আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্নীতির আরেক বরপুত্র, গোলাম মাওলা রনি

মানুষ হবার প্রচেষ্টায় গোলাম মাওলা রনি হে এত টাহা বানাইছে কেমনে’ ‘রনির বাবা শামসু মুন্সি কান্দে (কাঁধে) গামছা লইয়া গাওয়াল (ফেরি) করছে গ্রামে গ্রামে। হেইয়া বেইচ্চা সংসার চালাইছে। হেই গামছাওলার পোলা রনি এ্যাহন এমপি অইছে, কোটি কোট টাহার মালিক হইছে’- গোলাম মাওলা রনি প্রসঙ্গে এভাবেই মন্তব্য করেন তাঁর নির্বাচনী এলাকা গলাচিপা উপজেলার ডাউকা গ্রামের সাতাত্তর বছর বয়স্ক মো. এসমাইল সরদার। গলাচিপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ হাওলাদার বলেন, ‘তাঁর বাবা সামসুদ্দিন মুন্সি ১৯৭৪ সালে গলাচিপার উলানিয়া নামক এলাকায় সপরিবারে আসেন ব্যবসার খোঁজে। তখন তিনি গামছা ফেরি করে বিক্রি করতেন।

ওই আয়েই চলত সংসার। এক পর্যায়ে ওখানে সরকারি খাসজমিতে ছোট্ট একটি কাপড়ের দোকান নিয়ে বসেন। তখন গোলাম মাওলা রনি ছোট। তিনি ওখান থেকে মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পাস করে এলাকা ছাড়েন। তাঁদের পরিবারের আর্থিক দৈন্য ছিল আগে থেকেই।

অথচ তিনি এখন নিজেকে পটুয়াখালী জেলার সবচেয়ে বড় সম্পদশালী কিংবা ধনী মানুষ হিসেবে দাবি করেন। তার কোটি কোটি টাকা কিভাবে এসেছে তা অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে। গোলাম মাওলা রনি বর্তমান সময়ে ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত সংসদ সদস্য। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের টিকিটে পটুয়াখালী-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি থেকে শুরু করে অনেক অভিযোগ ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। অল্প সময়ে প্রায় শূন্য দশা থেকে তিনি হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক।

শিল্প-কারখানাসহ রয়েছে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, গাড়ি-বাড়ি। এমপি রনির বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা আত্মসাৎ, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং চাঁদাবাজি-দুর্নীতির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। আগামী মাসেই অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেওয়া হবে এবং একই সঙ্গে সম্পদের হিসাব চেয়ে তাঁকে নোটিশ পাঠাতে পারে কমিশন। পটুয়াখালীর আওয়ামী লীগ নেতারা দলের ইমেজ নষ্ট করার জন্য দলের প্রধানের কাছ থেকে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আশা করছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাজী আলমগীর বলেছেন, ‘গোলাম মাওলা রনি উগ্র মৌলবাদী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত।

তিনি যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার ভাইয়ের ছেলে। আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী। ’ তাঁর কথিত ‘ভাইয়া বাহিনী’র বিরুদ্ধে তাঁর নির্বাচনী এলাকা গলাচিপায় আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীদের ওপর হামলা চালানোরও অসংখ্য অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতিসহ এসব কারণেও তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় নেতারা। দুদকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে এমপি রনির সম্পদের ব্যাপক গরমিল পাওয়া গেছে।

কাগজে-কলমে তাঁর সাতটি প্রতিষ্ঠান পাওয়া গেলেও এবং একটি প্রতিষ্ঠানে ৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন বলে তিনি হিসাব দিলেও অন্য ছয়টি প্রতিষ্ঠানে কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে, সেটা উল্লেখ করেননি। এমনকি যে প্রতিষ্ঠানে ৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন, সেই টাকা কোথা থেকে পেয়েছেন- দুদকের জিজ্ঞাসাবাদে তার সঠিক তথ্য দিতে পারেননি এমপি রনি। তিনি কোটি কোটি টাকার সম্পদের হিসাব গোপন করেছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে জানা গেছে। বিস্তারিত জানতে আরো অধিকতর অনুসন্ধানের প্রয়োজন বলে মনে করেন এই কর্মকর্তা। দুদক সূত্র জানায়, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকায় ‘সেবোল্ট গার্মেন্ট লিমিটেডের’ মালিক গোলাম মাওলা রনি।

এই প্রতিষ্ঠানে ২০০৬-০৭ সালে ৯ কোটি টাকা বিনিয়োগ করার কথা তিনি আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করলেও মেসার্স সেবোল্ট এক্সেপ্রস, মেসার্স সেবোল্ট অ্যাডজাস্টস, নেট অ্যাকসেস, নন্দিতা এন্টারপ্রাইজ, ইন্টারন্যাশনাল মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড অ্যাডভারটাইজিং নামক প্রতিষ্ঠানগুলোতে কত কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন সেটা আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করেননি। ধানমণ্ডির ৬/বি, নাইম রোডে এবং তোপখানা রোডে রয়েছে তাঁর বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, পূর্বাচলে প্লটসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ফ্ল্যাট, বাড়ি এবং প্লট রয়েছে। ল্যান্ডক্রুজার প্রাডোসহ রয়েছে একাধিক গাড়ি। এমপি রনির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান করছেন দুদকের উপপরিচালক মো. তালেবুর রহমান। তিনি বলেন, গোলাম মাওলা রনির দখলে থাকা সম্পদের তথ্য যাচাই করতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবি আর), ব্যাংক ও রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কম্পানি থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে।

তাঁর বিরুদ্ধে পটুয়াখালী জেলা এলজিইডি, সওজসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ, বদলিসহ নানা ক্ষেত্রে চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে। এসব অভিযোগেরও তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে; আমাদের প্রাথমিক অনুসন্ধান প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। আগামী মাসের (আগস্ট) মাঝামাঝি অনুসন্ধান প্রতিবেদন কমিশনে জমা দিতে পারব। পরবর্তী সময়ে কমিশনের অনুমোদন সাপেক্ষে এমপি গোলাম মাওলা রনিকে সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ পাঠাব। তিনি বলেন, ‘ওই নোটিশ অনুযায়ী এমপি রনির দখলে থাকা স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদের হিসাব পেশ করতে হবে।

পরে ওই হিসাব যাচাই করে তাঁর দখলে অবৈধ সম্পদের তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেলে, তাঁর বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করা হবে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অভিযোগ, ২০০৮ সালে এমপি হওয়ার পর সব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে দুর্নীতি শুরু করেন রনি। টেন্ডারবাজি আর লুটপাট করেছেন ইচ্ছা মতো। এমপির স্পেশাল বরাদ্দ, হতদরিদ্র কর্মসূচির জন্য দশমিনা ও গলাচিপা এ দুই উপজেলায় প্রতিবছর বরাদ্দের কিছুই স্থানীয় লোকজন পায়নি। লুটপাটের মাধ্যমে এমপি রনি ও তাঁর লোকজন হাতিয়ে নিয়েছে সেসব।

আওয়ামী লীগের এমপি তিনি, অথচ সেই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। ২০১০ সালের ১৫ ফেব্র“য়ারি পটুয়াখালীতে অবস্থানকালে রনি ও তাঁর ‘ভাইয়া বাহিনী’র হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও গলাচিপা উপজেলা চেয়ারম্যান হারুন অর রশিদ এবং পৌর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ও পৌর মেয়র ওহাব খলিফা। তাঁরা দুজন কয়েকবার লাঞ্ছিত হন ভাইয়া বাহিনীর হাতে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় রনির ওই বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন গলাচিপা আওয়ামী লীগ সম্পাদক গোলাম মস্তফা টিটো, সাংগঠনিক সম্পাদক শামসুজ্জামান লিকন, সদস্য কাশিনাথ দত্ত, সহসভাপতি সন্তোষ কুমার দে, উপদেষ্টা কালাম মোহাম্মদ ইসা, সদস্য রামকৃষ্ণ পাল, পৌর আওয়ামী লীগ সম্পাদক মাইনুল ইসলাম রনো, ছাত্রলীগ সহসভাপতি শাকিল খান, সদস্য শওকত ফিরোজসহ বিভিন্ন ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড কমিটির নেতা-কর্মীরা। শুধু গলাচিপা উপজেলায় বিভিন্ন সময় রনি কিংবা তাঁর ভাইয়া বাহিনী আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ওপর প্রায় ১২৫টি হামলা কিংবা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।

এ কারণে পাল্টাপাল্টি ৩২টি মামলা হয়েছে ওই থানায়। ভাইয়া বাহিনীর হাত থেকে রক্ষা পাননি পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুবুর রহমান তালুকদারও। পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া-গলাচিপা উপজেলার একাংশ নিয়ে গঠিত) আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবুর রহমান তালুকদার ২০০৯ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর সরকারি সফরে গলাচিপা যান। তাঁর আগমন উপলক্ষে উপজেলা আওয়ামী লীগের উদ্যোগে গেট ও জনসভার মঞ্চ তৈরি করা হলে ভাইয়া বাহিনী তা আগুন দিয়ে পুড়িয় দেয়। দশমিনায় ভাইয়া বাহিনীর হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান আ. আজিজ, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান শামসুন্নাহার ডলি, ভাইস চেয়ারম্যান ও উপজেলা যুবলীগের সভাপতি মো. শাখাওয়াত হোসেন শওকত, ছাত্রলীগ সভাপতি কাজি শাকিল আহম্মেদ, রণগোপালদি ইউপি চেয়ারম্যান এবং ওই ইউনিয়ন পরিষদের আওয়ামী লীগ সভাপতি জাকির হোসেন, উপজেলা আওয়ামী লীগ সহসভাপতি অ্যাডভোকেট আ. খালেক, দশমিনা উপজেলা ছাত্রলীগ সভাপতি মো. শুভ, ওই ইউপি ছাত্রলীগ সম্পাদক সমীরণ কর্মকার, বাঁশবাড়িয়া ইউপি যুবলীগ সম্পাদক মোশারেফ হোসেন, বহরমপুর ইউপি যুবলীগ সভাপতি রমিজ মল্লিক, উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নার্গিস বেগম, স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক সিকদার মো. আবু জাফর, স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক রমিজ উদ্দিন তমাল, আলীপুর ইউপি যুবলীগ সভাপতি জাহাঙ্গীর হোসেন মুন্সি, বহরমপুর ইউপি যুবলীগ সভাপতি মো. জহির উদ্দিন, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক গৌতম রায়সহ অসংখ্য নেতা-কর্মী।

বিস্তারিত এখানে  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।