আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঘাতক

আমি লেখক খারাপ হতে পারি কিন্তু ছেলে ভাল রাকিব সাহেবের হাত কাপছে, গলা শুকিয়ে আসছে। তিনি এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তার সামনে খোলা বিশাল একটা টেলিফোন গাইড। বার বার তিনি ফোনে রমনা থানার ওসি কে ধরতে চেষ্টা করছেন, কিন্তু প্রতিবারই তার নম্বর এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বড় করে একটা ঢোক গিলে তিনি লিনার লাশটার দিকে আবার তাকালেন।

নাহ, কল্পনা নয়। লাশটা এখনো আছে। ওইতো পরে আছে তার সোফার ওপর। ঘরে ঢুকেই স্ত্রীর মৃতদেহটিকে সোফার ওপর আবিষ্কার করেন তিনি। জলজ্যান্ত যে মানুষটাকে ঘরে রেখে আজ সকালে অফিসে গিয়েছিলেন, সন্ধায় ঘরে ফিরে তাকে পেলেন মৃত অবস্থায়।

গলায় পেচানো একটা নাইলনের রশির ফাঁস। বোঝা যাচ্ছে ওই ফাঁস দিয়েই শ্বাস রুদ্ধ করে তাকে হত্তা করা হয়েছে। পঞ্চম বারের চেষ্টায় তিনি থানায় ফোন করতে সমর্থ হলেন। ভাঙা গলায় কোনমতে খুনের ঘটনাটি জানালেন। তারপর ফিরে এলেন স্ত্রীর লাশের কাছে।

দুহাতে মৃতদেহটিকে জরিয়ে ধরে অদম্য কান্নায় ভেঙে পরলেন লিনা লিনা লিনা.। .। .। । ******* মনরোগ বিশেষজ্ঞ ড জিয়াউল হক যত্ন করে কাচ মুছে চশমাটি আবার চোখে দিলেন।

তিনি এই মুহূর্তে বসে আছেন রমনা থানার ওসি সাহেবের রুমে। রাত দশটার দিকে পুলিশ গিয়ে একরকম জোর করেই তাকে বাসা থেকে তুলে এনেছে। ডিনার করতে বসেছিলেন, শেষ করতে পারেননি। থানায় আসার পর এক কাপ চা দেয়া হয়েছিল। আশ্চর্যজনক ভাবে চাটা ছিল অমৃতের মত।

এক কাপ শেষ করে আর এক কাপ খেতে ইচ্ছে করছিল। এখন তাকে এই খালি রুমটায় গত আধা ঘন্টা ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। ওসি সাহেব এখনও দেখা করেননি। ড জিয়ার কোলের ওপর একটা ডায়রি খোলা। গত আধা ঘণ্টা ধরে তিনি ডায়রিটি পড়ে যাচ্ছেন।

চশমার কাচ পরিশকার করে তিনি আবার ডায়রি পরায় মন দিলেন। " আমার নাম কবির। বয়স ৩৪। নাকি ৩৬?? জানি না। ।

ইদানিং অনেক কিছুই ঠিকঠাক মনে করতে পারি না, মাস চারেক ধরে এই সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে। " আমার নাম কবির। আমি একজন একাউনট্যাঁনট। আমার স্ত্রীর নাম নিলা। আমি আর আমার বউ থাকি সেগুন বাগিচার ৩৬ নম্বর বাড়িতে।

আমাদের কোন ছেলেপুলে নেই। আমরা অনেক ট্রাই করেছি, লাভ হয়নি। " আমার নাম কবির। আমার জন্ম ভোলা জেলার চৌমুহনী গ্রামে। আমার স্ত্রীর নাম নিলা।

। তার জন্ম ঢাকাতে। " আমার স্ত্রীর নাম নিলা। সে আমার দেখা বাংলাদেশের সবচে সুন্দরি মহিলা। আমি আমার স্ত্রিকে অনেক ভালবাসি।

সে ভালবাসা যে কতটা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। " আমার স্ত্রীর নাম নিলা। সে টক খেতে পছন্দ করে। বল্ধা গার্ডেন তার সবচে প্রিয় জায়গা। আমি বল্ধা গার্ডেন পছন্দ করি না।

টক খেতেও পছন্দ করি না। কিন্তু আমি আমার স্ত্রিকে ভীষণ ভালবাসি। " আমার নাম কবির। আমার স্ত্রীর নাম নিলা। সে অন্তসত্তা।

দু'মাস চলছে। আমরা ভীষণ খুশী। " নিলা আন্তসত্তা। দুমাস চলছে। শেষ কবে আমি ওর সাথে শুয়েছিলাম? জানি না।

ইদানিং অনেক কিছুই ঠিকঠাক মনে করতে পারি না, মাস চারেক ধরে এই সমস্যাটা দেখা যাচ্ছে " আজ খাটের নিচে একটা সিন্দুকে অনেকগুলো পুরনো চিঠি খুজে পেলাম। রকিব নামে কেউ একজন বিল্কিসকে এই চিঠিগুলো লিখেছে। সবগুলই প্রেমের চিঠি। এই রকিবটা কে? " আমার নাম কবির। আমি আমার স্ত্রিকে অনেক ভালবাসি।

সে অন্তসত্তা। কেন সে অন্তসত্তা? আমিতো কিছু করিনি। আমার স্ত্রীর জিবনে কি দ্বিতীয় কেউ আছে? " আজ নিলার মোবাইল ফোনে রকিব নামে একজনের নম্বর দেখতে পেলাম। সে কি আবার রকিবের সাথে যোগাযোগ করছে? "আমার নাম কবির। আমার স্ত্রীর নাম নিলা।

সে একজন বিশ্বাসঘাতক। রকিব নামে একজনের সাথে তার সম্পর্ক আছে। আমি প্রমান পেয়েছি আমার অনুপস্থিতে সে নিয়মিত রকিবের সাথে আমার বাসায় মিলিত হয়েছে। " আমি এখন নিশ্চিত। নিলার সন্তানের বাবা আমি নই।

আমি আমার স্ত্রিকে ঘৃণা করি। " আমার নাম কবির। আমি আমার স্ত্রিকে ঘৃণা করি। আমার নাম কবির। আমি আমার স্ত্রিকে ঘৃণা করি।

" ড জিয়া হাতের ডায়রিটা বন্ধ করে জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। ******* রকিব সাহেব রমনা থানার ওসির অফিসে বসে আছেন। পুলিস এসে লিনার ডেডবডি নিয়ে গেছে। পুলিস এখন তার বাসাটা সার্চ করছে। ওসি সাহেব তাকে থানায় নিয়ে এসেছেন কিছু ফর্মালিটি সারার জন্য।

তিনি এখন টেবিলের ওপাশে বসে মনযোগ দিয়ে একটা ফাইল পরছেন। ওসি সাহেব হাতের ফাইলটা থেকে নজর তুলে বললেন " আচ্ছা রকিব সাহেব, আজ আপনি ঠিক কখন বাড়ি ফিরেছেন?" " এইতো আটটা-সোয়া আটটার দিকে। আমি ইতিমধ্যে একবার বলেছি" রাকিব সাহেব জবাব দিলেন। " আপনি কি সব সময় এই টাইমেই বারি ফিরেন?" "সবসময় না। এক এক দিন এক এক টাইম এ।

" "আপনি কি নিশ্চিত আজ আপনি রাত আটটার দিকে বারি ফিরেছেন?" "হ্যাঁ, আমি নিশ্চিত। " "বাড়ি ফিরে আপনি প্রথম কি করলেন?" "ঘরে ঢুকেই সোফার ওপর লিনাকে দেখতে পেলাম" "তারপর?" "তারপর.। .। তারপর থানায় ফোন করলাম। " আপনি কি বাড়ি ফেরার পথে আর কোথাও গিয়েছিলেন?" "নাহ, আমি অফিস থেকে সোজা বাসায় এসেছি।

" "আমরা আপনার অফিসে যোগাযোগ করেছি, সেখান থেকে জানা গেছে আপনি বেলা চারটায় অফিস থেকে বের হয়েছেন। বাকি সময়টা আপনি কোথায় ছিলেন?" " কোথাও না, আমি সোজা বাসায় ফিরেছি। " " আপনার বাড়ি ফিরতে নিশ্চয়ই এত সময় লাগার কথা নয়। " "আ আমি জানি না। " "আপনি কি বিল্কিস নামে কাউকে চেনেন?" "নাহ" "কবির নামটি কি আপনার পরিচিত?" "নাহ, এই সব কেন জিজ্ঞাসা করছেন?" "আপনার প্রতিবেশী বলছেন আপনি আজ বিকেল পাঁচটায় বাড়ি ফিরেছেন।

" "নাহ, তাদের নিশ্চয় ভুল হচ্ছে, আমি বাড়ি ফিরেছি রাতের বেলা। " "আপনার স্ত্রীর লাশের পাশে যে নাইলনের রশির ফাঁসটি পাওয়া গেছে, আপনি কি সেটা স্পর্শ করেছিলেন?" "না" "কিন্তু আমরা ওতে আপনার হাতের চিহ্ন পেয়েছি। " "কি বলছেন এইসব?" ঘরে একজন মাঝ বয়েসি ভদ্রলোক প্রবেস করলেন। তার চোখে ভারি চশমা। ওসি সাহেব তাকে দেখিয়ে বললেন, " ওনার নাম জিয়াউল হক।

উনিএকজন মনরোগ বিশেষজ্ঞ। আপনি কি তাকে চেনেন?" "নাহ, উনাকে আমি কিভাবে চিনব?" "ঠিক আছে, মি রাকিব। আপনি আরেকটু অপেক্ষা করুন, আমি এক্ষুনি আসছি। " ওসি সাহেব ও ড জিয়া ঘর থেকে বের হয়ে এলেন। ড জিয়া মাথা নেড়ে বললেন "আমি যা ভেবেছিলাম, অবস্থা তার থেকেও অনেক সিরিয়াস।

" "পুরো ব্যাপারটা খুলে বলুন তো ডকটর। " "আমি গত এক বছর ধরে মি রাকিবের চিকিৎসা করে আসছি। তিনি একটি ভয়ঙ্কর মানসিক রোগে ভুগছেন। এর নাম multiple personality disorder। এই রোগের অন্নতম লক্ষন হল রুগির মাঝে একাধিক চরিত্র বা সত্তা সৃষ্টি হয়।

এই সত্তাগুলো পালাক্রমে রুগির শরীরের দখল নিয়ে নেয়। একটি সত্তা যখন ঘুমিয়ে পরে তখন ওপর সত্ত্বাটি জেগে উঠে। সমস্যা হল একটি সত্তা কিছুতেই তার ওপর সত্ত্বাটি সৃতিতে প্রবেশ করতে পারে না, অর্থাৎ একটি সত্তা জেগে উঠার পর সে আগের কিছুই মনে করতে পারে না। মি রকিবের মধ্যে যে অলটার ইগো বা দ্বিতীয় সত্ত্বাটি সৃষ্টি হয়েছিল তার নাম কবির। লক্ষ করলে দেখবেন রকিব আর কবির একই নাম।

তার অলটার ইগোটি মনে করতে থাকে তার স্ত্রীর নাম নিলা যা কিনা লিনা নামটিরই আরেকটি রুপ। সে সন্দেহ করতে থাকে তার স্ত্রীর সাথে রকিব নামে কারও সম্পর্ক রয়েছে। কবির জানে না যে সে আর রকিব একই বেক্তি। সে এটাও সন্দেহ করে যে তার স্ত্রীর সন্তানের বাবা সে নয়। সে তার স্ত্রীর সাথে মিলনের সৃতি মনে করতে পারে না।

কারন সেই সময়টায় তার মাঝে রকিব নামক সত্ত্বাটি জাগ্রত ছিল। অবশেষে স্ত্রীর প্রতি প্রবল সন্দেহ থেকে সে তাকে খুন করে। কিন্তু রকিব সাহেব খুনের সৃতি মনে করতে পারছেন না। কারন খুন করার সময় এই সত্ত্বাটি ছিল ঘুমন্ত। তবে রাকিব বলুন আর কবির বলুন, তিনি নিজেই তার স্ত্রীর হত্যাকারী।

কবিরের লিখে যাওয়া ডায়রিটাই তার প্রমান। " ওসি সাহেব লম্বা দম নিয়ে বললেন "আমি আমার পনের বছরের চাকরি জিবনে এমন কেস আর পাইনি। " "মানব মন যে কত বিচিত্র হতে পারে তার কোন সিমা পরিসিমা নেই। " ড জিয়া মন্তব করলেন। ***** রাত সারে বারোটায় ড জিয়া থানা থেকে বের হয়ে এলেন।

তিনি একটি স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লেন। যাক, শেষ পর্যন্ত সব কিছু ভালয় ভালয় শেষ হল। আজ থেকে এক বছর আগে প্রথম রকিব সাহেবকে নিয়ে তার স্ত্রী লিনা ওনার চেম্বারে যান। লিনাকে প্রথম দেখেই ড জিয়া স্তম্ভিত হয়ে পরেন। একটা মানুষ এত সুন্দর হয়! রকিব সাহেবের চিকিৎসা করার সুযোগে ধিরে ধিরে তিনি লিনার সাথে একটা সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

বেশ কয়েকবার একত্রে রাত্রি যাপন করেন। কিন্তু সমস্যা হয় তখন যখন লিনা প্রেগন্যান্ট হয়ে পরে। লিনা তাকে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করে, হুমকি দেয় সব কিছু ফাঁস করে দেবে। ড জিয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মনরোগ চিকিৎসক। এই ধরনের স্ক্যানডাল তার ক্যারিয়ারকে শেষ করে দিতে পারে।

ড জিয়া অত্যন্ত সাবধানে এগুলেন। তিনি লিনার উন্মাদ স্বামীকে বুঝালেন লিনা অন্ন কারও সাথে সম্পর্কে জরিয়ে পড়ছে এবং সেই অন্ন কেউটা হল রকিব। তিনি একজন অত্যন্ত দক্ষ সাইকিয়াট্রিসট। অত্যন্ত সুচারু ভাবে তিনি রকিবের চিন্তা ভাবনার দখল নিয়ে নিলেন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কবিরের মনে স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ বদ্ধমুল করতে সক্ষম হলেন এবং তার মন স্ত্রীর প্রতি বিষিয়ে তুললেন।

অবশেষে যা হবার তাই হল। স্ত্রীর প্রতি সন্দেহ থেকে উন্মাদ রকিব লিনাকে খুন করল। অথচ কেউ জানল না তার স্ত্রীর সাথে সত্যি দ্বিতীয় একজনের সম্পর্ক ছিল। A very good plan well executed মুচকি হেসে ড জিয়া বাড়ি ফেরার জন্য ট্যাক্সি খুজতে লাগলেন। (যারা মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার রোগটির সাথে পরিচিত নন তাদের কাছে এই গল্প গাজাখুরি মনে হতে পারে।

তাদের জন্য নিচে উইকি লিঙ্ক দেয়া হোল। লেখক) Click This Link ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।