আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য স্বচ্ছতা যখন জরুরি

জাতীয় সমৃদ্ধির জন্য স্বচ্ছতা যখন জরুরি ফকির ইলিয়াস ======================================== বাংলাদেশে তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি নানা রকম সভা-সমাবেশ করছে। তারা ৩ জুলাই অর্ধদিবস হরতালও ডেকেছে। এদিকে পুলিশ তাদের সভা-সমাবেশে নানা রকম বাধা দিয়ে যাচ্ছে। ওয়ার্কার্স পার্টি আয়োজিত একটি গোলটেবিল বৈঠকের সংবাদ টিভিতে দেখলাম। ওই বৈঠকে মহাজোটের শরিক দুই এমপি রাশেদ খান মেনন ও হাসানুল হক ইনু উপস্থিত থেকে বক্তব্য রেখেছেন।

তারা বলেছেন, তেল-গ্যাসের কোন চুক্তি দেশের জনগণ মেনে নেবে না। এ চুক্তি বাতিল করা না হলে জনগণকে নিয়ে জোর আন্দোলন গড়ে তোলা হবে। এদিকে গত কয়েকদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সমাবেশে বলেছেন, 'আমার চেয়ে বড় দেশপ্রেমিক কে? আমি রাষ্ট্রের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে কোন সিদ্ধান্তই নেব না। ' প্রধানমন্ত্রীর এমন উক্তি আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় রাষ্ট্রস্বার্থই যে কোন দেশপ্রেমিকের আরাধনা হওয়া উচিত। দেশের স্বার্থ, মাটির স্বার্থ, মানুষের স্বার্থ রক্ষা করা যে কোন সচেতন নাগরিকেরই জরুরি কর্তব্য।

তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটি যাদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে, এরা রাষ্ট্রের শ্রেষ্ঠ নাগরিক। তারা যা বলছেন তা বুঝেশুনেই বলছেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রশক্তির অনেক সাধ্যই নেই, তা আমাদের অনেক বুদ্ধিজীবীরাই বলেন। তারা এটাও বলেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে দেশের খনিজসম্পদ রক্ষা করতে। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, বাংলাদেশের সরকারের বিদেশি কোন কোম্পানির সঙ্গে যখন চুক্তি হয় তখন সরকারের পক্ষ থেকে কিছু রাখঢাক করা হয়।

আবার সরকারের শীর্ষ পক্ষের কোন কোন কর্ণধার বিদেশি পক্ষের কাছ থেকে 'উপঢৌকন' নিয়ে থাকেন। অতি সম্প্রতি 'নাইকো' দুর্নীতি বিষয়টি আবার সামনে চলে এসেছে। সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন এবং তাকে দেয়া কালো গাড়িটি আবার সংবাদ শিরোনাম হচ্ছে। দুদক মামলা করবে জানিয়ে দিয়েছে। এছাড়াও 'হাওয়া ভবন' কিংবা আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির কথা বলা হচ্ছে সেসব পুকুরচুরির সঙ্গেও বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানির সম্পৃক্ততার কথা জানা যাচ্ছে।

এই যে ঘটনাগুলো তা বাংলাদেশের মানুষ যে কত অরক্ষিত তারই প্রমাণ বহন করে। কারণ রাষ্ট্রশাসকদের দ্বারা রাষ্ট্রের মানুষ সুরক্ষিত থাকলে, দেশবিরোধী কোন চুক্তিই অতীতে সাধিত হতে পারত না। ভবিষ্যতেও পারবে না। এখন আসা যাক খনিজসম্পদ উত্তোলনে বাংলাদেশের সামর্থ্য থাকা না থাকা প্রসঙ্গে। কারও কারও মতে বাংলাদেশের সাধ্য নেই বলেই খনিজসম্পদ উত্তোলনের কাজটি বিদেশি কোম্পানিগুলোকে দিয়ে দেয়া হয়।

কিন্তু প্রকৃত কথা হচ্ছে এই, সাধ্য নেই এই অজুহাতে চলি্লশ বছর বয়সী একটি দেশ পার পেয়ে যেতে পারে না। আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশের কথা বলছি, আমরা তথ্য প্রযুক্তির উৎকর্ষতার কথা বলছি। অথচ খনিজ সম্পদ আহরণে আমাদের সাধ্য ও সামর্থ্য থাকবে না কেন? অনেকেই মনে করেন 'পেট্রোবাংলার' ভিতরে একটি নেপথ্য গডফাদার চক্র লুকায়িত আছে। যেমনটি রয়েছে 'বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের' ভিতরেও। অনেক লম্বা লম্বা বুলি আওড়ানোর পরও বিমানের ডানা ছোট হয়ে আসছে।

ফ্লাইট কমিয়ে দেয়া অথবা বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে। ঢাকা-নিউইয়র্ক রুটে ফ্লাইট চালুর বারবার অঙ্গীকার দিয়েও সরকার কথা রাখেনি কিংবা রাখতে পারেনি। ঢাকা-লন্ডন ফ্লাইটের অবস্থাও জোনাকি পোকার মতো। এই জ্বলে, এই নিভে। ঠিক একই কায়দায় 'পেট্রোবাংলাও' একটি বড় চক্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় কিংবা উপদেষ্টার কার্যালয় উভয় দফতরই এই চক্রের বলয় ভাঙতে বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। যা হয়েছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে, তা হচ্ছে মহাজোট সরকারের আমলেও। কোন রাষ্ট্রে অনুৎপাদন খাতে বাজেট বরাদ্দ যদি উৎপাদনশীল খাতকে ছাড়িয়ে যায় সে দেশে বাজেট বণ্টন ব্যবস্থার স্বচ্ছতা আশা করা যায় না। বাংলাদেশে তা প্রায় প্রতিটি সরকারের বেলায়ই হচ্ছে। দৃশ্যত এর কারণ হিসেবে যে বিষয়টিকে চিহ্নিত করা যায় তা হচ্ছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং লুটপাটকে প্রশ্রয় দেয়া।

তা দেয়া হচ্ছে বলেই বাংলাদেশে অপরিকল্পিতভাবে 'তথাকথিত উন্নয়ন' সাধিত হচ্ছে। যে দেশের প্রধান হাসপাতালগুলোতে একটি করে অত্যাধুনিক 'বার্ন ইউনিট' নেই, যে দেশে এ পর্যন্ত অগি্নদগ্ধ রোগীদের জন্য বিশেষ একটি হাসপাতাল তৈরি সম্ভব হয়নি, সে দেশে গহিন পানির স্রোতের মাঝেই জায়গা দেখিয়ে প্লট বিক্রি হয়, যে দেশে শেয়ারবাজারের লুণ্ঠনকারীরা সরকারের চেয়েও বেশি শক্তিমান বলে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীই বলেন, সে দেশে স্বচ্ছতা কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে? এমন উদাহরণ অনেক দেয়া যাবে। সামাজিক এবং রাজনৈতিক স্বচ্ছতা প্রদানের অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে জনগণের সামনে নিজেদের এজেন্ডা পরিষ্কার করা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার তার নির্বাচনী ইশতেহারে অনেক ওয়াদা করেছিলেন। সরকারের ভাষ্যমতে তারা তা পূরণ করার চেষ্টা করছেন।

কিন্তু কথা হচ্ছে, তারা তো দুই-তৃতীয়াংশ ব্রুট মেজরিটির শক্তি নিয়ে এজেন্ডার বাইরেও আরও অনেক কিছু করছেন কিংবা করতে যাচ্ছেন। যেমন সংবিধান সংশোধনী তাদের এজেন্ডায় না থাকার পরও তা করতে যাচ্ছেন দুই-তৃতীয়াংশ শক্তির বলেই। আমার কেন জানি মনে হয়, বাংলাদেশের প্রতিটি শাসক শ্রেণীই চায়, দেশের মানুষের কিছুটা দুর্ভোগ লেগেই থাকুক। তা না হলে অযথা কিছু ইস্যুকে জিইয়ে রেখে লাভ কী? যেমন বিশেষ করে বিদেশের সঙ্গে বাংলাদেশের যে চুক্তিগুলো হয় তার ধারা-উপধারাগুলো জনগণকে জানিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশে প্রতিটি সরকারের এত অনীহা কেন? মনে রাখা দরকার, আগামী আড়াইবছর মহাজোটের জন্য কোনভাবেই কুসুমাস্তীর্ণ হবে না। জাতীয় পার্টি যদি আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন এককভাবে করে প্রধান বিরোধীদলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তবুও সেই নির্বাচন বিশ্বে গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।

আর বিএনপি ক্রমেই 'সরকারের পতন' এই একদফা দাবি নিয়েই অগ্রসর হবে। ফলে সেই একদফা দাবির পালে হাওয়া দেবে, এমন যে কোন ইস্যুকেই সমর্থন দেবে বিএনপি। তাই সরকারকে আন্দোলনের অনেকগুলো দরজা খোলার রাস্তা করে দেয়া ঠিক হবে না কোনমতেই। রাজনীতিতে মেরুকরণের কথা আমরা অনেকেই জানি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে বিএনপি যখন আন্দোলন করে সামনে এগোবে, তখন জামায়াত চাইবে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ইস্যুকে স্তিমিত করে দেয়া।

শেখ হাসিনা জাতির জনকের ঘাতকচক্রের সাজা কার্যকর করতে পেরেছেন। আমরা দেখছি পিলখানা হত্যাকা-ের হোতাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিয়ে সাজা শুরু হয়েছে। এর পাশাপাশি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করাও বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার তা ভুলে গেলে চলবে না। সংবিধান সংশোধনীতে 'বিসমিল্লাহ' এবং রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রেখে মহাজোট মূলত বিএনপিকে ধর্মের নামে রাজনীতি থেকে বিরত রাখার একটি চাল চেলেছে। এটা কে না জানে বিএনপির অনেক শীর্ষ ব্যক্তিত্বই নিজে ধার্মিক না হয়েও শুধু লোক দেখানো 'ধর্মরাজনীতি' করছেন।

বরং তাদের ব্যক্তিজীবন পাশ্চাত্য জীবনাচারকেও হার মানায়। এরা সবাই ধর্মের নামে ধাপ্পাবাজি করে বেড়ান। আর এমন হীন মতলববাজ যারা, তাদের কাছ থেকে তো রাজনৈতিক স্বচ্ছতা কখনোই আশা করা যায় না। সংবিধান বিষয়ে '৭২ আর ২০১১ সালের প্রেক্ষাপট এক নয়, যারা বলেছেন তাদের সবিনয়ে বলি, আমরা আপনাদের কথা মানব। কিন্তু আপনাদেরকেও আমাদের কথা মানতে হবে।

কথাগুলো হচ্ছে এই, জাতীয় সমৃদ্ধির প্রয়োজনে দলীয় স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা করুন। সরকারের ভিতরের দখলদারকে উচ্ছেদ করুন। নিউইয়র্ক, ২৮ জুন ২০১১ -------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ। ঢাকা । ১ জুলাই ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- গীতি আলাট্রেল ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.