আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ মহিমউদ্দিন যখন মৃত কুকুরের মুখোমুখি...



মহিমউদ্দিন সকাল ৯ টা'র ত্রস্ত কাউরানবাজার এর রাস্তায় অর্ধেকটা পিস্ট কুকুরের খোলা চোখে ঢুকে যায়। খানিক আগে গা ঘেসাঘেসি করে আরো অনেকের সাথে রাস্তা পেরুনোর সময়, মহিমউদ্দিন তার মাথাটা বাঁ দিকে হালকা কাত করলেই দেখতে পায়; অর্ধেক পেষা কুকুরটা নিস্পৃহ তাকিয়ে আছে তার দিকে। অন্যরা কেউ মুখে-নাকে হাত চাপা দিয়ে, কেউ ভ্রু মুচড়ে কপালের জ্যামিতিতে দিনের বাকি সময়টা সম্ভাব্য খারাপ যাওয়ার দায়ভার কুকুরটার চাপিয়ে দ্রুত পেরিয়ে যায়। শুধু মহিমউদ্দিন মৃত কুকুরের নিস্পৃহ চাহনি তার চোখে পুরে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকে, সে দেখে কালো-সাদায় মেশানো চামড়া, লাল মাংশ আর হাড় রাস্তায় অনেকটা ছেঁচড়ে ফিকে হয়ে গেছে। গাড়ির স্রোত হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে কুকুরটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়, তাদের কারও ভেতর কুকুরটার নিস্পৃহ চোখদুটো সওয়ার হয় কি না, মহিমউদ্দিনের জানা হয় না।

সে থ্যাঁতলানো, দগদগে, ছেঁচড়ে যাওয়া কুকুরের একাংশের সাথে অক্ষত চোখদুটো সমেত তার অফিসের কাছে পৌঁছায়, লিফটে পেটে ঢুকে যায়, ঝাপসা মোটা কাঁচের ওপারে ঝলমলে রোখসানাকে পেরিয়ে তার ডেস্কে এসে অল্প অল্প কাঁপে। এর মাঝে তার টেবিলের উপর লাল টেলিফোনটা চিৎকার করে উঠলে মহিমউদ্দিনের কাঁপুনি বেড়ে যায়, টেলিফোনের লাল তার বেয়ে বড় স্যার খুব শীতল প্রবাহিত হয়ে তাকে জমিয়ে দেয়। "জ্বী স্যার, আমি আসছি। " মহিমউদ্দিন জানে বড় স্যারের রুম তক যেতে যেতে তার পিঠে কলিগদের চোখগুলো গাঁথতে থাকবে এমনকি বড় স্যারের রুমের ভেতর পর্যন্তও তাদের এই প্রচেস্টা জারি থাকবে। "মহিম, আপনি রিপোর্ট টা এখনো সাবমিট করলেন না।

আমি আপনাকে আর কী ভাবে এর গুরুত্তটা বোঝতে পারি?" মহিমউদ্দিন নিরুত্তর থাকে। সে দেখে বড় স্যারের টেবিলে তার প্রতিবিম্ব কারওয়ানবাজারের সামনের রাস্তায় থ্যাঁতলানো কুকুরটার সাথে একাকার হয়ে আছে। "কমপ্লাইনস ইস্যুতে কোম্পানির অবস্থান আপনি জানেন। ভেন্ডরের রিটেন কমপ্লেইন আছে, ম্যানেজমেন্টকে তো আমাদের জবাবদীহি করতে হবে, তাই না?" "স্যার, রহুলের স্টেটমেন্টটা জরুরী। চাকরী ছাড়ার পর ওকে ট্রেস করা মুসকিল হয়ে গেছে।

" বড় স্যার চেয়ারে হেলান দিয়ে দু'কাঁধ সামান্য উঁচিয়ে চাকরীছাড়া রহুলের দায়ভার মহিমউদ্দিনের উপর ছেড়ে দেন। "আপনার ডিপার্টমেন্ট, আপনি সামলান। আর সাসপেক্ট কী আপনার সাথে কমিউনিকেট করার চেস্টা করছে?" মহিমউদ্দিন ইংগিতটা বোঝে। তবে তার ঘোলা চোখে মৃত কুকুরের থ্যাঁতলানো শরীর ভাসতে থাকলে সেখানে কোন প্রতিক্রিয়া সৃস্টি হয় না। অফিসে অস্বস্তির সর পুরু হতে হতে তাকে ছেয়ে ফেলতে থাকে।

লান্চের সময় ক্যান্টিনে মহিমউদ্দিনের পাশে প্লেট হাতে বসে আইটির রাশেদ। "কী ব্যাপার কন তো বস? আসলে হইসিল কি?" মহিমউদ্দিন মিরপুর ১১ থেকে বয়ে আনা হটপটের ভেতর জমে থাকা বাস্প দেখে, দেখে ভাত-সব্জি-মুরগির বুক জোর করে ধরে রাখা ওমে বিমর্ষ খুব। সে বলে; "জানেন রাশেদ, আজ অফিস আসার সময় রাস্তায় একটা থ্যাঁতলানো কুকুর দেখলাম। " "ধুরো মহিম ভাই! খাওয়ার মধ্যে কী সব বলেন না!" আইটি রাশেদ পেট ও প্লেট বাঁচিয়ে উঠে যায়। মহিমউদ্দিন শুন্য চোখে প্লেটের দিকে চেয়ে থাকে আর অপেক্ষা করে কখন কুকুরটা থ্যাঁতলানো শরীর ভাত-সব্জি-মুরগির বুক নিয়ে মাখামাখি করবে।

এ্যাকাউন্টস এর জলিল তার পাশে বসে সিগ্রেট ধরিয়ে বলে; "মহিম, এ্যাতো কী ভাবতেসো খাওয়া বাদ দিয়া? রিপোর্ট নিয়া এ্যাতো টেনসন নিতাছো ক্যান এইটাইতো বুঝলাম না। রুহুল টাকা মাইরা চাকরী ছাড়ছে, তুমি অর টিকিটাও পাইবা? মাঝখান থিকা ঐ নতুন পোলাটা ফাঁসতেছে, পোলাটারে আমার সাধাসিধা মনে হইসে....." "জানো জলিল, আজ রাস্তায় একটা থ্যাঁতলানো কুকুর দেখলাম। চিন্তা করছি, যে গাড়িটা ওকে চাপা দিল, সেই ড্রাইভার কী ভাবছিল সে সময়। " "মহিমউদ্দিন, ঢাকার রাস্তায় ডেলি কতোজন মানুষ পিস্ট হয় সে খবর রাখো? তুমি মিয়া কুত্তার এ্যাকসিডেন্ট নিয়া আছো!" ক্যান্টিনে ইতস্ততঃ ছড়িয়ে বসা কলিগদের পেরিয়ে মহিমউদ্দিন ঘোলা কাঁচের ওপাশে আকাশটা রংহীন দেখে। কাটা-চামচের টুংটাং, নিচুতে ভেংগে পড়া হাসি আর বিবিধ খাবারের জটপাকানো ঘ্রান এড়িয়ে বা ছাপিয়ে থ্যাঁতলানো কুকুর রংহীন আকাশে স্থির হয়ে থাকলে মহিমউদ্দিনের কিছু করার থাকে না।

"জানো জলিল, কুকুরটাকে দেখে মনে হলো সে নিজ থেকে চাকার নিচে পড়ছে! ঐটার চোখ এতো জীবন্ত আর শুন্য যে..." মহিমউদ্দিন অসম্পুর্ন বাক্যের গন্তব্য নিয়ে হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সে নয়ন নামের ছেলেটার কথা ভাবে। রুহুলের সাথে তার ডিপার্টমেন্টে কাজ করতো, অফিসিয়ালি এখনো করে। ভেন্ডর ম্যানেজমেন্ট এ ছেলেটা রুহুলের এ্যাসিসট্যান্ট হিসাবে ছিল। মাত্র দশটা হাজার টাকা! জলিল মহিমউদ্দিন এর দিকে সিগ্রেট তাক করে বলে, "বুঝলা মহিম, রুহুলরে তো আমি চিনি অনেক আগে থিকা।

আগের কোম্পানিতেও অর রেপ্যুটেশন ভালো ছিল না। নয়ন পোলাটার ঘাড় ভাইংগা আকাম কইরা ধরা পড়নের আগেই পলাইছে। ঐ পোলাটা কিছু বলসে তোমারে?" "ও কিছু অস্বিকার করে নাই, জলিল। আমি ওকে বলেছিলাম মাত্র দশ হাজার টাকার জন্য কেন ও এই কাজটা করলো। প্রথমে কিছু বলতে চায় নাই।

পরে যা বুঝলাম ওর হঠাৎ করে কিছু টাকার দরকার পড়ছিল। মা না কে জানি খুব অসুস্থ। " জলিল ধোয়ার রিং অনিশ্চিতে ছুড়ে মাথা নাড়ে, যেন বা নয়নের দশ হাজার টাকার দুর্নিতির নিয়ামক হিসাবে মা বা অন্য কারো অসুস্থতা বা অন্য কোন সংকটকে খুব হালকা মনে হয়। তার মাথা নাড়ানিতে মহিমউদ্দিনের চোখ থেকে থ্যাঁতলানো কুকুরটা ঝরে পড়ে সেখানে নয়ন নামের ছেলেটা ঢুকে পড়ে। "তুমি আর কী করবা।

রিপোর্টটা স্যাররে সাবমিট করো। পোলাটার কপাল খুব খরাপ হইলে পুলিশে দিব না হইলে খ্যাদাইবো। সময়ে সামলায়া নিব। " মহিমউদ্দিন জানে ছেলেটা সব কিছু সামলিয়ে নেবে না। ওর চোখে জমে ওঠা শুন্যতার অনুবাদ মহিমউদ্দিনের মগজে, সকালের থ্যাঁতলানো কুকুরটার নিরাসক্ত পড়ে থাকার সাথে জুড়ে দেয়।

মহিমউদ্দিন মৃত কুকুরটার নিস্পৃহ চোখ আবার তার চোখে পুরে নিয়ে অল্প অল্প ঘামতে থাকে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।