আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ বিস্মৃতির কালে

বাসের কন্ডাক্টর ভাড়া না চাওয়া পর্যন্ত সব কিছু ঠিকঠাক মতোই ছিল। আর দশটা বাস কন্ডাক্টরের মতো এর চেহারাটাও আলাদা করা যায় না এমন, আংগুলের নিপুন ভাঁজে বিভিন্ন অংকের নোট প্যাঁচানো, রংচংয়ে হাউয়ায় শার্টের বোতাম খোলা বুকে উঁচু নিচু পাঁজরের ঢেউ, হলুদ দাঁত আর কালো দাঁতের ফাক গলে একঘেয়ে ঘ্যানঘেনে ভাড়া দাবি বা যাত্রিদের সাথে খ্যাচাখেচি সব কিছুই এক। রড ধরে ঝুলে থাকা বিপরিত বা সমমুখি মানুষের ভিড় গলে কন্ডাক্টর যখন তার কাছে আসে এবং ভাড়া দাবি করে ঠিক তখন থেকেই আর সবকিছু সাভাবিক থাকে না। সে বাসের জানালার সমান্তরালে উড়তে থাকা একটা হলদে পাতার ঘুর্নন দক্ষতায় মুগ্ধ হচ্ছিল আর ভাবছিল পাতাটি সেই কবে শহরের লাম্পট্যের কাছে সবুজ হারিয়ে হলুদ হয়েছে এবং অপহৃত সবুজের দাবিতে বাতাসের সাথে আঁতাত করে এখন উড়ে বেড়াচ্ছে, এমন ভাবনার মাঝে বাস কন্ডাক্টর তার গন্তব্য জিগ্গেস করে ভাড়া চাইলে সে দেখে জানালা সমান্তরালে উড়তে থাকা হলদে শুকনো পাতাটি হাল ছেড়ে দিয়েছে। এবং সে মনে করতে পারে না তার গন্তব্য কোথায়।

প্রথমে সে ভাবে এটা সাময়িক স্মৃতিহীনতা এবং এই ভাবনা থেকে সে মাথা ঝাঁকিয়ে মগজ উদ্দিপ্ত করার প্রয়াস পায় যেন নিউরনে সওয়ার হয়ে তার গন্তব্যের হদিশ জিভের আগায় এসে ছিটকে পড়তে পারে কন্ডাক্টরের দিকে। কিন্ত সে কিছুতেই মনে করতে পারে না সে কোথায় যাবে। সে অস্বস্তি নিয়ে জানালার বাইরে তাকায় এবং দেখে বৃস্টি পুর্ব গ্লুমি প্রসাধনে শহরটা খুব মন্থর ছুটছে বাসের সাথে সাথে, উঁচু উঁচু দালানের গায়ে উল্কির মতো নামগুলো সবই খুব অচেনা তার কাছে। ধন্দের ভেতর থেকে সে শুধু অস্পস্ট ভাবে এটুকুই বলতে পারে সামনের স্টপেজেই সে নেমে যাবে এবং পকেট হাতড়ে মোচড়ানো একটা নোট দিয়ে সংশয় নিয়ে কন্ডাক্টরের দিকে তাকিয়ে থাকে, এবং কন্ডাক্টর এক যাত্রির পেছনে খুব বেশি সময় ব্যয় করাটা অনুৎপাদনশীল ঠাউরে আর উচ্চবাচ্য না করে তাকে টপকে পেছনে চলে যায়। পরের স্টপেজে বাসটি তাকে একা এবং স্মৃতিহীনতায় ফেলে চলে গেল।

সে ভিত হবে, হতবিহ্বল হবে না কী হবে বুঝতে না পেরে নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে থাকে ধাবমান রাস্তার ভাটিতে। এই ভরদুপুরে সন্ধ্যার ঠিক আগ মুহুর্তের মন খারাপের মতো ধুসরতায় শহরটাকে ডুবতে দেখে তার ভালো লাগে এবং সে কতো দিন এমন মন খারাপ করা ধুসরতায় নিজেকে ডুবতে দেখেনি ভাবতে যেয়ে দেখে তার আসলে কোন অতীত নেয়। এমনকি সে নিজের নামটাও মনে করতে পারে না। নিজের নাম না থাকটা বা মনে না করতে পারাটা তার কাছে গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে যখন সে দেখে মন খারাপ করা ধুসরতা তিব্র হয়ে গিলে ফেলছে গাড়ি সুদ্ধ রাস্তা-উঁচু নিচু সব দালান-ওভার ব্রিজ এবং মানুষগুলোও উজ্জলতা হারিয়ে ফিকে হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। ধুসরাচ্ছনতা ঘনিভুত হতে থাকলে সে একটা বিপনীবিতানের ঘোলা কাঁচের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দিকে তাকায় এবং দেখে বৈশিস্টহীন একজন মানুষ, কোঁকড়ানো চুলে লেপ্টানো ব্রুন সর্বস্ব কপালের নিচে অগভির চোখ, খাড়া হতে পারতো এমন নাক আর তার নিচে পাতলা অভিব্যাক্তিহীন ঠোঁট আর থুতনি-গাল ঠেলে উঠতে চাওয়া অসম্পুর্ন দাড়ি।

সে ভাবে নিজেকে আবিস্কারের কী কী সুত্র তার কাছে আছে; প্যান্টের পকেটে খুচরো কিছু টাকা, বুক পকেটে প্রায় দোমড়ানো একটা সিগারেট এবং একটা চকলেট। আরো কিছু হ্য়ত ছিল এমন অনুভুতি তার বাকি পকেটগুলোতে আংগুলের প্ররোচনায় জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়। সে এবার প্রায় দোমড়ানো সিগারেটটা দু'আংগুলের ঘুর্ননে প্রায় কাম্য একটা আকারে নিয়ে আসে এবং দেয়াশলায়হীনতায় আগুন ধরানোর কথাও ভুলে যায়। তার পাশে শুন্য চোখের একজন বিপনীবিতানের ঘোলা কাঁচে নিজেকে গেঁথে পরখ করছে, বিষাদ আর অবসাদের সংগমটা উপভোগ্য হয়ে উঠছে লোকটার কাছে এবং লোকটার চোখের শুন্যতা আরো ব্যাপ্তি নিয়ে গ্রাস করছে তাকেও। "ভাই, এইটা কোন জায়গা?" লোকটা প্রথমে নিরুত্তর থাকে কারন তার চোখের শুন্যতা ততক্ষনে সম্প্রসারনের শেষ প্রান্তে এসে থিতু হয়ে গেছে এবং খানিক পরে সে বলে; "বুঝতেছি না।

আপনি জানেন?" উত্তরে সে কাঁধ ঝাঁকায়, ঠোঁট ওল্টায় ও ভ্রু কোঁচকায় এবং এর সম্মিলনে যে শারীরিক ভাষার উৎপন্ন হয় এতে সন্তুস্ট না হয়ে সে বলে; "ভাই আপনার কাছে আগুন হবে?" লোকটা আগুন বিষয়ে উৎসাহি হয় না, বরং পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে ভাঁজ খোলে, একে একে সব কাগজ বের করে তাকে দেখায় এবং বলে; "আমি কিছুই পড়তে পারছি না, অক্ষরগুলোও চিনতে পারছি না। " ধুসরাক্রান্ত রাস্তায় গাড়িগুলো থেমে যাচ্ছে একে একে, শেষ গাড়িটার ব্রেকের কর্কশ শব্দটা জীবিত থাকে অনেকক্ষন তারপর সর্পিল বাতাসের নদীতে ভেসে চলে যায় অস্পস্টতায়। মানুষগুলো বেরিয়ে আসে গাড়ি থেকে, আড়মোড়া ভাংগে, কেউ হাই তোলে এবং উদ্দেশহীন ছড়িয়ে যায় এখানে সেখানে। অনেকগুলো বাচ্চা;একটা ছেলে দুটো মেয়ে, আরো একটা ছেলে তারা লুকোচুরি খেলছে গাড়িগুলোর আড়ালে আর মানুষগুলো পকেট থেকে কাগজ বা টাকা, ওয়ালেট, মোবাইল সব কিছু বের করে ফেলে দিচ্ছে। সব শব্দেরা হেঁটে হেঁটে চলে যাচ্ছে গাঢ় ধুসরের চোঁয়ালে।

সবার চোখে লতিয়ে ওঠা শুন্যতা পরস্পরের হাত ধরাধরি করে ছড়িয়ে পড়ছে কোথায়, তার হদিশ পেতে কেউ আগ্রহী হয় না। সে আগুনহীন সিগারেট ঠোঁটে চেপে সদ্য অক্ষরভোলা মানুষটিকে নিয়ে আর সবার সাথে যোগ দেয়। রাস্তার দু'পাশের দালানগুলো মোমের মতো মসৃন মনে হয় এবং সেই মসৃনতার ভেতর থেকে শুন্যচোখের আরো মানুষ বেরিয়ে আসে। কেউ একজন বলে; "কোথায় যেন যাবো বলে বেরিয়েছিলাম, মনে করতে পারছি না, মনে হচ্ছে খুব তাড়া ছিল আমার! এখন একটুও তাড়া নেই, এই যে ধিরে ধিরে হাঁটতে পারছি আপনাদের সাথে!" আর সবাই একমত হয় লোকটার সাথে এবং স্মৃতিহীনতায়-আক্রান্ত পরবর্তি বিষাদ উপভোগ্য হয়ে ওঠে সবার কাছে। বিলবোর্ড, দেয়াল, আকাশের কাছাকাছি দালানগুলোর নিরাভরন পেট, শপিংমলের প্রস্বস্ত কপাল এমনকি পাবলিক বাসের পোড়খাওয়া পাঁজরে লেখা সব কিছু ঝরে-গলে-ধুয়ে মিশে যাচ্ছে ধুসরে।

"আহ! আমার কোন নাম নাই! কেউ আমাকে ডাকছে না, ডাকবেও না!" কেউ একজন এই কথা বললে, আরেকজন বলে ওঠে, "আমাকে কোথাও যেতে হবে না! কোথাও না!" লুকোচুরি খেলা বাচ্চাগুলো রাস্তার পাশের দোকান লুট করে ক্যান্ডি উড়াচ্ছে আকাশে। আধচোষা নগ্ন ক্যান্ডির মাধুর্য্য ভারি বাতাসে ভেসে থাকতে না পেরে ছুটে আসছে নিচে আর লোকগুলো তাদের জিভে প্রথমবারের মতো মিস্টতা জমতে দেখে রোমাঞ্চিত হয়, ক্যান্ডি খাওয়া শিখে তারা হেসে ওঠে। অক্ষরভোলা লোকটা কসরত করে মাড়ি আর মুখের চাতালে লেপটে থাকা ক্যান্ডি হাপিশ করার ফাঁকে বলে; "আচ্ছা বলেন তো, এই বাচ্চাগুলোর মধ্যে কেউ যদি আমাকে বাবা বলে ডাকে তবে আমার কী করা উচিৎ? আমার কোন বাচ্চা ছিল বলে তো মনে পড়ে না....." শিশু বিষয়ে সে কোন জবাব দেয় না বরং নির্মোহ রাস্তাটা কিভাবে প্রবাহিত করছে নির্লিপ্ত মানুষগুলোকে গন্তব্যহীন ধুসরে, সে এটা ভাবে। তার ভালো লাগে আগুনহীন সিগারেট ঠোঁটে ঝুলিয়ে এই শুন্য চোখের মানুষগুলোর সাথে হাঁটতে। একটা পাখা গজানো খবরের কাগজ এইমাত্র ল্যান্ড করলো রাস্তায় থমকে যাওয়া গাড়ির ছাদে, একটা মেয়ে ঠোঁটে চকচকে লাল নিয়ে হাসছে সেখানে।

বাচ্চাগুলো এবার গান গাইছে। অস্ফুট ফুলের সুগন্ধি হৃৎপিন্ড, দুরাগত ঘন্টির রিনরিনে শেষ কম্পন আর প্রথম বৃস্টির আধখানা ফোঁটার মতো গান গ্রাস করলো সবাইকে। সবার শুন্য চোখের করিডরে মৃদু আলো জ্বেলে হেঁটে গেল গান, সবার কন্ঠ ছিঁড়ে উড়ে গেল অগুনিত দোয়েল গাঢ় এবং প্রার্থিত ধুসরের দিকে। ঠোঁটে আগুনহীন সিগারেট নিয়ে সে চাইলো আর সবার মতোই- এই গন্তব্যহীনতা অনন্তে বাঁধা পড়ুক। নিজের হানাদার নাম মনে পড়ে যাবার আগেই ঐ গাঢ় ধুসরে লীন হতে আরো দ্রুত পা চালায় সে! ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।