আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্বার্থপর

বৃথা হয়রানি একবছর পত্রিকায় চাকরি করেছিলাম। বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। মেঘ নাই বৃষ্টি নাই হঠাৎ জানালার কাঁচ ঘামতে শুরু করেছে, ব্যুরো চিফের চিৎকার, স্টোরি বানাও। দু’কাপ বৃষ্টি হয়েছে, ছ’চামচ বালু উড়েছে। চিৎকার।

স্টোরি বানাও। মালগাড়ির পা হড়কেছে; দুটো ডাব্বা কাঁৎ। ফের চিৎকার। স্টোরি বানাওÑ। আমরা মুচকি হেসে দুয়েকটা ফোন করি; তারপর দিব্যদর্শনের ওপর ভর করে গটগট লিখে যাই।

হয়ে গেল স্টোরি। স্টোরিগুলো পাঠক পড়ে। রসগোল্লা চোখ করে মাথা ঝাঁকায়: গভীর চেন্তার ব্যাষয়! এসব হচ্ছে রুটিন স্টোরি। মেন্নত কম কিন্তু পাতা ভরে। ইদানীং দেশের টিভি চ্যানেলগুলো দেখে আমার আবার সেই ‘স্টোরি বানাও’ ডাকটা কানে বাজে।

গত একমাসের নিউজগুলো একটু রিপ্লে করে দেখুন। প্রতিদিন চ্যানেলগুলোতে একই খবর। দ্রব্যমূল্য আর মহাসড়ক। ৪০ টাকার শশা ৮০ টাকায়.... বাণিজ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি .... গৃহিনী সালেহা বেগম বলেন....। এই নিয়ে ৪ মিনিট।

তারপর পরিবহন ব্যবস্থা। ঢাকা-ময়মনসিং মহাসড়কে... অতিরিক্ত ভাড়া আদায়... রেলওয়ের ইঞ্জিন সংকট... সদরঘাটের জাহাজগুলো বরাবরের মতো...। আরো ছ মিনিট। গেল ছ আর চারে দশ মিনিট। খাবার পর শুরু জাবর কাটা।

বিশেষজ্ঞদের মতামত, মানববন্ধন, কঠোর কর্মসূচির আহ্বান, মন্ত্রীর রাগী রাগী অথবা হাসি হাসি মুখ। এই নিয়ে আরো দশ মিনিট। এর ফাঁকে আবার বিজ্ঞাপন। এই হুড়োহুড়ির মধ্যে খুচরা যে দু’চার মিনিট বাঁচে তাতে র‌্যাবের মাদক উদ্ধার আর ডিবির পলাতক আসামী গ্রেফতারের খবর। হয়ে গেলো তিরিশ মিনিটের প্রাইম নিউজ।

বাচ্চা লোগ তালিয়া লাগাও। চমৎকার সাংবাদিকতা। যেন সায়দাবাদ-কারওয়ানবাজার আর গাবতলী-মতিঝিলই বাংলাদেশ। মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। থুড়ি মুখ ঢেকে যায় ঢাকায়।

এর বাইরেও তো বাংলাদেশ আছে। ৪০ টাকার শশা ঢাকার মানুষ ৮০ টাকায় কিনলেই নিউজ। শশা নিয়ে আমরা শশব্যস্ত হয়ে ওঠি। চিৎকার করি। বাণিজ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাই।

কিন্তু পদ্মাচরের কৃষক যখন ৪০ টাকার শশা ৪ টাকাতেও বিকোতে পারে না, রক্ত-জল-করা ফসল চোখের জল ফেলতে ফেলতে গরুকে দিয়ে খাওয়ায়, তখন হয়ত ছোট্ট করে নিউজ হয়; কিন্তু আমাদের কোন প্রতিক্রিয়া হয় না। কোন আওয়াজ ওঠে না। যেখানে আমাদের স্বার্থ সেখানেই আমরা তৎপর। সোনারগাঁ’র সামনে থেকে অবলীলায় দশ টাকায় পাঁচ হালি লেবু কিনে নেই। ভুলেও ভাবি না কী করে কৃষকের পরতায় পোষে।

আবার দেখবেন বাজারে যখন কোন কিছুর সংকট তখন ওটা কেনাতেই হিড়িক পড়ে যায়। ওই মুহূর্তে ওটাই চাই। একেবারে অবোধ শিশু। স্বাভাবিকভাবে সে সুযোগ নেয় ব্যবসায়ীরা। রোজায় কী যুদ্ধই না হলো তরল দুধ নিয়ে।

কিন্তু কিছুদিন আগেও ক্ষুদ্রখামারীরা বাজারে গিয়ে দুধের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে সড়কে দুধ ঢেলে বাড়ি ফিরেছিল। তখন কোথায় ছিল দুগ্ধপ্রেমী বাঙালী। আমরা সবাই যদি দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্যের ব্যবহার বাড়িয়ে দিতাম, স্বাভাবিকভাবে চাহিদা বাড়ত; দামও। হিমাগারের অভাবে মুন্সিগঞ্জের কৃষক যখন আলু ফেলে দিচ্ছিল নদীতে, তখন তো আমরা বলতে পারতাম, একবেলা ভাত না খেয়ে আলু খাই। কৃষক বাঁচুক।

পরগাছার মতো আমরা শুধু আমাদের ক্ষিধা মেটাতেই ব্যস্ত। মূল বৃক্ষ তথা দেশটার কী হলো তা নিয়ে কোন ভাবান্তর নাই। আমাদের মধ্যবিত্তের চিনি আর তৈল নিয়ে আদিখ্যেতার অন্ত নেই। একেবারে বামুনের পৈতে। ধরলেই রে রে করে উঠি।

অথচ চিনি নামক বস্তুটা ছাড়া দিব্যি দিন কাটানো যায়। আমাদের মূল খাদ্য ভাত ও তরকারিতে চিনির কোন ব্যবহার নেই। চিনি যা লাগে চা আর নাস্তাতে। চিনির দাম যখন বেড়ে যায় ওই সময়টাতে মিষ্টিজাতীয় নাস্তা না খেলেই তো হয়। ক’দিন না হয় স্যাকারিনের চা-ই খেলাম।

কী, আমার বক্তব্যটা বাণিজ্যমন্ত্রীর মতো হয়ে গেলো কিনা! ভাই, আজ আপনাকে ওই চেয়ারে বসালে আপনিও কিন্তু একই সুরে কথা বলবেন। গত কেবিনেটের অর্থমন্ত্রীও একইরকম মন্তব্য করে বিপদে পড়েছিলেন। প্রশ্ন হলো কেন? আমাদের মতো অসংযমী জাতি বোধহয় পৃথিবীতে কমই আছে। দেশ যাক গোল্লায়, কিন্তু আমার ভোগ-বিলাসের কমতি হতে পারবে না। এভাবে চললে যতই সরকার পাল্টাক, যতই মাথাপিছু আয় বাড়–ক কখনোই আমরা একটা আত্মনির্ভর জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পারব না।

নিজেকে জয় করলেই বিশ্বজয় হয়। যে জাতি নিজেদের জয় করেছে তাদের আলাদা করে আর বিশ্বজয়ে নামতে হয়নি। কোরিয়ার প্রচন্ড খাদ্যসংকটের সময় লোকজন গাছের পাতা খেয়ে বেঁচেছিল। ভিয়েতনামের মানুষ যুদ্ধের সময় পোকা মাকড় খাওয়া শিখেছিল; বাঁচার তাগিদে। এরা সরকারকে দুয়ো দিতে যায়নি।

নিজেদের অবস্থা বিবেচনায় এনে নিজেরাই বাঁচার পথ খুঁজে নিয়েছিল। তাই তো ষাটের দশকে এদেশগুলো আমাদের পেছনের সারিতে থাকলেও আজ তারা আমাদের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এবার মহাসড়কের বেহাল দশা নিয়ে কী হৈচৈ! বছরে দুটো ঈদ। আমরা তো বলতে পারতাম এই ঈদটা নাহয় ঢাকায় কাটাই পরেরটাÑ। তখন যদি রাস্তা ঠিক না হয়, সরকারকে ধরা যাবে।

কিন্তু সেই ধৈর্য্য নেই। আমরা সব চাই; এখখুনি চাই। আরেকটা কালচার দাঁড়িয়ে গেছে সবকিছুতে সরকারকে জড়ানো। সবকিছুই সরকার করে দেবে। আবার পরক্ষণেই নাক সিঁটকে বলবে, সরকারের আকার এতো বড়ো কেন? মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগ।

সরকার কেন কলকারখানা চালাবে? ব্যবসা করবে? সব ছেড়ে দাও প্রাইভেট সেক্টরে। সরকার যেন হাত-পা বেঁধে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। আমাদের দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য ৫ লাখ সরকারি কর্মচারি (প্রতিরক্ষা বাদে) আছে। আর ফ্রান্সের ৫ কোটি মানুষের জন্য ২০ লাখ সরকারি কর্মচারি। অথচ উনারাই বলেন আমাদের মাথাভারী প্রশাসন।

আর আমরা মাথামোটারা সেই কথায় ফাল পাড়ি। সেদিন মঞ্জুরুল হকের একটা লেখা পড়লাম। তারা ভাষাতেই শুনুন: ... সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়ার পর প্রথম ভিয়েতনামিদের দেখার সুযোগ হয়। দেহের গঠন, চালচলন ও সাজপোশাকের দিক থেকে একবারে সাদামাটা। ভিযেতনামি নারী-পুরুষ প্রথম দেখায় আমাদের মধ্যে কোনোরকম চমক জাগাতে পারেনি।

তবে অচিরেই আমরা তাদের দৃঢ় মনোবল ও বলিষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্যের পরিচয় পেয়েছি। সোভিয়েত ইউনিয়নে মাসে ৯০ রুবল বৃত্তি এবং সেই সঙ্গে নিখরচায় লেখাপড়া করা ও হোস্টেলে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা। একপর্যায় আমাদের মধ্যে কয়েকজন সেই অর্থে পেট চলে না উল্লেখ করে মাসোহারার পরিমাণ বাড়ানোর আবেদন করে কর্তৃপক্ষের কাছে। কর্তৃপক্ষ তাদের সামনে ভিয়েতনামি ছাত্রদের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে ওই আবেদন ভালোভাবে বিবেচনা করে দেখার পরামর্শ দেয়। ভিয়েতনামি ছাত্ররাও বছরখানেক আগে অন্য এক আবেদন নিয়ে কর্তৃপক্ষের শরণাপন্ন হয়েছিল।

সেই আবেদন হলো, তাদের মাসে ৯০ রুবলের বদলে যেন ৭০ রুবল করে স্কলারশিপ দেওয়া হয়। এর ফলে যে অর্থ বাড়তি থেকে যাবে, সে অর্থে যেন ভিয়েতনাম থেকে আরও কিছু ছাত্র নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা যায়। কী বুঝলেন, আমরা খুব স্বার্থপর, তাই না? ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.