আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটগল্পঃ বৈকল্য-১



১। তার বাম চোখটা যেখানে থাকার কথা ছিল সেখানটায় গর্ত ভর্তি একতাল অন্ধকার ঘাপটি মেরে আছে। গর্তের ঢাল বাম দিকে ক্রমশ প্রসারিত হতে হতে মাথার পেছনে ধোঁয়াটে বাদামি একগাছি চুলের গোড়ায় থমকে গেছে। আর একমাত্র চোখটায় নিভে যাওয়া দুপুর লেজে মুখ গুঁজে ঘুমাতে চাইলে হলদে পানিতে ভাসমান মনিটা এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে মরতে চাওয়া দুপুরের খোসা ছাড়াতে চায়। আরেকজন, যার একটা পা বাঁকা হয়ে পাছার দিকে ছুটে গেছে আর তিন মাথা কুঁজ তাকে মাটির দিকে ছুঁড়তে উদ্যত, একটা কালো পাইপ মাটির বুকে গেঁথে নিজেকে খানিক উঁচুতে ধরে রাখে।

তারা দুজন শহরের ধ্বসে যাওয়া ফ্লাইওভারের পেটের নিচে ঘনিভুত আঠালো গরমে তপ্ত হতে হতে মৃত দালানের হাড়গোড় গোনে। যার বাম চোখের গর্তে একতাল অন্ধকার, সে ডান চোখের পটভূমিতে মৃত বাড়ি ঘরগুলোকে ন্যাড়া পাহাড়ে পরিনত করে মাথা ঝাঁকাতে চায়, ঘাড় এবং চাঁদির চামড়া পরস্পরের দিকে ধেয়ে গেছে বিধায় তার মাথা নাড়ানাড়ি সম্পুর্ন হতে পারে না, ফলে সে মাথা খানিকটা কাত করে বলে; "এইখানে একদিন নদী ছিল। " তিনমাথা কুঁজওয়ালা কবেকার কোন নদী নিয়ে আগ্রহি হয় না, বরং নদীটা কিভাবে নিজেকে বুঁজিয়ে পেট ফোলা মরা সাপ হয়ে এখানে পঁচে উঠেছিল এবং তার পঁচে ওঠার প্রকৃয়ায় এই শহরের অবশিস্ট বাসিন্দাদের হাত ছিল কিনা, যাতে করে এই মরতে বসা দুপুরে ধ্বসে পড়া ফ্লাইওভারের পেটের নিচে "কিছুতেই কিছু আসে যায় না" ভংগিতে তাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। সে তার পাছার দিকে ধাবমান বেকায়দা পা'টাকে গন্তব্যের কাছ থেকে যতোটা দুরে রাখা যায় তার কসরত করতে করতে বলে; "অনেক দিন হয়ে গেল খাবারের ভ্যানটা আসে না। " "হ্যা, আগে মাসে দু'মাসে একবার আসতো।

ছ'মাসের উপর হয়ে গেল শেষবার এসেছিল। খাবার লোক কই?" "তাই। দু'মাথাওয়ালা লোকটাকে মনে আছে, যে ভ্যানটা নিয়ে আসতো? ওর দু'নম্বর মাথায় একটা চোখ কাজ করতো। সেটাই...খাবার লোক কোথাই! খাবার ইচ্ছেও তো হয় না আর..." "ঐ দুইমাথার আরেকটা নাক খুব জোরদার ছিল, আমার বাবা বলতো। শহরে ঢোকার অনেক আগেই টের পেত কোথায় কে মরে পড়ে আছে!" "আচ্ছা তুমি জানো, ঐ শহর থেকে এখানে খাবারের ভ্যানটা কেন আসতো?" "নাহ! আমার বাবারাও জানতো না।

অনেক আগে থেকেই এটা চলে আসছে। আমরা ভাইয়েরা মিলে বাবাকে যেদিন ১ নম্বর খাঁদে ফেলে আসি, তার পরের দিন শেষ ভ্যানটা আসে। " তাদের কথোপকথনে শহরের ক্রমহ্রাসমান মানুষ, উবতে যাওয়া ক্ষিদে জড়াজড়ি করে দুরবর্তি অন্যকোন না দেখা শহরের খাবারের ভ্যান আর তার দু'মাথাওয়ালা ড্রাইভারকে ধ্বসে যাওয়া ফ্লাইওভারের নিচে দৃশ্যমান করে। একচোখা লোকটার বাম চোখের গর্তে অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে, আঁচিল ভর্তি ফেটে যাওয়া বুক চুলকাতে চুলকাতে সে মনে করতে চায়, বাবাকে ১ নম্বর খাঁদে ফেলে আসার সময় বাবা কী নির্লিপ্ত ছিল? চিরে দু'ভাগ হয়ে যাওয়া ঠোঁট কেঁপে উঠেছিল কি? শুধু তার মনে পড়ে তার এক ভাই, যার হৃৎপিন্ডটা খসখসে চামড়ায় ঢেকে বুকের বাইরে ধুকপুক করতো, সে গর্তের গভিরে পাক খেয়ে ওঠা দৃশ্যমান শুন্যতায় ঢুকে যেতে যেতে কেঁপে উঠছিল। তার আরেক ভাই, যার হাতের যায়গাই ল্যাগবেগে ক'টা শুঁড় নিরবিচ্ছিন্ন নড়ে যেত, সে বলেছিল; "এটা বুড়োদের গর্ত।

" তিন কুঁজওয়ালা নাকের ফুটোই ভবিষ্যত মিশ্রিত ঝাঁঝালো বাতাস টেনে বলে; "এবারেও বৃস্টি হবে না, অথচ দেখ শহরটা সবসময় নোংরা হোলদে মেঘে ঢেকে থাকে। বছর দশেক আগে যখন শেষ বৃস্টি হয়, তার কথা মনে আছে? আমরা টানা এক হপ্তা বৃস্টিতে ভিজলাম। আর বিভিন্ন গর্ত থেকে মরাদের হাড়গোড়ও উঠে এসছিল..." "হুম, এইবার বৃস্টি হলে বাকি দালানগুলোও ধ্বসে পড়বে। সেবার বৃস্টি থামলে অদ্ভুত একটা গাছের বাচ্চা জন্মেছিল, মনে আছে? আমরা তো ছার, আমাদের বাপ-দাদারাও কোন দিন গাছ দেখেছিল কিনা সন্দেহ আছে। পা'হীন, খুব ছোট মাথার সেই বুড়োর কাছে একটা বই ছিল, আমরা সেখানে গাছের ছবি দেখি প্রথম।

" "আর সেই গাছটা নিয়ে যে কাড়াকাড়ি পড়েছিল! শহরের একভাগ মানুষই শেষ হয়ে গেল ওটার দখল নিতে। " তাদের কথোপকথনের বিচ্ছিন্নতায় শহরটা জোড়াতালি দিয়ে একটা অবয়বে দাঁড়াতে চাইলে, তারা ধ্বসে যাওয়া ফ্লাইওভারের পেটের নিচ থেকে বেরিয়ে পড়ে। শহরের মেইন রাস্তাটা যেখানে কাত হয়ে পড়ে যাওয়া প্রাক্তন শপিংমলের পাছায় হোঁচট খেয়ে আর কোথাও যাবে না বলে পণ করেছে, সেখানে শপিংমলের পাছার কাছটায় বাঁকাচোরাথ্যাবড়ানো ছায়ার নিচে একটা বাক্সে একতাল মাংশের নড়াচড়ার কাছে এসে দাঁড়ায় তারা। একতাল মাংশের বুদবুদ ওঠে ওদের দেখে। তিনকুঁজওয়ালা তার কালো পইপটা দিয়ে মাংশের বাক্সে একটা টোকা দিয়ে বলে; "এই, তোমাকে সেই কবে থেকে দেখছি এইখানেই পড়ে আছো।

ঘটনা কি?" বাক্সে কাঁপতে থাকা মাংশের ভেতর থেকে ছিটকে পড়া শব্দ জোড়াতালি দিলে বোঝা যায়; এর ছেলেরা আর এক ভাই তাকে ১ নম্বর গর্তে ফেলতে যেয়ে প্রাক্তন শপিংমলের পাছার কাছে এসে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ওর ছেলেরা গড়িয়ে গড়িয়ে চলে, তাই ঢাল বেয়ে গর্তের মুখে ওঠার কস্টটা তার বাপের সাথে এখানে ফেলে রেখে গড়াতে গড়াতে ফিরে গেছে। সে আরো বলে তারা তাকে ১ নম্বর গর্তের কাছে নিয়ে যেতে পারে কী না। অবশ্য গর্তে নিয়ে যাওয়া বাবদ সে তাদের প্রাচীন আমলের একটা বইয়ের কিছু পাতার হদিস দিতে পারে। বামচোখে গর্তওয়ালার ঠোঁটের ঢালে অসম্পুর্ন হাসি উথলে উঠতে যেয়ে মিইয়ে যায়।

সে তিনকুঁঝওয়ালাকে বলে; "হাহ! প্রাচিন বইয়ের কয়েক পাতা! চলো দেখি, একে গর্তে ফেলে আসি। সময়টা কাটবে অন্তত। " তারা দুজনে বাক্সটাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে রাস্তার তরাই বেয়ে। মাঝে মাঝে বেমাক্কা ধ্বসে পড়া বাড়ি ঘরের লাশ পেরুনোর সরু টানেলে বাধা পেলে জিরিয়ে নেয় খানিক। ১ নম্বর গর্তটা, যেখানে বুড়োরা লাফিয়ে পড়তে চায়, সে গর্তের উৎপত্তি নিয়ে তিনকুঁজওয়ালা বামচোখে গর্তওয়ালাকে প্রশ্ন করে।

বামচোখে গর্তওয়ালা মাথা নেড়ে অপারগতা জানিয়ে বাক্সের মাংশের দিকে প্রশ্নটা প্রবাহিত করে। বাক্সে জমতে থাকা, কাঁপতে থাকা মাংশের দলা ওদের জানায়, তার বাবার দাদারাও জানেনা ঠিক কবে থেকে এই গর্তে বুড়ো মানুষগুলো সেচ্ছায় লাফিয়ে পড়া শুরু করলো, তবে কালক্রমে আরো ৫টা গর্তের গজিয়ে ওঠার কথা সে ছোট থেকে শুনে আসছে, এর মধ্যে ৩ নম্বর গর্তের কথা সে জানে যেখানে জোয়ানরাও লাফিয়ে পড়ে। সে আরো জানায়, শহরের সব মানুষগুলো গর্তের মধ্যে সেঁধিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত গর্তের খিদে মিটবে না। বামচোখে গর্তওয়ালা যোগ করে ৩ নম্বর গর্তটা অনেক দুর্গম, ওর চেনা কয়েকজন ওখানটায় লাফিয়ে পড়েছে। বাক্সের মাংশ ওদের প্রশ্ন করে; "তোমরা আমার পচে ওঠার গন্ধ পাচ্ছো না? আমি কবে থেকে ছেলেদের বলছি ওরা আমার কথাই শোনে না! " ওরা মাথা নাড়ে, গন্ধের রকমফের নিয়ে ওরা কেউ ভাবে না আর।

তিনকুঁজওয়ালা বলে; "তোমার ছেলেরাই কি শহরের শেষ বাচ্চা ছিল? বহু বছর এখানে কোন বাচ্চার জন্ম হয় না!" "নাহ। শহরের একদম শেষে যে পুরানো উপাসনালয়টা আছে না? সেখানে হাত-পা ছাড়া একজোড়া মানুষ থাকতো। ওরাই শেষ বাচ্চা জন্ম দিয়েছিল। ছোট বলের মতো একটা বাচ্চা। কুকুরে খেয়ে ফেলেছিল।

কুকুর চেন তো? ঐ যে চারপেয়ে একরকম জন্তু। অনেক বছর হয়ে গেল ওদের আর দেখা যায় না," বামচোখে গর্তওয়ালা বলে; "আমার বাবা বলতো কুকুরের কথা। তখন নাকি শহরের মানুষগুলোর ঐ চারপেয়ে জন্তুগুলো শিকার করাই ছিল একমাত্র আনন্দ। " "হ্যা। আর কুকুরগুলোও সুযোগ পেলে এক-আধটা মানুষ টেনে নিয়ে যেত।

ঐ জন্তুগুলো শেষ হয়ে গেলে, আমরাই দুটো বা চারটে দলে ভাগ হয়ে শিকার শিকার খেলতাম। আর যারা হেরে যেত তাদের লাশ ৪ নম্বর গর্তে ফেলে দেওয়া হতো। একবার বিপক্ষ দলে আমার এক ভাই পড়ে গেছিল। আমি তখন কাঠের একটা গাড়িতে চড়ে চলাফেরা করতাম আর আমার সেই ভাই এর ছিল তিনটা পা। আমাকে বাগে পেয়ে সে ছেড়ে দিতে চাইলে আমি খুব অবাক হয়েছিলাম।

তবে আমি তাকে ছাড়িনি। কাঁটার বন্দুকের সবকটা কাঁটা ওর পুরুষাংগে গেঁথে দিয়েছিলাম, আর ওর চিৎকারের শব্দ আমাকে বহুদিন শান্তির ঘুম দিয়েছিল। " তিনকুঁজওয়ালা ফের বাচ্চা নিয়ে প্রশ্ন করে; "এরপরে আর কোন বাচ্চা হয়নি? এখনতো কারো বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনাও নাই। সংগম প্রনালিই তো ভুলে গেছে সবাই। ছেলেদের কারো লিংগ এতো বিশাল আর পুঁজময় যে ধারন করতে পারে এমন মেয়ে খুঁঝে পাওয়া যাবে না, আবার কারো কারো সেটা নায়ই।

মেয়েদের অবস্থা মনে হয় একটু ভালো। আমার সাথে যে মেয়েটা থাকত, ও মাঝে মাঝে বলত বাচ্চার কথা। ও নাকি মাঝে মাঝে স্বপ্নে বাচ্চা দেখতো!" "হাহ! বাচ্চা!" তাদের তিনজনের কথার সুতো একে অপরের সাথে বুনতে বুনতে ১ নম্বর গর্তের ঢালের কাছে আসলে হঠাৎ ঢলে পড়া নিরাবতায় তার তিনজনেই কিছুটা হকচকিয়ে যায়। শেষে বাক্সভর্তি মাংশ বলে; "আমরা কি চলে এসেছি?" তার কথাগুলো ভাংগা ভাংগা আর অস্পস্ট শোনায়, গন্তব্যের কানায় এসে শেষ বারের মতো উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। "আমি তো চোখে দেখি না।

তোমাদের দেখতে পেলে ভালো লাগতো। আমাকে গর্তে ফেলে দেওয়ার পর বাক্সের তলে একটা ন্যাকড়ায় প্যাঁচানো প্রচিন বইয়ের পাতাগুলো নিয়ে নিও। ঐ পাতাগুলোতে আমাদের পুর্বপুরুষের ছবি আছে, দেখ তারা কেমন ছিল দেখতে। " বাকি দুজন এতে আগ্রহি হয় না। তারা গর্তের কিনারে দাঁড়িয়ে এর বিশালত্ত দেখে, দেখে নিস্পৃহ হা'য়ের ভেতর শহরের পোয়াটাক ঢুকে যাবে অনায়াসে আর গর্তের তলে আঁধারের সাথে পাক খেয়ে উঠছে মরচে রংগা মেঘ।

তাই দেখে তিনকুঁজওয়ালার মুখে বহুদিন বাদে শুকিয়ে যাওয়া লালা জেগে উঠতে চায়। সে বলে; "তুমি জানো এই গর্তটা কিভাবে হয়েছে এখানে? আকাশ থেকে পাথর পড়ে? যে পাথরগুলো শহরের প্রাচিন বাড়িঘরগুলো ভেংগে দিয়েছিল? গর্তের তলটা দেখায় যায় না, এতো গভির! খুব বড়ো পাথর ছিল মনে হয়। " "এটা বুড়োদের গর্ত। " বামচোখে গর্তওয়ালা বলে। "কী আসে যায় গর্তই তো! আচ্ছা, একটু খেয়াল করো তো, গর্তের ভেতর থেকে কেমন শব্দ আসছে না!" বলে কান পাতে সে।

অন্যজনও কান পাতে এবং তার বামচোখের গর্তের শুন্যতায় কাঁপন ওঠে। "আরে পাগল, শব্দটা গর্তের ভেতর থেকে আসছে না! এটা সেই ভ্যানের শব্দ, যেটা অন্য শহর থেকে আগে খাবার নিয়ে আসতো!" তারা দুজনের শরীরের প্রতিকুলতা ছাপিয়ে একরকম স্রোত ওঠে, যেটার সাথে তারা আগে কখনই পরিচিত ছিল না এবং সেই স্রোতের ধাক্কায় তারা ১ নম্বর গর্তের ঢাল বেয়ে গড়াতে থাকে। আর বাক্স ভর্তি মাংশ উথলে চিৎকার ছড়িয়ে পড়ে; "এই তোমরা কই যাও?! আমাকে গর্তে ফেলবে না? কই যাও তোমরা?" (দ্বিতীয় পর্বে সমাপ্য)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।