আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শকুন

কিছুদিন আগে এক দৈনিক কাগজে পড়লাম-বাংলাদেশে শকুন বিলুপ্তির পথে। পর্যবেক্ষকদের মতে সারা দেশে নাকি মাত্র কয়েক শ’ শকুন রয়েছে। খবরে প্রকাম, এই মাংসাশী প্রাণীটির সংখ্যা হ্রাসের প্রধান কারণ হলো- খাদ্যাভাব, এস্থ্রাস রোগাক্রান্ত মৃত পশুর মাংস ভক্ষন ও বন জংগল উজাড় তথা- দেশের বড় বড় গাছপালা নিধন। এক কথায় খাদ্য ও বাসস্থানের অভাবে এদেশের শকুনকুর এখন রয়েছে দারুন অস্তিত্ব সংকটে। উপরোক্ত সংবাদ ফিচারটি দেখে আমার শৈশব কালের কথা মনে পড়ে।

আমার জন্ম দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ী থানাধীন বেতদিঘি গ্রামে। বাল্যকালে দেখেছি- গ্রামে গরু মহিষ ছাগল যারা গেলে সেখানে শতাধিক শকুনের সবাবেশ ঘটতো। সে সময় আমাদের গ্রামে অনেকগুলো বড় বড় বয়স্ক বট, পাকুড়, আম ও শিমুল গাছ ছিল। ঐ বড় গাছগুলি ছিল শকুন পরিবারের চিহ্নিত বাসস্থান। যেকোন দিন ঐ সব গাছের নিকটে গেলে শকুনের উপস্থিতি টের পাওয়া যেতো।

উঁচু ডালে বসতো, বিশ্রাম নিতো, রাত্রি যাপন করতো। ঐ গাছগুলি এখন আর জীবিত নাই। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে অনেক আগে সেগুলি কেটে ফেলা হয়েছে। তাই শকুনকুল হয়েছে এখন গ্রামছাড়া। শকুন এর কথা লিখতে গিয়ে বাল্যকালের এক ঘটনা মনে পড়লো।

তখন সপ্তম শ্রেণীতে পড়ি। একদিন অপরাহ্নে একা নিকটবর্তী ‘তালতলি’ পুকুরপাড়ের বাঁশঝাড়ে বড়শির ছিপ্ পছন্দ করতে গেছিলাম। স্থানটি ছিল নির্জন। বাঁশ ঝাড়ের সাথে ছিল বড় এক আম গাছ। গাছের নীচে যেতেই হঠাৎ ডালপাতা নড়ার ঝাপ্টা শব্দ শুনে চম্কে উঠি।

উপরে তাকিয়ে ভয় পাই। দেখি, মোটা ডালে বসা ৪/৫ টি শকুন সাপের মত তাদের লম্বা গলা নীচে ঝুলিয়ে আড় চোখে আমাকে দেখছ্ েসাহস সঞ্চার করে জোরে- ‘হেই’ হেই’ শব্দ করে হাত উচিয়ে তাদের মারতে চাই। শকুন ছোট মানুষকে কমই ভয় করে। আমার হাকডাক শুনে একটু নড়েচড়ে লাফ দিয়ে উঁচু ডালে গিয়ে বসে। আমি কয়েকটি বড় টিল সংগ্রহ করে এলোপাতাড়ি গাছে ছুড়তে থাকি।

তখন তারা সম্ভবতঃ আমার প্রতি বিরক্ত হয়ে উড়াল দিয়ে নিকটবর্তী মুচিপাড়ার আর এক আম গাছে গিয়ে বসে। শুধু শকুন কেন, এখনকার বিরল প্রজাতির পাখিও আমাদের গ্রামের গাছগুলোতে দেখা যেত। ষাটের দশকে আমি গ্রামে ‘শিলা-পুকুর’ এর উঁচু বট গাছে ধণেশ পাখি দেখেছি। জোড়ায় জোড়ায় থাকতো। বটগাছ থেকে তালে তালে উড়ে উত্তর পাড়ের বড় জাম গাছে গিয়ে বসতো।

পাকা জাম বটফল তাদের প্রিয় খাদ্য। ধণেশ পাখির মত আরও দেখেছি ঈগল বা স্থানীয় ভাবে পরিচিতি ‘কুড়ল’ পাখি। গায়ের রং কালো, গলা সাদা। লেজের অংশ সাদা কালো। বর্ষাকালো সাপ, ব্যাংঙ্গ, মাছ ধরে খেতো।

বর্ষাকালেই এই পাখিটিকে বেশী দেকা যেতো। ধান ক্ষেত হতে পোষা পাতিহাঁস হো মেরে আস্ত ধরে নিয়ে যেতো। কখনও কাক বা চিল পিছু নিলে খোলা মেঘলা আকাশে ‘ডিকবাজি’ দিতে দিতে লম্বা ডানা মেলে দ্রুত পলায়ন করতো। তার বাজখাঁই চিৎকারে তখন ভাদ্র-আশ্বিনের বিস্তীর্ণ সবুজ ধান ক্ষেত প্রকম্পিত হতো। ঐ চমক লাগানো দৃশ্য এখন একেবারে অদৃশ্য।

কয়েক বছর আগে আমাদের গ্রামের দেকা একই প্রজাতির একজোড়া ধনেশ পাখি আমি কলকাতা আলিপুর চিড়িয়াখানায় দেখে এসেছ্ িআর ঈগল বা আমাদের গ্রামের ‘কুড়ল’ পাখি দেখি টিভির জীবজন্তুু বিষয়ক বিদেশী চ্যানেল গুলোতে। আবার শকুন প্রসংগ। এবার রাজশকুন। দেখতে সাধারণ শকুনের মত কুৎসিত নয়। দাড়কাকের মত গায়ের রং কালো।

গলা ও মাথা লাল। পাও লাল। তবে গলা ও পা সাধারণ শকুনের মত লম্বা নয়। বুকের অংশ সাদা। টাকমাথা, মাথার নীচে মোরগ সাদৃশ্য ঝুলন্ত লাল চামড়া।

রাজশকুন নাকি বাংলাদেশ থেকে একেবারে উধাও হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগে ঢাকা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের দেয়া খবরের কাগজের একটি বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে। বিজ্ঞাপনে একজোড়া রাজশকুনের জন্য এক লক্ষ টাকার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল। কেউ রাজশকুন সরবরাহ করে ঘোষিত পুরস্কার লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন কিনা সে সম্পর্কিত কোন খবর অবশ্য চোখে পড়েনি। গত ১৫/২০ বছর ধরে আমার ঢাকা চিড়িয়াখানায় যাওয়া হয়নি।

সেখানে এই বিরল প্রজাতির পাখিটি আছে কিনা আমার জানা নেই। বাল্যকালে দেখেছি গ্রামে কোন গরু মহিষ মারা গেলে মুচিরা এসে মৃত জন্তুুটিকে চার পাঁচ জনে মিলে মোটা বাঁশের লাঠিতে বেধে চ্যাংদোলা করে দূরে কোন মাঠে বা খালি জায়গায় নিয়ে যেতো। তারপর মৃতের চামড়া ছড়াতে শুরু করতো। ইতোমধ্যে সেখানে উঁচু আকাশ হতে ঘুরতে ঘুরতে নীচে মাটিতে নেমে শকুনকুল দলবেধে অদূরে উদ্গ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে থাকতো। শকুনের আকাশ থেকে মাটিতে নামার দৃশ্যটি সত্যি উপভোগ্য।

অবতরণকারী উড়োজাহাজের চাকার মত অনেক দূর হতে পাদুটি নীচে নামিয়ে দেয়। তারপর ধীর গতিতে ভূমিতে পা স্পর্শ করে কয়েক পা লাফিয়ে লাফিয়ে গিয়ে প্রসারিত ডানা দুটি সযতেœ মুড়িয়ে নিয়ে দাড়িয়ে যায়। আবার কতক গূধ্র প্লেনের জরুরী অবতরণ (ইবষষু খধহফরহম) এর মত উঁচু আকাশ হতে দ্রুত নেমে আসার জন্য সহসা গলা-ডানা-পা শুটিয়ে নিয়ে ঠোট-মাথা নিম্নমুখী করে ‘শো-শো’ শব্দে তীর বেগে সোজা নিরাপদ নিচুতে নেমে আসে। অত:পর মূহুর্তে ডানা দুটি স্বাভাবিকভাবে প্রসারিত করে ঐ অবস্থায় শূণ্যে কয়েক চককর দিয়ে পূর্বের বর্নণামত মাটিতে পা রাখে। ঐ দৃশ্যটি বেশী উপভোগ্য ছিল আমাদের কাছে।

চামড়া ছড়ানোর পর মুচিরা চামড়াসহ সরে আসা মাত্র অপেক্ষমান শতাধিক শকুন মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং মূহুর্তে সেটিকে কংকাল বানিয়ে ফেলতো। আমরা গ্রামের বালকদল অদূরে রাস্তায় দায়িয়ে এ দৃশ্য অবলোকন করতাম। সাধারন শকুনের সাথে দুই চারটি রাজশকুনও আসতো। এদের সংখ্যা কম। আমাদের গ্রাম অঞ্চলে এদেরকে ‘মোল্লা-শকুন’ বলা হতো।

আরও বলা হতো-মোল্লা শকুন এসে আগে “বিসমিল্লাহ” না করলে সাধারণ শকুন নাকি খাওয়া শুরু করে না। কিন্তু একথা ঠিক নয়। মোল্লা বা রাজশকুন ছাড়াই সাধারণ শকুনকে পশুর চামড়া ছড়ানো মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখেছি। বাল্যকালে মনে করতাম ‘মোল্লা-শকুন’ হলো পুরুষ আর অন্যসব শকুন হলো স্ত্রী লিংগ। পরবর্তিতে বড় হয়ে বই পুস্তুক পড়ে এভুল ধারণা কেটে যায়।

আসলে মোল্লা বা রাজশকুন হলো অন্য প্রজাতির। লক্ষ্য করেছি- এদের আকৃতি ও স্বভাব অন্য সাধারণ শকুন থেকে ভিন্ন। রাজশকুন ভীত ও চঞ্চল প্রকৃতির। একটু দূরে একা বা জোড়ায় জমির আইলে বা উঁচু কোন স্থানে দাড়াতো। আসতো সাধারণতঃ অন্য শকুনের পরে।

সাধারণ শকুনের মত মৃতদেহের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে গোগ্রাসে কাড়াকাড়ি, চেঁচামেচি, ডানা উচিয়ে মারামারি করে ভক্ষন করতে তাদেরকে দেখিনি। রাজশকুন কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সুযোগ বুঝে অপেক্ষাকৃত ধীরপদে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে যেতো। তারপর কয়েক ‘ঠোকর’ মেরে পিছু সরে এসে আগের জায়গায় দাড়াতো আর অন্য গোত্রীয়দের কাড়াকাড়ি মারামারি করে ভক্ষন পর্ব পর্যবেক্ষন করতো। অল্প কিছুক্ষণ পর চকিত চঞ্চল দৃষ্টিতে বাইরে অজানা স্থানে চলে যেতো। নাম রাজশকুন, আকৃতি, আচার, আচরণও যেন রাজার মত।

ভিআইপি অতিথির সাথে তুলনা করা চলে। অনুষ্ঠানের শেষভাগে আগমন। অল্পক্ষণ অবস্থানের পর কিছু না খেয়ে বা সামান্য কিছু মুখে দিয়ে ‘অন্য জরুরী প্রোগ্রাম আছে” বলে নীরব প্রস্থান। আসসোস। আমার শৈশব কিশোর কালে কাছে থেকে দেখা অতি পরিচিত সেই সুন্দর, নম্র, শান্ত স্বভাবের রাজশকুন পাখিটি আমার কিশোর-প্রৌঢ় কালের সময়ের ব্যবধানে সৃষ্ট বৈরী পরিবেশগত কারণে আজ এদেশ থেকে বিলুপ্তির পথে দৃষ্টির অন্তরালে চলে গেছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।