আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুর্নীতির শীর্ষে বিচার বিভাগ



দেশের ১৩টি সেবা খাতের মধ্যে বিচার বিভাগে গিয়ে সবচেয়ে বেশি হয়রানি, অনিয়ম, ঘুষ দেওয়া তথা দুর্নীতির শিকার হয়েছে সাধারণ মানুষ। ২০০৯-১০ সালে বিচারপ্রার্থীদের ৮৮ শতাংশ শুনানির সময় নির্ধারণ থেকে শুরু করে নথিপত্র গায়েব এবং উৎকোচ দেওয়াসহ নানা অনিয়মের শিকার হয়েছে। নিম্ন আদালত থেকে শুরু করে উচ্চ আদালত—বিচার বিভাগের প্রতিটি স্তরে ঘুষের দৃষ্টান্ত থাকলেও জরিপে শীর্ষে রয়েছে উচ্চ আদালত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) গতকাল বৃহস্পতিবার সেবা খাতে দুর্নীতিসংক্রান্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য প্রকাশ করেছে। ২০০৯ সালের ৯ জুন থেকে এ বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশের সব বিভাগীয় শহর ও গ্রামাঞ্চলের ছয় হাজার খানার (পরিবার) ওপর পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে ‘সেবা খাতে দুর্নীতি: জাতীয় খানা জরিপ ২০১০’ প্রকাশ করে।

প্রতিষ্ঠানটি বলছে, ২০০৭ সালের খানা জরিপে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার বিচার বিভাগের দুর্নীতির শিকার হয়েছিল। কিন্তু এ দফায় তা বেড়েছে। জরিপে অংশ নেওয়াদের শতকরা ১০ দশমিক ৯ ভাগ বিচার বিভাগ থেকে সেবা নিয়েছে। তাদের ৮৮ শতাংশ দুর্নীতির শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) মিলনায়তনে খানা জরিপের ফল প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান গোলাম রহমান জানান, টিআইবি দুর্নীতির যে চিত্র প্রকাশ করেছে, দেশে তার চেয়েও বেশি দুর্নীতি হচ্ছে।

২০০৭ সালে বিচার বিভাগ স্বাধীন ছিল না। কিন্তু সাধারণ মানুষের মতে, এখন স্বাধীন বিচারব্যবস্থায় দুর্নীতি-অনিয়ম বেড়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকজন সাবেক বিচারপতির অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়েছে কমিশনে। এমনকি সাবেক এক প্রধান বিচারপতিও কিছু বিষয়ে অভিযোগ করেছেন। কমিশন অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে।

দুদকের চেয়ারম্যান আরও বলেন, দুর্নীতির মামলা সুরাহার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের কিছু পদ্ধতিগত সংস্কার করা না হলে একটি কেন, ১০টি কমিশন দিয়েও সুফল মিলবে না। বিশিষ্ট আইনজীবী এম জহির প্রথম আলোকে বলেন, এটা দুঃখজনক। প্রতিবেদনের বিষয়টি প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীর তলিয়ে দেখা উচিত। তিনি বলেন, ‘দ্রুত মামলা নিষ্পত্তি হয় না, অনেক সময় বিচারক যথাসময়ে আদালতে উপস্থিত থাকেন না। উৎকোচ বা ঘুষের ধারণা থাকতে পারে।

কিন্তু আমি এটা দেখিনি। ’ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিচার বিভাগে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো মামলার সংখ্যা বেশি। তাই নিষ্পত্তিতে সময় প্রয়োজন হয়। টিআইবির প্রতিবেদন সম্পূর্ণ সঠিক নয়। বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য ঢালাওভাবে এ ধরনের মতামত প্রকাশ করা হয়েছে।

এর গ্রহণযোগ্যতা আছে বলে মনে করি না। ’ টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জুন ২০০৯ থেকে মে ২০১০ পর্যন্ত যারা বিচার বিভাগের শরণাপন্ন হয়েছে, তাদের মধ্যে ৮৮ শতাংশ মানুষ ঘুষ ও অনিয়মের শিকার হয়েছে। ২০০৭ সালের তুলনায় এই হার অনেক বেশি। তিন বছর আগে পরিচালিত ওই জরিপে ৪৭ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ ঘুষ ও অনিয়মের শিকার হয়। প্রধান বিচারপতি স্বয়ং বিচার বিভাগের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, এই প্রতিবেদনে সে চিত্রই ফুটে উঠেছে।

টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দিন খান বলেন, ‘বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের কথা বলা হলেও আমি কখনো বিচার বিভাগের সংস্কার সম্পর্কে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে শুনিনি। ’ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২০০৯-১০ সালে সেবা পাওয়ার জন্য সার্বিকভাবে প্রায় ৬০ শতাংশ খানা গড়ে সাত হাজার ৯১৮ টাকা ঘুষ দিয়েছে। সেবাগ্রহীতারা দ্রুত শুনানি হওয়া, মামলার রায়কে প্রভাবিত করা, নথি তোলা, শুনানির তারিখ পেছানো ও নথিপত্র গায়েব করে দেওয়ার জন্য ঘুষ দেয়। এই সময়কালে সবচেয়ে বেশি ঘুষ লেনদেন হয়েছে হাইকোর্টের মামলার ক্ষেত্রে, ঘুষের পরিমাণ খানাপ্রতি গড়ে ১২ হাজার ৭৬১ টাকা, জজকোর্টে তা ছয় হাজার ১৭৮ টাকা এবং ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট ছয় হাজার ৫৯৮ টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, আইনজীবীর হয়রানির শিকার হয়েছে ৩৯ দশমিক ৭ শতাংশ মানুষ, ৪১ শতাংশ মানুষ সময়ক্ষেপণ, ২৪ দশমিক ৫ শতাংশ আদালতের কর্মকর্তা বা কর্মচারী, ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ মুহরির, ২ দশমিক ৭ শতাংশ দালালের হয়রানি এবং ৯ দশমিক ১ শতাংশ নথি তোলায় হয়রানির শিকার হয়েছে।

পরিস্থিতির উন্নতি হলেও ঘুষ আদায়ে এগিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা: খাতভেদে ঘুষ ও নিয়মবহির্ভূত অর্থ আদায়ে এগিয়ে আছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। পুলিশের শনাক্তকরণ প্রতিবেদন ও অনাপত্তিপত্র পেতে সেবাগ্রহীতাদের ৯৮ দশমিক ৩ শতাংশকে ঘুষ দিতে হয়েছে। এ ছাড়া গণগ্রেপ্তারের মুখোমুখি হয়ে প্রায় ৮৯ শতাংশ পরিবারকে গড়ে চার হাজার ৪৫ টাকা ঘুষ দিতে হয়েছে। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো থেকে সেবা নিয়েছে। এদের মধ্যে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ।

সেবা পাওয়ার জন্য সার্বিকভাবে ঘুষ দিয়েছে ৬৮ দশমিক একটি খানা ও গড় ঘুষের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ৩৫২ টাকা। সেবাগ্রহীতাদের সবচেয়ে বেশি হয়রানি করেছে থানা পুলিশ। এরপর রয়েছে ট্রাফিক পুলিশ ও র‌্যাব। সেবাগ্রহীতাদের ৬৬ দশমিক ২ শতাংশ বলেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা তাদের ঘুষ দিতে বাধ্য করেছে। এ ছাড়া মিথ্যা মামলায় জড়ানো, সাধারণ ডায়েরি বা প্রাথমিক তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণে অবহেলা বা সময়ক্ষেপণ, অসদাচরণ ও ভয়ভীতি দেখানো, আসামিকে গ্রেপ্তার না করা, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, সময়মতো সঠিকভাবে অভিযোগপত্র না দেওয়া ও বিনা কারণে গ্রেপ্তারের মতো অভিযোগ আছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে।

তবে ২০০৭ সালের তুলনায় এ পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সে সময় ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ খানা দুর্নীতি-অনিয়মের শিকার হয়েছিল। এখন এই হার ৭৯ দশমিক ৭ শতাংশ। অন্যান্য প্রসঙ্গ: বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থার পরই দুর্নীতিতে এগিয়ে আছে ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনা। যারা সেবা নিয়েছে, তাদের মধ্যে দুর্নীতির শিকার হয়েছে ৭১ দশমিক ২ শতাংশ।

এ ছাড়া কর ও শুল্ক বিভাগের সেবা পাওয়ার জন্য ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশ পরিবার, বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থার সেবা পেতে ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ পরিবার, কৃষিসেবা পেতে ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ পরিবার, স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে সেবা পেতে ৩৬ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার, স্বাস্থ্যসেবা পেতে ১৩ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার, বিমা খাতে ১৫ শতাংশ খানা, ব্যাংকিং খাতে ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ খানা, ৭ দশমিক ২ শতাংশ ঋণগ্রহীতা এনজিও থেকে ঋণ নিতে এবং শিক্ষা খাতে ১৫ শতাংশ খানা ঘুষ-অনিয়মের শিকার হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। এ ছাড়া বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে পরিবারগুলোর কাছ থেকে সরকার-নির্ধারিত খরচের চেয়ে অতিরিক্ত আদায় করা হয়েছে এক লাখ ১১ হাজার ৫২১ টাকা। প্রতিবেদনে ২০০৭ সালের খানা জরিপের তুলনায় ২০০৯-১০ সালে সার্বিক দুর্নীতি ও অনিয়মের হার বেড়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। বলা হয়, ওই বছর ৬৬ দশমিক ৭ শতাংশ পরিবার দুর্নীতি-অনিয়মের শিকার হলেও ২০০৯-১০ সালে ৮৪ দশমিক ২ শতাংশ পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতি-অনিয়মের হার ২০০৭ সালের খানা জরিপের তুলনায় কমে এসেছে বলে উল্লেখ করা হয়।

শিক্ষা খাতে ২০০৭ সালে দুর্নীতির শিকার হয়েছিল ৩৯ দশমিক ২ শতাংশ সেবাপ্রার্থী, ২০০৯-১০ সালে এই হার কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ দশমিক ৩ এবং স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির শিকার মানুষের সংখ্যা ৪৪ দশমিক ১ থেকে কমে ৩৩ দশমিক ২-এ নেমে এসেছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিক এক জরিপ নিয়ে পুলিশ বিভাগের তির্যক মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গতকাল প্রকাশিত প্রতিবেদনের উৎস দেশের সব বিভাগের গ্রাম ও শহরের ছয় হাজার খানা। প্রতিবেদনে ৯ জুন ২০০৯ থেকে থেকে ২০ জুলাই ২০১০ পর্যন্ত সময়কালে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার, কৃষি, ভূমি প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা, বিচার বিভাগ, বিদ্যুৎসেবা, কর ও শুল্ক, ব্যাংকিং, বিমাসেবা, এনজিও খাত এবং গ্যাস, পানি ও পয়োনিষ্কাশন, চাকরিতে নিয়োগ, জনশক্তি রপ্তানি ও পাসপোর্ট খাতে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়মের চিত্র প্রকাশ করা হয়েছে। জরিপ-প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করা হয়েছে। এই জরিপে টিআইবির গবেষক ও মাঠপর্যায়ের জরিপকারীদের সহায়তা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কাজী সালেহ আহমেদ ও শিক্ষক এম কবির এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সালাহউদ্দীন এম আমিনুজ্জামান, পি কে মতিউর রহমান ও মোহাম্মদ শোয়ায়ব।

সুত্র-প্রথমআলো

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।