আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমার জীবন আমি ছড়াতে ছড়াতে এসেছি এখানে, কুড়াইনি তার একটিও ছেঁড়া পাতা, হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো!!

ভালবাসা মানে অন্যের ভালত্বে বাস করা আমার জীবন ছড়াতে ছড়াতে এসেছি এখানে, আমি কিছুই রাখিনি কুড়াইনি তার একটিও ছেঁড়া পাতা হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো, সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, আমি এই হারানো জীবন আর খুঁজিনি সেই ফেলে আসা পথে; সেদিন বিকেলে একাকী বারান্দায় চা এর কাপ এ চুমুক দিচ্ছিল মিলি। আনমনে ভাবছে চলমান জীবনের কথা। একটা কাক লাইটপোস্টের উপর বসে এদিক ওদিক দেখছে, কিসের আশায় কে জানে! দূরে দুষ্ট ছেলের দল ক্রিকেট খেলায় ব্যাস্ত। বিকেলের ম্লান রোদ সাঁঝের আগমনীবার্তা নিয়ে দরজায় কড়া নাড়ছে। পশ্চিম দিগন্ত লাল হয়ে আছে তার রঙের ছটায় গোধূলি মায়াময় হয়ে উঠেছে।

রাস্তায় অফিস ফেরত মানুষের ঢল। এমনি সময় ঘরের ভেতর টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দে সম্বিত ফেরে মিলির। ছুটে এসে তুলে নেয় রিসিভার। ওধার থেকে পুরুষালি কণ্ঠের হ্যালো শুনে কেঁপে ওঠে মিলি। - কাকে চান ? - তোমাকে।

- মানে কি? আপনি কে? - হা হা আমি ভাস্কর বলছি এবার চিনেছ? - হ্যাঁ কিন্তু আপনিতো বিদেশে? - এসেছি এইতো সেদিন, কেমন আছ মিলি? - ভালো। - শুধু ভালো আর কিছু নয়? পাঁচ বছর অনেক লম্বা সময় তাইনা মিলি? - হ্যাঁ। আপনি কেমন আছেন? - আবার আপনি? এই মিলি তুমি সত্যি চিনতে পারছনা? - পেরেছি। কিন্তু আপনি তুমি’র বেড়াজালে কি সম্পর্ক আটকে থাকে? এ ভাস্কর যাকে খুব ভালোবাসে মিলি। মনে পরে সেদিনের কথা, যেদিন জানাতে গিয়েছিল বাবা বিয়ে ঠিক করেছে, মিলি কি করবে? ভাস্করের নির্লিপ্ততা তাকে আহত করেছিল।

ভাস্কর জার্মানি যাবে তারই তোড়জোর চলছিল তার বাড়িতে। সেদিন সে-ই ওকে বলেছিল, ‘মিলি বিয়ে করে ফেল আমার জন্য বসে থাকিসনা। ’ এর পর আর কিছুই বলার থাকেনা। এত দিনের ভালবাসা একটা কথায় শেষ! যেনো পৃথিবীটা দুলছিল তার; নিজেকে কোন রকমে ওর সামনে থেকে সরিয়ে নিয়ে এসেছিল। খুব মন খারাপ নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল সেদিন।

নিজের ঘরে এসে খুব কেঁদেছিল। বাবা-মা ভেবেছেন বিয়ের কথায় মেয়ের মন খারাপ। মিলির বিয়ে হয়েছিল কিন্তু টিকলোনা। বছর না ঘুরতেই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল। ছেলের নাকি এই বিয়েতে মত ছিলোনা।

নিজের মনেই ভাবে তবে বিয়ে করা কেন? তারপর থেকে একাকী জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে মিলি। হঠাৎ ভাবনার ছেদ! - মিলি আছ কি? - আছি। - বলো তোমার কথা বলো। তোমার হাসবেন্ড, তোমার সন্তান এদের কথা বলো। - কিছু নেই।

- হাসবেন্ড কি করেন? - নেই তো? - মানে কি? হেঁয়ালি রাখো মিলি। - সে অনেক বড় গল্প, আজ থাক। বাড়িতে আমি আছি। আছে আমার ওই বিছানাটা যা খুব প্রিয়। আছে দখিনের জানালা, দিগন্ত বিস্তৃত নীল আকাশ।

ক্যালেন্ডারের নিচে লুকিয়ে থাকা টিকটিকিটা। খাঁচায় লাভবার্ড আর মুনিয়া। আর খুব সুন্দর একটা বেড়াল; এই তো বেশ! মানুষের সঙ্গ আমার ভাল লাগেনা। এরা সব আমার সঙ্গী। আপনি কেমন আছেন? ভাবিকে নিয়ে আসেন একদিন মায়ের ওখানে।

- হা হা মিলি আমি একা। তোমার ভাবি সেই এক্সিডেন্ট এর পর ছেড়ে চলে গেছে। - এক্সিডেন্ট? সে কি? কিসের এক্সিডেন্ট! - এখন ভালো আছি। একটা পা বাদ দিতে হয়েছে। একটা কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে।

অনেক কথা, থাক মিলি। আমি সেই আগের আমি নেই। সময়ের নিষ্ঠুর থাবায় আমি ক্ষত-বিক্ষত মিলি। এলাম মা’কে দেখতে। ১৫ দিন পর ফিরে যাব।

কাল পুরনো ডায়রি উল্টাতেই কিছু শুকনো গোলাপ পাপড়ি ঝরে পড়ায় খুলে দেখি তোমার চিঠি, সেখানেই তোমার নাম্বার পেলাম। তোমার যাপিত জীবনের কিছু কথা বলো মিলি। - হা হা যাপিত জীবন! ভালই বলেছেন। ভালো আছি। হাওয়ার সাথে লুকোচুরি খেলি।

মেঘের সাথে মিতালী আমার। ওই দূরে পাখিদের কাছে শুনি অনেক অনেক দূর দেশের গল্প, বলুন আর কিছু চাই কি? আর শ্রাবণ ধারায় হই সিক্ত, চাঁদনি রাতে একাকী গান শুনি। শুনি টিকটিকির টিকটিক, যেন প্রহরে প্রহরে জানান দিচ্ছে আমি আছি! আমি আছি! - এখনো দেখি আগের মতন আছ একটু পাগলাটে সরল। - ভাগ্যিস! বাচাল বলেননি। ভাস্কর, যে স্মৃতি দিয়েছি ভাসিয়ে ইছামতির জলে আজ কেন ডাকা তাদের বলেন? এইতো বেশ আছি খাচ্ছি-দাচ্ছি, ঘুমাচ্ছি, অফিস করছি।

আর হচ্ছে নিজের আত্মার সাথে কথোপকথন, "মনে রেখো মনে রেখো সখা যেনো কেউ আর মনে রাখিবে না। আজ সব দৃশ্য মুছে গেছে সম্মুখ থেকে। " এইতো বেশ তাই না? - বাহ বেশ গুছিয়ে কথা বলো তো? - সময় শিখিয়েছে যেমন আপনি শিখিয়েছিলেন। মনে পড়ে সেই জিয়া উদ্যানে বট গাছটার নিচে দু’জন বসে গোধূলির আলোয় বাদাম খাচ্ছিলাম আর কথার ফোয়ারা ছুটিয়েছিলেন। সেদিন আপনাকে খুব আপন লাগছিল!! ভাস্কর আমি সব ভুলে গেছি, কিন্তু এই কথাগুলো ঠিক মনে আছে।

আমাদের সেই কথোপকথন, সেই বাক্যালাপগুলি টেপ করে রাখলে পৃথিবীর যেকোন গীতিকবিতার শ্রেষ্ঠ সঙ্কলন হতে পারতো; হয়তো আজ তার কিছুই মনে নেই। আমার মনে সেই বাক্যালাপগুলি নিরন্তর শিশির হয়ে ঝরে পড়ে, মৌমাছি হয়ে গুনগুন করে স্বর্ণচাঁপা আর গোলাপ হয়ে ঝরতে থাকে। ভাস্কর, আমি ঠিক তেমন আছি। বিশ্বাস করুন এখন আর ভালো লাগেনা প্রেম ভালবাসার কথা শুনতে। আজ কেমন অচেনা লাগে সব।

আমিতো ছিলেম বেশ। কেন আপনি সব তছনছ করে দিলেন বলবেন কি? আমিতো সেদিন আমার সবটুকু নিয়েই দাঁড়িয়েছিলাম আপনার সামনে। কেন পারেননি নিতে আপন করে জীবনের সাথে বলেন তো ভাস্কর? না না আর কোনো দিন আমি যাবনা আপনার সামনে। - না না মিলি থাক পুরনো কথা। মিলি বিশ্বাস করো, তুমি কেমন আছ জানতে চেয়েছিলাম আর কিছু নয় তবু একটি বার আসবে কি? সেই সেদিনের মতন আকাশনীল বুটিদার শাড়িটি পরে এলোচুলে কপালে কালো টিপ।

আসবে মিলি? শুধু একটিবার দেখব তোমায়। মিলি কথা বলছ না কেন? কেঁদোনা মিলি, প্লিজ কেঁদোনা। বুকের ভেতর জমে থাকা বরফ গলতে শুরু করেছে এক্ষুণি লাফিয়ে পড়বে ঝরনা হয়ে। সবই আমাদের নিয়তি মিলি! - ভাস্কর, আমি সত্যি অপরাগ। ক্ষমা করবেন।

আমায় যেতে হলে সত্যভঙ্গ হবে। নিজের সাথে প্রতারণা করা হবে। প্লিজ কিছু মনে করবেননা আমি রাখছি। সেদিন মিলি আর কিছু বলতে পারেনি। শুধু কান্নায় ভেঙ্গে পড়তে পড়তে বলেছিল, ‘ভাস্কর, আমি খুব ভালোবাসি আজও তোমায়।

’ তারপর কয়েকটা দিন ঘোরের মধ্যে পার করলো মিলি। সেই মায়াময় গোধূলি, সেই মাধবী বিকেল, ছোট্ট পাখির কিচির মিচির আর সেই স্বর্ণচাঁপা তল! কোথায় গেল সব!? আজ চোখের কোল বেয়ে জল পড়ে। মিলি একমনে ভাবে, কি হতো? ওই পঙ্গু মানুষটা একবার দেখতে চেয়েছিল, কেন গেল না সে!! সত্যি কি চলে গেছেন তিনি! কিছুই জানেনা সে। আজ দু’দিন লাভবার্ড দু’টো কেবল ডানা ঝাপটাচ্ছে, এদিক ওদিক করছে, খাঁচার মুখ খুললেই ছুটে পালাবে এমন। মিলি চেয়ে দেখে ওই লাভবার্ড জোড়া এক সাথে গা ঘেঁষে বসে আছে।

একটু পর পর দানা খুঁটে মুখে দিচ্ছে। ইচ্ছে হচ্ছে উঠে পাখি দু’টোকেই ছেড়ে দেয়। খাঁচার মুখ খুলে দেয় মিলি। কি অবাক কাণ্ড! ওরা যায়না, খাঁচা থেকে বের হয়ে এদিক ওদিক ঘুরছে ঘরের, খাঁচায় বন্দী পাখি কি উড়তে ভুলে গেছে? সেও যেমন ভুলে গেছে ভালবাসতে! খুলে রাখে ডালা, পাখি দু’টো ঘরময় ঘুরে বেড়ায়। হেলান চেয়ারে বসে মিলি দেখে পাখিদের, আর নীল আকাশে মেঘের লুকোচুরি খেলা।

জানালার ফাঁক গলে আসা এক চিলতে রোদ পড়ে ঘরে। আঁকিবুঁকি করে মেঝেতে কি অপূর্ব আলপনা গাছের পাতার! ঠিক তখনি আবার বেজে উঠলো ফোন। ধরতেই ভাস্কর, - মিলি আমি চলে যাচ্ছি। একটিবার এসো প্লিজ এয়ারপোর্টে, দূর থেকে দেখব তোমায়। মিলি, যে ভুল করেছিলাম তার শাস্তিতো পাচ্ছি, আর কেন? বাকিটা জীবন একটু শান্তি চাই মিলি আসবে তো? - আসবো, খুব আস্তে বলে মিলি।

- এত আস্তে বলছ মিলি! এসো কেমন? আমি কিন্তু সত্যি অপেক্ষা করব তোমার জন্য। তিনটে বাজতে দেরী নেই। কেন যে এখনো ক্যাব নিয়ে আসছেনা গার্ড! ছটফট করছে মিলি। সেজেছে সে নীল শাড়িতে। ক্যাব আসতেই আর একবার টিপ ঠিক করে নিয়ে রওনা দিল।

রাস্তার জ্যাম পেরিয়ে অবশেষে এলো এয়ারপোর্টে। তখন ঘোষণা দিচ্ছে ভাস্কর এর ফ্লাইটের; ইস্ আরেকটু দেরী হলেই আর দেখা হতো না! এদিক ওদিক তাকাচ্ছে মিলি, ভাস্কর কই? চিনবে কি তাকে? হার্টবিট দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। ঠিক এমন সময় একটা উষ্ণ হাত মিলির কাঁধ ছুঁলো। চমকে দেখে, ভাস্কর! হাতে টিকিট আর বোর্ডিং পাস, হাসছে ও! মিলি কেঁপে উঠলো। চোখ ছলছল।

এ কোন ভাস্কর? কাকে দেখছে সে? অনেক বয়স হয়ে গেছে, মনে হয় অনেক ঝড়ঝাপটা পেরিয়ে আসা একটা মানুষ। খুব পরিচিত খুব আপন তার। - এই মিলি কি হলো? নিজেকে পারল না ধরে রাখতে। কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল মিলি। ভাস্কর ওকে জড়িয়ে ধরে আছে।

ফুলে ফুলে উঠছে মিলি কি এক অজানা অভিমানে সে নিজেই জানে না। ভাস্করের দু’বাহুর বন্ধনে নিজেকে ছেড়ে দেয় মিলি। বহু দিন এমন নিশ্চিন্তের আশ্রয় সন্ধানে, ক্লান্ত সে। কি রে মিলি অমন নিচু হয়ে কি দেখছিস? মায়ের ডাকে ফিরে তাকায় সে ভাবছিল ওই বুঝি ভাস্কর এলো!! ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.