আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জিলাপি

মনের এলোমেলো ভাবনাগুলোকে শব্দের ফ্রেমে বাঁধার এক অপচেষ্টা। আমি কাল বাসা থেকে পালাচ্ছি। আর বারো ঘণ্টার মধ্যেই আমি নাই হয়ে যাবো। এখন নিশ্চয়ই আমার খুব ভয় লাগার কথা, কোথায় যাবো, কিভাবে পালাবো, পালানোটা ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার মধ্যে কোন ভয় ডর কাজ করছেনা।

উল্টো আমার কেমন যেন আনন্দ আনন্দ লাগছে। এই পালানোর প্ল্যানটা আমার মাথা থেকেই বের হয়েছে। তৌসিফ তো একটা ছাগল। এইরকম বিশাল একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার মত কলিজা ওর ছোটখাটো শরীরে আটঁবেনা। উল্টো মিন মিন করে আমাকে বাড়ি পালানোর কুফল বুঝানো শুরু করেছিলো।

পরে আমার এক ঝাড়িতেই রাজি হয়ে গিয়েছে। ওর মত একটা ছেলে কিভাবে আমার প্রেমে পড়ে গেলো, আমি এটাই ভেবে পাইনা। যাই হোক বেচারার কপালে যা লিখা ছিল তাই হয়েছে। এমনিতে হয়তো পালানোটা খুব একটা দরকারী ছিলোনা। তৌসিফের কলিজার সাইজ যেমনই হোক, একেবারে উটকো ছেলে সে মোটেই নয়।

এখন হয়তো ছোটখাটো একটা চাকরি করে, কিন্তু ওর মত তেলতেলে আঁতেলদের তড়তড়িয়ে উপরে উঠতে দেরি হয়না। বাবা হয়তো তৌসিফকে দেখলে একটু কপাল কুঁচকাবেন, একটু নাক সিঁটকাবেন, তারপর একসময় ঠিকই রাজি হয়ে যাবেন। ঝামেলা বাঁধাবেন মা। এ পরিবারে কেউই তার ইচ্ছের বাহিরে যাওয়ার অধিকার রাখেনা, বাবাও নয়। আমার মায়ের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে দেয়া।

সৎমা হিসেবে তার অবশ্য আরো খারাপ হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু হতে পারেনি। এর কারণটাও আমার বাবা। আমার বাবা মানুষটা কি পরিমান ভালো, সেটা বুঝানোর জন্য পৃথিবীর কোন ভাষায়ই যথেষ্ট পরিমানে শব্দ নেই। বাবার ভেতরটা পুরোপুরি দুইভাগে ভাগ করা। একটা ভাগ হলো রহস্যময়, নানা অজানা কারনে বাবা আমার সৎমাকে খুব ভয় পান।

আর আরেকটা ভাগ হোল ভালবাসাময়, বাবা আমাকে অদ্ভুত রকমের ভালোবাসেন। খুব ছোটবেলায়ই আমি মাকে হারিয়েছিলাম, মায়ের ছবিগুলো দেখে বুঝেছি আমার চেহারাটা অনেকটা মার মতোই হয়েছে। এই কারনেই হয়তো বাবা আমাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশীই ভালোবাসেন। কিন্তু কখনই আমার সৎমার সামনে প্রকাশ করতে পারেন না। এই দুইভাগে বিভক্ত বাবার জন্য বেঁচে থাকাটা নিশ্চয়ই অনেক কষ্টের।

কিন্তু বাবার জন্য আমার কখনো কষ্ট লাগেনা। আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। খুব ইচ্ছে করে বাবার উপর একটা প্রতিশোধ নিতে। এই যে আমি পালিয়ে যাচ্ছি, এতে কারো কিছু আসে যায়না। আমার সৎমা উল্টো খুশী হবেন, যাকে বলে দানবীয় খুশী।

শুধু কষ্ট পাবেন আমার বাবা, ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে যাবেন কিন্তু কাউকে কিছু বলবেন না। আমাকেও নয়। তৌসিফও অনেকটা বাবার মতো, তাদের কলিজায় ভালবাসার মতো বিশাল একটা জিনিসের জায়গা হয়ে যায়, অথচ ওটা প্রকাশ করার জন্য সামান্য সাহসের জায়গা হয়না। আমার রাগ হচ্ছে, প্রচণ্ড রাগ। মার সাথে সাথে আমিও মরে জাইনি,এটাই কি আমার অপরাধ? কেন ঘরের শান্তি রক্ষার জন্য এতোটা নিরীহ হতে হবে বাবাকে? টের পাচ্ছি মাথা গরম হয়ে আসছে আমার।

খুব দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছি। লক্ষণ ভালো না । নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছি । কিছু একটা ভাঙতে হবে। রাগে আমি মোবাইলটাকে আছাড় মারি।

কিন্তু মাটিতে নয়, খাটের উপরই আছাড় মারি। আমি কাল পালাচ্ছি, এখন বিশাল একটা সাসপেন্সের সময়, আমি রাগী ঠিক আছে কিন্তু এতটাও বোকা না যে এখন মোবাইল ভেঙে ফেলবো। তাইতো খাটের উপর নরম জায়গায় আছাড় মারা। রাগটাও কমলো, মোবাইলটাও জানে বেঁচে গেলো। উভয়পক্ষ রক্ষা।

রাত নয়টার দিকে বাবা আমার ঘরের দরজায় উঁকি দিলেন। আমি তখন পড়ছিলাম। শব্দ পেয়েই বইটা ছুড়ে ফেলে, একটা গল্পের বই হাতে নিলাম, উদ্দেশ্য বাবাকে রাগানো। কিন্তু সবসময়ের মতোই বাবা একটুও রাগলেন না। কিসের একটা প্যাকেট এনে টেবিলের উপর রাখলেন।

বোঝাই যাচ্ছে আমার সৎমার চোখে জিনিসটা অবশ্যই বৈধ নয়। আমি দেখেও দেখলাম না। বাবা ফিসফিসিয়ে বললেন, “মা তোর জন্য জিলাপি নিয়ে এলাম, তুই সেদিন বলছিলি না, এই কয়দিন অনেক খুঁজেছিলাম, ধারে কাছে কোথাও পাইনি, অনেক দূর থেকে আনতে হোল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিস মা, কেউ যাতে না দেখে”। বলেই বাবা এক রকম দৌড়ে পালালেন, বাবার সেই কেউ নামক আমার সৎমার ভয়ে। আমার আবছাভাবে মনে পড়ল কোন একদিন আমাদের কাজের মেয়েটাকে বলছিলাম আমার জিলাপি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

আমি এত দিনে ভুলেও গিয়েছি, কিন্তু বাবা ভুলেন নি, তিনি মনে রেখেছেন, খুঁজে খুঁজে এত দিনে জিলাপি নিয়ে এসেছেন, লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে এসে দিয়েও গেছেন। আমি জিলাপির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম। একটা মানুষ এতটা ভালবাসা বুকে চেপে রেখে কিভাবে বাঁচতে পারে? আমার অনেকগুলা প্ল্যানের মতো এই পালানোর প্ল্যানটাও ক্যান্সেল। এই মুহুর্তে এই কথা শুনে তৌসিফের চেয়ে বেশি খুশী আর কেউ হবেনা। বেচারা তো আগে থেকেই পালানোর টেনশনে আধমরা হয়ে ছিলো।

আমার বাবা মানুষটা খুব অদ্ভুত; অদ্ভুত এবং ভালো। এমন ভালো মানুষকে কষ্ট দিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কলিজা লাগে। আমার এত বড় কলিজা নেই। আর নেপথ্যের কারণটা হচ্ছে, আমিও আমার বাবাকে অনেক ভালবাসি, কিন্তু ভুলেও কখনো প্রকাশ করিনি। ---------------------------------------------------------------------------------- আমি কখনো কোন মা দিবসে আমার মাকে জড়িয়ে ধরে উইশ করিনি।

কখনো বলিনি, মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কোন বাবা দিবসেও বাবাকে গিয়ে বলিনি, আব্বু তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু তারপরও এই পৃথিবীতে এই দুইজন মানুষকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি। (প্রথম আলো ঈদ অনুগল্প সংখ্যায় প্রকাশিত) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।