটি শহরে ব্যবসায়ী নেটওয়ার্কের তত্পরতা বেশি। এদের কোনোটিতে অঙ্গ বিক্রিতে ইচ্ছুকরা প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তার পাশে প্রকাশ্যে বসে থাকে।

একে কেন্দ্র করে শহরগুলোতে গড়ে উঠেছে বিশেষ পর্যটন এলাকা। অঙ্গ সংস্থাপনে আগ্রহীরা বেড়ানোর নাম করে বিক্রেতার খোঁজ করে। ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেয়ার প্রতিষ্ঠানও গজিয়েছে অনেক। অবৈধ এ ব্যবসায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারও কম নয়। ইন্টারনেটের মাধ্যমে কেনাবেচার প্রস্তাবও চলে।

এদিকে ভারতও কিডনি বেচাকেনার অন্যতম নিরাপদ ক্ষেত্র। বলা যায়, সেখানে তেমন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। কলকাতা, চেন্নাই, মাদ্রাজ, বোম্বেসহ ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে এ ধরনের অপরাধী চক্র রয়েছে। এরা বাংলাদেশ থেকেও কিডনি ক্রয়-বিক্রয় করে বলে এর আগে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। কিডনি সংযোজনে সতর্কতা ও করণীয় অনেকেরই ধারণা, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার পর রোগীর সুস্থ জীবনযাপনে আর কোনো বাধা নেই।

আসলে এ ধারণা ঠিক নয়। কারণ, কিডনি সংস্থাপনের পর কিডনিটি যাতে শরীরের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারে অর্থাত্ কিডনিটি যাতে শরীর থেকে বিয়োজিত হয়ে না যায় সেজন্য রোগীকে সারা জীবন বিশেষ কিছু ওষুধ গ্রহণ করতে হয়। এই ওষুধ গ্রহণ করা অনেকেরই সামর্থ্যের বাইরে থাকে। এতে শারীরিক নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ইচ্ছে করলেই কেউ কাউকে কিডনি দান করতে পারে না।

দেশে মরণোত্তর কিডনি সংযোজন চালু হওয়া উচিত —অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ সভাপতি কিডনি ফাউন্ডেশন ও সোসাইটি অব অরগান ট্রান্সপ্লান্ট আমার স্বাস্থ্য : কেউ ইচ্ছে করলেই কি কিডনি বিক্রি বা দান করতে পারে? অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ : কিডনি সংযোজনের জন্য যে কেউ ইচ্ছে করলেই কিডনি দান করতে পারেন না। এর সঙ্গে কিডনি দাতা ও গ্রহীতার রক্ত ও টিস্যু টাইপিং রিপোর্টের মিল থাকতে হয়। তাছাড়া ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, লিভার, কিডনি প্রভৃতি জটিল রোগ না থাকাসহ দাতার দুটো কিডনিই সম্পূর্ণ ভালো থাকতে হয়। ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯’ অনুযায়ী সরাসরি বা রক্তসম্পর্কীয় নিকটাত্মীয় হতে হয়। কিডনি বিক্রি করার তো সুযোগই নেই।

আমার স্বাস্থ্য : বাংলাদেশে সম্প্রতি গ্রেফতারকৃত কিডনি পাচারকারী চক্র ও তাদের ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী? অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ : গ্রেফতারকৃত অপরাধী চক্র মিডিয়ার সামনে যেসব তথ্য দিয়েছে তাতে আমরা রীতিমত অবাক হয়েছি। কিডনির মতো জিনিস যে বিক্রি হতে পারে এবং সেটা বিক্রির জন্য চক্র গড়ে উঠতে পারে এদেশেই, এ ব্যাপারে এর আগে আমরা এসব চিন্তাও করিনি। আমার জানা মতে, দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করা হয় বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ কর্তৃক প্রণীত ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯’-এর ধারাগুলো পরিপূর্ণভাবে মেনে, সুস্থ নিকটাত্মীয়দের কাছ থেকে কিডনি নিয়েই। এসব কিডনি সংযোজন উচ্চতর শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাসমপন্ন বাংলাদেশের বিশিষ্ট কিডনি ও ইউরোলজি ট্রান্সপ্লান্ট বিশেষজ্ঞদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। এই যেমন : কিডনি ফাউন্ডেশনে সেপ্টেম্বর ২০০৬ থেকে ৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ পর্যন্ত মোট ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় ২২০টি।

এসব কিডনি ডোনারদের মধ্যে বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী শতকরা ৭৫-৮০ ভাগ এবং আপন চাচা-মামা-খালা-ফুফু মিলিয়ে শতকরা ২০-২৫ ভাগ কিডনি দান করেছেন। মিডিয়ার মাধ্যমে দেখেছি, গ্রেফতারকৃতরা দেশের স্বনামধন্য কিছু চিকিত্সকের নাম তাচ্ছিল্যভাবে বলেছে। আমার ধারণা, তারা শুধু নাম-ই শুনেছে যে, অমুক চিকিত্সক কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করান কিংবা কিডনির চিকিত্সা করান। তারা কোনোদিন দেখেননি। কারণ আমরা কোনো রোগীর ট্রান্সপ্লান্টের ব্যাপারে সেই রোগী কিংবা তার সঙ্গে থাকা তার আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গেই প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলি।

এখানে দালাল বা অন্য কোনো লোকের সঙ্গে কথা বলার কোনো সুযোগই নেই। তাছাড়া সারা দেশে কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট চিকিত্সায় মাত্র ১৫-১৮ জন বিশেষজ্ঞ চিকিত্সক রয়েছেন। তারা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট ছাড়াও প্রতিনিয়ত নানা অপারেশনে প্রচুর ব্যস্ত সময় কাটান। তাদের পক্ষে কি এসব কাজে জড়িত থাকা সম্ভব? তাছাড়া বাংলাদেশে ট্রান্সপ্লান্ট করানো অধিকাংশ রোগীই দরিদ্র। তাদের পক্ষে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের ১-২ লাখ টাকা জোগাড় করাই কঠিন।

সেক্ষেত্রে কারও কিডনি কিনে ট্রান্সপ্লান্ট কীভাবে সম্ভব তা আমাদের বোধগম্য নয়। আমাদের ধারণা, যারা দেশের বাইরে গিয়ে ট্রান্সপ্লান্ট করান, সেক্ষেত্রে এরকম ঘটনা ঘটতেও পারে। তারপরও আমরা প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করব, ভালোভাবে বিষয়টি যাচাই করা হোক। এতে কাউকে জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে যেন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়। আমার স্বাস্থ্য : আপনাদের পক্ষ থেকে নিকটাত্মীয় যাচাইয়ের জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া হয়? অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ : দেখুন, নিকটাত্মীয় প্রমাণের জন্য তদন্ত করতে হবে, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট আইনের কোথাও একথাটি লেখা নেই।

তথাপিও আমাদের নিজেদের উদ্যোগেই বরং এ বিষয়ে অধিক স্বচ্ছতার জন্য যথাসাধ্য খোঁজখবর নিয়েই ট্রান্সপ্লান্টের প্রক্রিয়া করি এবং সেসব তথ্য সংরক্ষণও করা হয়। এক্ষেত্রে ডোনার ও রোগীকে আলাদা আলাদা জিজ্ঞাসা করা হয়। এক্ষেত্রে কোনো আত্মীয়তার সম্পর্ক খুঁজে না পেলে বা কোনোরূপ সন্দেহ হলে কিডনি সংযোজন করা হয় না। তবে কেউ পরিচয় গোপন করে এসব কাজ করলেও সরাসরি রক্ত সম্পর্কীয় বা ফার্স্ট ডিগ্রি রিলেশনের চেয়ে চাচা, মামা, ফুফু, খালার মধ্যে রোগীর আত্মীয়তার সম্পর্কের সত্যতা নির্ধারণে চিকিত্সকদের বেশ বেগ পেতে হয়। এখানেই হয়তোবা অপরাধী চক্ররা সুযোগ নেয়।

এসব ঘটনার পর আমাদের এ বিষয়টি নিয়ে এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, পত্র-পত্রিকা, টিভি চ্যানেলে আসার আগে যা আমরা চিন্তাও করতে পারিনি। তাই আমরা সরকারকে অনুরোধ করব, অঙ্গ সংযোজন আইনের ধারা থেকে চাচা, খালা, ফুফু, মামা অপশনটি বাদ দিয়ে এক্ষেত্রে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রীর কাছ থেকেই যাতে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নিয়ে সংযোজন করতে পারে—আইনে তা যেন সংশোধন করা হয়। আমার স্বাস্থ্য : বিদ্যমান কিডনি ডোনার সমস্যা ও কিডনি বিক্রি বন্ধ করতে আরও কী কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? অধ্যাপক ডা. হারুন আর রশিদ : বাংলাদেশে স্বল্পসংখ্যক কিডনি সংযোজনের প্রধান অন্তরায় হিসেবে দেখা যাচ্ছে, নিকটাত্মীয় কিডনিদাতার স্বল্পতা। এসব সমস্যার সমাধানে দেশে ক্যাডাভারিক (মরণোত্তর) কিডনি দান চালু হওয়া উচিত। একমাত্র চক্ষুর ক্ষেত্রে এটা চলমান থাকলেও এ প্রক্রিয়ায় কিডনি, হার্ট, লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ ৫টি অরগান দান করলে একজন মৃতপ্রায় মানুষ একসঙ্গে ৫ জন মুমূর্ষু লোককে বাঁচাতে পারবে।

কিডনি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে আমরা এরই মধ্যে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও শুধু ডোনার সঙ্কটের কারণে এটা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য প্রয়োজন কিডনি রোগ সম্পর্কে সামাজিক সচেতনতা, শিক্ষা ও মোটিভেশন। সরকারের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত। এতে দেশে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের হার আরও বৃদ্ধি পাবে। কেননা, দেশে সড়ক দুর্ঘটনাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক রোগীই মুমূর্ষু অবস্থায় আইসিইিউতে ভর্তি থাকেন।

তাদের যখন বাঁচার আর কোনো আশাই থাকে না তখন ‘ব্রেইন ডেথ’ কমিটির ঘোষণার মাধ্যমে তাদের দেহ থেকে এই ৫টি অরগান বিযুক্ত করে সংশ্লিষ্ট রোগীদের দেহে ট্রান্সপ্লান্ট করা সম্ভব। উন্নত দেশগুলোতে এ প্রক্রিয়ায় ৭০-৭৫ ভাগ সংযোজন হচ্ছে, যেখানে আমাদের দেশে এখনও শুরুই হয়নি। লেখক : বিভাগীয় সম্পাদক, আমার স্বাস্থ্য, দৈনিক আমার দেশ সূত্র : Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.