আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ বৈকল্য-২



বৈকল্য-১ Click This Link ২। শহরের টিকে থাকা মেইন রোডের যে অবশিস্ট অংশ প্রাচিন উপাসনালয় পেঁচিয়ে বড় একটা মাঠের দিকে যেতে গিয়ে ভেংগেচুরে থেমে গেছে, সেখানে একটা ভ্যান ভ্রমনজনিত ক্লান্তিতে ধুঁকছে। শহরের প্রায় সব মানুষ ভ্যানটার চারিদিকে জড়ো হয়েছে। যাদের চোখ এখনো টিকে আছে, তাদের চোখে ধুকতে থাকা ভ্যানটা বিবিধ আকার নিয়ে জ্বল জ্বল করে আর যাদের চোখ নেয় তারা বাঁকানো হাত-অপুর্নাংগ পা-কালো ফুলো ওঠা জিভ-বেঢপ ট্যাপসানো পেট- ইত্যাদি দিয়ে ভ্যানটাকে ছুঁয়ে দেখে। তাদের কন্ঠচিরে ফ্যাসফেসে, ঘড়ঘড়ে, চিঁচিঁ বিভিন্ন শব্দের অনুবাদ ভ্যানের উঁচুতে ড্রাইভারের খোঁড়লে গিয়ে আছাড় খায়।

জানালার কাঁচ একটু একটু করে নামতে থাকলে তাদের মধ্যে অকার্যকর, বহুদিন আগেই বিলুপ্ত বিভিন্ন অনুভুতির ভ্রন শ্বাষ নিতে মাথা চাঁড়া দিয়ে উঠতে চায়। তারা দেখে জানালার পটভুমিতে একটা মানুষের মুখ গজিয়ে উঠছে, জোড়া ভ্রুর নিচে এই শহরের মরে যাওয়া প্রাচিন নদীর টলটলে আবিস্কার করে কেউ কেউ, খাড়া নাক দেখে কেউ কেউ তাদের থেবড়ে যাওয়া নাকের বা তার ফুটোর অপভ্রংশে হাত বোলায় আর তার পুরু ঠোঁট দেখে তাদের কন্ঠনালি ভিজে উঠতে চায়। লোকটা ভ্যানের খোঁড়ল থেকে পুরো অবয়ব নিয়ে বেরিয়ে আসলে শহরের লোকগুলোর গলা দিয়ে বিলুপ্ত অনুভুতির দলা ছিটকে পড়ে, তারা কেউ কেউ হঠাৎ জেগে ওঠা এই অনুভুতিগুলো সহ্য করতে না পেরে বসে বা শুয়ে বা গড়িয়ে পড়ে। লোকটা শহরের লোকদের উদ্দেশ্যে তার সুঠাম হাতটা নেড়ে বলে; "হ্যালো! আমি দুঃখিত যে তোমাদের খাবারের জন্য এতো দিন অপেক্ষা করতে হলো। কী করবো বলো, আমাদের আগের ড্রাইভার মরে যাওয়ার পর এখানে আর কেউ আসতে চাইতো না।

আমি তোমাদের জন্য অনেক নতুন নতুন খাবার নিয়ে এসেছি। " লোকটার গমগমে কন্ঠে ওদের ভেতর অনেক আগের যুগপৎ মেঘ ও বৃস্টির স্মৃতি জেগে ওঠে। তাদের প্রায় মৃত মস্তিস্কের বিভিন্ন স্তরে অনেক আগের টানা বৃস্টির পর আচমকা জেগে ওঠা গাছের বাচ্চাটির কচি সবুজ পাতা নড়ে ওঠে। "আমি খুব বেশি কিছু আনতে পারিনি, কারন আমাদের শহরেও সাপ্লাই অনেক কমে গেছে। তবে এবার তোমাদের জন্য কিছু কম্বল আর বল নিয়ে এসেছি।

" লোকটার চোখজোড়া চকচক করে উঠলেও আগত পন্য বা খাবারের প্রতিফলন দেখা যায় না শহরের লোকদের চোখে, তারা বলে; "তুমি তো আমাদের মতো নও!" এই কথাটার সাথে শহরের লোকদের অব্যখ্যাত ও সদ্য পুনর্জন্ম নেওয়া অনুভুতির মিশেল থাকলেও ভ্যান চালকের কাছে তা ঘোষনার মতো মনে হয়, সে এও ভাবে এই ঘোষনা বা মন্তব্য বা একরৈখিক কথটা আদতে এক অনিবার্য প্রশ্ন হয়েই ঝুলে থাকে। শহরের সব চাইতে বড় ধ্বসে যাওয়া বাড়ির বাসিন্দা, কোমরের নিচ থেকে পাথর হয়ে যাওয়া লোকটা তার তিনচাকার ঠেলাগাড়ির ঘন্টি বাজিয়ে সবার দৃস্টি আকর্ষন করে। সে বলে; "একে খুব বিসদৃশ্য দেখাচ্ছে। আমি প্রাচিন বইয়ে যে মানুষ দেখেছিলাম, ও প্রায় তাদেরই মতো। তোমাদের কী মনে হয় না, ওর তো এরকম হওয়ার কথা নয়?" ভ্যান চালকের আবির্ভাবে শহরে সন্ধ্যা জেঁকে বসতে পারে না, মরচে রংগা মেঘের পাকস্থলিতে তারা সবাই জারিত হয়।

সে হাসিমুখে ভ্যানের দরজা খুলে দিলে শহরের সবাই দেখে ভ্যানের পেটে প্যাকেটজাত খাবার, কিছু কম্বল, আসবাব আর কয়েকটা লাল বল নিস্পৃহ পড়ে আছে। তারা এসবে আগ্রহি হয় না। বরং তারা ভ্যান চালককে ছুঁয়ে দেখতে চায়, এই ছোঁয়াছুঁয়িতে তাদের মধ্যে অপার্থিব সব অনুভুতি ডালপালা ছড়িয়ে তাদের বিবশ করে দেয়। মাথা আর কাঁধ শরীরের পেছনে মোচড়ানো একজন ভ্যান চালকের কাছে জানতে চায়; তাদের শহরে মানুষের বাচ্চার জন্ম হয় কি না, শিকার করার মতো কোন কুকুর কি এখনো টিকে আছে, নাকি মানুষেরাই বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে শিকার শিকার খেলে, তাদের শহরে কয়টা গর্ত আছে, শেষ বৃস্টি কবে হয়েছে, ভ্যান চালকের শহরের সাথে তাদের কি সম্পর্ক, কেন তাদের শহর থেকে খাবার পাঠানো হতো ইত্যাদি ইত্যাদি। ভ্যান চালকের উত্তরে ওরা সন্তুস্ট হয় না।

ভ্যান চালক তার ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে বলে; "ঠিক আছে, তোমরা মালামালগুলো বুঝে নাও। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেয়, তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। " তাদের মধ্যে কোন রকম চান্চল্য দেখা যায় না। বরং তারা ভ্যান চালকের সুঠাম ও সাভাবিক শরীর, সাবলিল নড়াচড়া, ঠোঁটে ঝোলানো হাসি এইসব গিলে খায়। এর মাঝে কোমরের নিচ থেকে পাথর হয়ে যাওয়া লোকটা তার তিনচাকার ঠেলাগাড়ির ঘন্টিটা আবার বাজালে সবাই নিরব হয়।

"এই, কেউ আমাকে ভ্যানটার উপরে তুলে দাও, আমি কিছু বলবো" দোতলার সমান লম্বা একজন, যে কিনা উচ্চতার ভারে ভাঁজ হয়ে থাকতো সব সময়, সে তাকে তার তিন চাকার ঠ্যালাগাড়ি সমেত ভ্যানের ছাদে তুলে দেয়। "শোন সবাই। এই লোকটা আমাদের মতো নয়। আমি জানি না একে কী বলবো, কদর্য নাকি সুন্দর। তবে এটা মনে হচ্ছে যে তার শরীর অনেক বেশি কার্যকর।

তোমরা তো জানো, আমাদের শহরে কোন মানুষের বাচ্চার জন্ম হয় না অনেক দিন। হবে তার কোন সম্ভাবনাও নেই। আমাদের মাঝে মাত্র দু'জন মেয়ে লোক তাও একজনের যোনী আমার মতোই পাথর হয়ে গেছে। আরেক জন যে আমার সাথে থাকে সে মনে হয় এখনো কিছুটা সক্ষম। " বলে সে ভিড়ের দিকে তার ঘন্টি তুলে ধরে।

মাথা কাঁধ হড়কে বুকের মধ্যে ঢুকে যাওয়া, একটা চোখ পিটপিট করছে চাঁদির উপর, একটা স্তন ঝুলছে হাটুর কাছে; শহরের একমাত্র সক্ষম-প্রায় মেয়ে লোকটি সামনে এগিয়ে আসলে লোকটা আবার কথার খেই ধরে; "আমি বলি কী, এই লোকটা আমাদের সাহায্য করুক। আমি পুরো পাথর হওয়ার আগে শহরে একটা বাচ্চা দেখতে চাই!" শহরের মানুষগুলোর মাঝে কিছু একটা বিস্ফারিত হয়, এমন নয় যে বাচ্চার জন্য সবাই খুব লালায়িত, কিন্ত তারা বোঝে স্থবিরতার কাঁকর ভাংতে শুরু করেছে। তাদের ঘোলা চোখে বা চোখের কোটরে কোন দিন না দেখা বাচ্চার একটা ফোটা ঝরে পড়ে বড় হতে থাকে। তারা আরো দেখে বৃস্টির পরে ধ্বসে যাওয়া শহরের আনাচে কানাচে ভরে উঠছে গাছেদের বাচ্চায়। তাদের হঠাৎ করে বহুদিন পরে ক্ষিদে পায়, ঘাপটি মেরে থাকা ক্ষুধা তাদের ছুড়ে দেয় ভ্যানের মধ্যে।

ভ্যান চালক তার মুখে ঝোলানো হাসিটা জিইয়ে রেখে বলে; "শোন, তোমরা ভুল করছো। বাচ্চা জন্ম দেওয়ার বিষয়টা সম্ভব না। আমাদের ওখানেও দির্ঘদিন কোন মানুষের বাচ্চার জন্ম হয়নি। " "আমরা অপেক্ষা করবো। আমাদের কোন তাড়া নেই।

যেভাবে দশ বছর ধরে বৃস্টির জন্য অপেক্ষা করছি। " "পাগল হয়ে গেলে নাকি তোমরা!? আমাকে আজকেই ফিরতে হবে!" "একটা বাচ্চার জন্ম দিয়ে তারপর যাও যেখানে খুশি। " ভ্যান চালক লাফিয়ে ভ্যানে উঠে বসতে চাইলে তাকে ঝাপটে ধরে কেউ। তার চিৎকার গলা ফুড়ে বেরিয়ে শহরের লোকগুলোর মাঝে চাপা পড়ে আর বিস্ফারিত হতে পারে না। তারা ভ্যান চালককে টেনে হিচড়ে সক্ষম-প্রায় মেয়েটার কাছে নিয়ে যায়।

কয়েকজন তার প্যান্ট কামড়ে ছিড়ে ফেললে, মরিয়া লোকটা দু'পা মুড়িয়ে বুকের কাছে নিয়ে যায়। তিনকুঁজওয়ালা চিৎকার করে বলে; "আমার সাথে যে মেয়েটা থাকতো, সে স্বপ্নে বাচ্চা দেখতো! তুমি আমাদের সেই বাচ্চা দেখাবে। " থ্যাতলানো সরিসৃপের মতো বুক ঘেসটে চলা একজন হিসিয়ে ওঠে; "আমাদের বাচ্চা সময়ের কোন কিছু কেন মনে নেই? আমরা কি কখনো বাচ্চা ছিলাম না?" এরকম অসংখ্য চিৎকারে ভ্যান চালক চাপা পড়ে যেতে যেতে আরো কুঁকড়ে যায়। বামচোখে গর্তওয়ালা ভ্যান চালকের পুরুষাংগ উন্মুক্ত করার জন্য তার পা দুটো আলাদা করতে টানাহ্যাচড়া করে এবং সে সফল হলে তাদের বৃত্তের ভেতর যাবতিয় শব্দ উধাও হয়ে যায়। তারা দেখে ভ্যান চালকের উরুসন্ধি জুড়ে ধু ধু শাদা শুন্যতা, পেলব মসৃন ঢালে কোন উদগত লিংগ নেই!


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।