আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনিন্দ্য সুন্দর নদী সুরমা

সুরমা নদীর তীর থেকে বাংলাদেশের অনিন্দ্য সুন্দর নদীগুলোর মধ্যে অন্যতম সুরমা। সিলেট নগরী গড়ে উঠেছে সুরমা নদীর কোল ঘেঁষেই। সুরমা নদীর মূল উৎপত্তি হয়েছে ভারতের মনিপুর পাহাড়ে। স্থানীয়দের কাছে এ নদীর পূর্ব নাম ছিল বড়-বকরো নদী। অনেকের কাছেই অজানা যে, বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদী সুরমা।

মনিপুর পাহাড় হতে উৎপত্তি হয়ে সুরমা নদী এদেশে ঢুকে মোট ৬৬৯ কিলোমিটার ভ্রমন করেছে। ভারতে এ নদীর নাম বরাক নদী। উত্তর-পূর্ব ভারতের মণিপুর পাহাড়ের মাও সংসাং হতে বরাক নদীর উৎপত্তি হয়। বাংলাদেশ সীমান্তে নদীটি দুই শাখায় বিভক্ত হয়, এর উত্তরের শাখাটি সুরমা নদী, আর দক্ষিণের শাখার নাম কুশিয়ারা নদী। সুরমা নদী সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মেঘনায় মিশেছে।

আসলে সুরমা আর কুশিয়ারা নদী কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরববাজারের কাছে পুনরায় মিলিত হয়ে মেঘনা নদী গঠন করে। মেঘনা ভৈরব বাজারে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে এবং চাঁদপুরের কাছে পদ্মার সঙ্গে মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। কোন এক সময় এই নদীটি সিলেট অঞ্চলের জীবন জীবিকার মূল উৎস ছিল। সিলেটের সুরমা নদীর উপরে স্থাপিত ষ্টিলের ক্বিন ব্রীজটি সিলেটের প্রতিক হিসেবে বিশ্ব দরবারে পরিচিত। সুরমা নদীর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সিলেট নিজেকে আরো নিপুন ভাবে ফুটিয়ে তোলে পৃথিবীর বুকে।

সুরমা নদীর নামকরণ সিলেটের অনিন্দ্য সুন্দর এ নদীর কবে যে, সুরমা হয়েছে, তার সঠিক তথ্য ইতিহাসের নানা বিতর্কের বেড়াজালে আজও বন্দী। সুরমা নামের উৎপত্তি নিয়ে বিচিত্র একাধিক কিংবদন্তি চালু রয়েছে। সবচেয়ে প্রচলিত কিংবদন্তিতে কথিত আছে যে, রাজা ক্ষেত্রপাল বারো শতকে একটি খাল খনন করে বরাক নদীর সাথে যোগ করেন। এ থেকে একটি নতুন নদীর সৃষ্টি হয়। রাজা ক্ষেত্রপালের স্ত্রীর নাম ছিল সুরম্যা।

রাণী সুরম্যার নামানুসারে রাজা নদীটির নাম রাখেন সুরমা। সুরমা নাম নিয়ে যত মতভেদই থাকুক না কেন, সুরমার উৎস-নদী বরাকের প্রাচীন নাম ছিল ‘বরবক্র’; প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে ও শাস্ত্রে বরবক্র নামের যথেষ্ট নিদর্শন পাওয়া যায়। আবার কারো কারো মতে প্রাচীন পুরাণে পুণ্যতোয়া নামে খ্যাত শরাবতী নদীই বর্তমানের সুরমা। ইতিহাস-ঐতিহ্যে সুরমা নদী সিলেট একটি প্রাচিন জনপদ। বাংলাদেশের বিশাল অংশ যখন সাগরের গর্বে বিলীন, সিলেটে তখনো ছিল সভ্য সমাজ।

সিলেটের ভাটি এলাকাও এক সময় ছিল সমুদ্র। কিন্তু উচু ও পার্বত্য এলাকায় ছিল জনবসতি। খৃষ্টপূর্ব চার হাজার অব্দেও সিলেটে উন্নত সমাজ ছিল। ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে হযরত শাহজালাল (র আগমনের পর এ ভূখন্ড শিলহট, জালালাবাদ, বা সিলেট নামে পরিচিত হয়ে উঠে। বিভিন্ন তন্ত্রতে সিলেটের উল্লেখ আছে।

তন্ত্রগুলোতে সিলেটকে শ্রীহট্ট, শিরিহট্ট, শিলহট্, শিলহট বলা হয়েছে। এছাড়া হিন্দু শাস্ত্র গুলোতে সিলেটের নদ-নদীর নাম পাওয়া যায় রাজমালার বর্ণনায় জানা যায় আদিযুগে মনু যে নদীর তীওে বসে শিবপূজা করতেন সেটিই মনু নদী। তীর্থ চিন্তামণিতে আছে বরবক্রের বা বারাক নদীর উল্লেখ যোগ্য বর্ণনা। অমরকোষ অভিধানে বর্ণিত ‘শরাবতী’ কে অনেকেই সিলেটের সুরমা হিসেবে জানেন। এ সব নদীর পানি হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে ছিল পবিত্র।

সুরমা ও ধর্মীয় বিশ্বাস সুরমা ও এর উৎস-নদী বরাক নিয়ে বিভিন্ন ধর্মালম্বীদের মধ্যে বিভিন্ন বিশ্বাস রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকে হযরত শাহজালাল (রঃ) পর্যন্ত সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে অনেক ঘটনাই ঘটেছে। সুরমা নদী সম্পর্কে প্রাচীন পুরাণাদিতে তেমন উল্লেখ না-থাকলেও বরাক নদী অর্থাৎ প্রাচীন বরবক্র পুণ্যতোয়া নামে খ্যাত। হিন্দুদের বিশ্বাস বরবক্র নদীতে স্নান করলে সকল পাপ দূর হয়। তীর্থ চিন্তামণিতে রয়েছে-- ‘‘ রূপেশ্বরস্য দিগভাগে দক্ষিণে মুনি সত্তমঃ বরবক্র ইতিখ্যাত সর্বপাপ প্রনাশনঃ যত্র তেপে তপঃ পূর্ব সুমহৎ কপিলমুনি।

” অর্থাৎ রূপেশ্বর থেকে দক্ষিণ দিকে বরবক্র নামে খ্যাত সর্বপাপনাশী একটি তীর্থ আছে, সেইস্থানে পুরাকালে মুনিশ্রেষ্ঠ কপিল মুনি তপস্যা করতেন। ফজলুর রহমান সিলেটের মাটি সিলেটের মানুষ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, অমর কোষ অভিধানে শরাবতী নদীর ব্যাখ্যা আছে। অনেকের মতে শরাবতী নদীই সুরমা নদী। এতে লেখা আছে, ‘‘এই ভারতবর্ষে শরাবতী নামে এক নদী আছে, যাহা ভারতের ঈশাণ কোণ হতে উৎপন্ন হয়ে নৈঋত কোণাভিমুখে গমন করে পশ্চিম দিকে সমুদ্রে পতিত হয়েছে। সেই নদীর পূর্ব-দক্ষিণ দিকের দেশ প্রাচ্যদেশ।

ভারতবর্ষের সাহচর্য্য হেতু প্রতিগত অন্ত, অর্থাৎ শিষ্টাচার রহিত কামরূপবঙ্গাদিদেশ ম্লেচ্ছদেশ। কারণ যেদেশে চতুর্বর্ণ নাই সেদেশ ম্লেচ্ছদেশ। তদ্ব্যতীত স্থান আর্যাবর্ত। ”(পৃ. ২০) ঘটনাচক্রে ত্রিবেনীর কাছে হযরত শাহজালাল (রঃ)-এর সঙ্গে সিকন্দর গাজীর মুলাকাত হয়। রাজা গৌড়গোবিন্দের অত্যাচারের কথা জানতে পেরে হযরত শাহজালাল (রঃ) সিকন্দর গাজীর সাথে সিলেট যেতে ওয়াদা করেন।

কিছুদিন পর তাঁরা সিলেট উপকণ্ঠে পৌঁছুলে রাজা গৌড়গোবিন্দ শাহজালালের বাহিনীকে বাধা দেন। ঐ সময়ে রাজা গৌড়গোবিন্দ সুরমা নদীতে চলাচলকারী সকল নৌকা বন্ধ করে দেন। বহুবিদিত আছে, এসময়ে হযরত শাহজালাল তাঁর জায়নামাজে করে সুরমা নদী পার হন। তাঁর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে রাজা গৌড়গোবিন্দ পলায়ন করেন। “সংস্কৃত ভাষায় রচিত পুরাণ-উপপুরাণে বরবক্র নদীর উল্লেখ পাওয়া যায়।

বরাহ পুরাণে ঋষিরা বর্ণনা করেছেন, রূপেশ্বরের দক্ষিণ দিকে বরবক্র নামে খ্যাত সর্বপাপনাশন একটি তীর্থ আছে। যেখানে পুরাকালে মুনিশ্রেষ্ঠ কপিল মহাতপস্যা করেছিলেন। সেখানে শুভপদ কপিল তীর্থ এবং সিদ্ধেশ্বর বিরাজ করেন। সে-তীর্থে স্নান করলে লোকে উৎকৃষ্ট বিষ্ণুলোক প্রাপ্ত হয়, যেখানে মহাত্মা সিদ্ধপুরুষ উপাসনা করেছিলেন। ” (সিলেট ইতিহাস ও ঐতিহ্য, পৃঃ ৬৩) বায়ু পুরাণে উল্লেখ আছে, “ওঁ বিন্দপাদ সমুদ্ভূত বরবক্র মাহনদ নমস্তে পুণ্যফলদ সর্বপাপ প্রমোচন ইতিস্তুতা প্রণমেত।

”(প্রাগুক্ত) সতের শতকের শেষভাগে রচিত ত্রিপুরার রাজাদের ইতিহাস সম্বলিত রাজমালা কাব্য থেকে জানা যায়, “রাজা অমর মাণিক্য (১৫৯৭-১৬১১) অনন্ত স্বর্গে গমন করার আশায় বরবক্র ও মনু নদীর মহাপবিত্র সঙ্গমস্থলে গিয়ে স্বেচ্ছামৃত্যু বরণ করেছিলেন। রাজা মনু নদীতে নৌকায় করে ছয় দণ্ডের পথ উজিয়ে বরবক্র নদীর মিলনস্থলে উপনীত হয়েছিলেন। এছাড়াও উল্লেখ রয়েছে, বরবক্র-মনুসঙ্গমে মৃত্যু যার হয়/ চন্দ্রলোকে যায় সে-ই প্রমাণ নিশ্চয়। ” বিভিন্ন পর্যটকের বর্ননায় সিলেটের সুরমা নদী হিজরী তৃতীয় শতাব্দীতে আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফী, পারস্য সাগর, ভারত সাগর ও বঙ্গোপসাগর অতিক্রম করেন। তার বর্ণনায় বাংলার চট্টগ্রাম বন্দর ও সিলহেট বন্দরের কথা বারবার উল্লেখ আছে।

আরবী ইতিহাসেও সিলহেট বন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মরক্কোর অধিবাসী শেষ আব্দুল্লাহ্ মোহাম্মদ ইবনে বতুতা হযরত শাহজালাল (র সাথে মোলাকাতের জন্য ১৩৪৬ খৃ: সিলেট আসেন। তিনি নহরে আজরক দিয়ে জলপথে সিলেট আসেন। আরবী আজরক এর অর্থ হল নীল রং। নহরে আজরক অর্থ হল (সুর্মা) তাই সুরমা নদীরই নাম।

তিনি সিলেটকে কামরুপের অন্তর্গত বলে চিহ্নত করেছেন। সুরমার তীরে ঐতিয্যবাহী নিদর্শন সমুহ চাদনীঘাট এর সিড়িঁ: সিলেটে সুরমার তীরে রয়েছে পুরোনো নির্দশন চাদঁনীঘাটের সিঁড়ি। সিলেটকে আসামের অর্ন্তভুক্তি নিয়ে সিলেটবাসী প্রতিবাদের ঝড় তোলেন। তাদের সান্তনা দেবার জন্য বড়লার্ট লর্ড নর্থব্রুক সিলেট উপস্থিত হন। এক দরবার অনুষ্টিত হয়।

বড়লাটকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য সুরমা নদীর ঘাটের সুন্দর সিঁড়িগুলো তৈরী করা হয়। আলী আমজাদের ঘড়ি: চাদনী ঘাট ও ক্বীন ব্রীজের পাশেই শোভা পাচ্ছে আলী আমজাদের ঘড়িঘর। পৃথ্বিমপাশার বিখ্যাত জমিদার আলী আমজাদ দিল্লীর চাদঁনীচকে শাহজাদী জাহানারার স্থাপিত ঘড়িঘর দেখে মুগ্ধ হন। তিনিও ইচ্ছা পুরণ করেন চাদঁনীচকে দেখা ঘড়িঘরের অনুকরণে সুরমা নদীর তীরে চাদঁনী ঘাটের কাছে একটি ঘড়িঘর তৈরী করে। সবার নিকট যা ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’ বলে পরিচিত।

ক্বীন ব্রীজ: সিলেট নগরীর প্রবেশ দ্বার হচ্ছে ক্বীন ব্রীজ। সুরমা নদীর উপর স্থিও ভাবে দাড়িয়ে থাকা এই ব্রীজটির রয়েছে ইতিহাস। গত শতকের তিরিশ দশকের দিকে আসাম প্রদেশের গর্ভর্নর ছিলেন মাইকেল ক্বীন। তিনি তখন সিলেট সফরে আসেন। তার স্মৃতিকে অম্লান করে রাখতেই এ ব্রীজটি নির্মাাণ হয়।

জানা যায়, সে সময়ে আসামের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল ট্রেন। রেলওয়ে ষ্টেশনটিও দক্ষিন সুরমায় অবস্থিত। সঙ্গত কারনেই সুরমা নদীতে ব্রীজ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। রেলওয়ে বিভাগ ১৯৩৩ সালে সুরমা নদীর উপর ব্রীজ স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। ১৯৩৬ সালে ব্রীজটি আনুষ্টনিক ভাবে খুলে দেওয়া হয়।

ব্রীজটির নামকরন করা হয় গর্ভণর মাইকেল ক্বীনের নামে। ক্বীন ব্রীজটি লোহা দিয়ে তৈরী। এর আকৃতি ধনুকের ছিলার মত বাকাঁনো। উপর ভাগ পিঞ্জিরার মত। ব্রীজটির দৈর্ঘ ১১৫০ ফুট।

প্রস্থ ১৮ ফুট। ব্রীজটি নির্মাণ করতে তখনকার দিনে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৫৬ লাখ টাকা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্থানী হানাদার বাহিনী ডিনামাইট দিয়ে ব্রীজের উত্তর পাশের একাংশ উড়িয়ে দেয়। স্বাধীনতার পর কাঠ ও বেইলী পার্টস দিয়ে বিধ্বস্ত অংশটি মেরামত করে হালকা যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ব্রীজটি এক নজর দেখার জন্য প্রতিদিন বিপুল সংখ্যক পর্যটনের ভীড় জমান সুরমার তীড়ে।

সুরমার তীরে সুন্দরের ঝলকানীতে মোহীত হয় মানুষ। জোট সরকারের আমলে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী এম সাইফুর রহমানের উদ্যোগে ২০০৫-০৬ অর্থ বছরে সুরমার তীড়ের সৌন্দর্য বর্ধিত করতে ৫ কোটি ৭২ লাখ টাকা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। শহরের কোলাহল থেকে ক্ষানিত অবসর নিতে সুরমার তীড়ে এসে অবসাধ গ্রহন করেন সৌন্দর্য পিপাসুরা। সুরমার তীরে এই সুন্দরের চাদর চোখে না দেখলে কল্পনা করা যায় না। এছাড়া সুরমা নদীর উপর দিয়ে নির্মিত হয়েছে আরো ব্রীজ সেগুলো হচ্ছে শাহজালাল ব্রীজ, শাহপরান ব্রীজ, টুকেরবাজার ব্রীজ।

সুরমাপাড়ের শিল্প-বাণিজ্যের অতীত ও বর্তমান ভৌগোলিক কারণে প্রাচীনকালে সিলেটের সঙ্গে দেশের অনান্য স্থানের যোগাযোগের প্রধান উপায় ছিল নদী ও হাওড়ের নৌপথ। তাই সুরমা নদীকে কেন্দ্র করে নদীর দু-পাড়ে গড়ে উঠেছিল নগর-বন্দর ও জনপদ। সড়ক পথে যোগাযোগ গড়ে ওঠার পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের সঙ্গে বাংলা এবং এর নিকটবর্তী ভূথণ্ডসমূহের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্যের আদান-প্রদান নিয়মিত ভাবে চলত সুরমা নদী ধরেই। কৃষিই ছিল তখনকার সুরমাপাড়ের জনগণের অন্যতম ভিত্তি। এছাড়া দু-পাড়ের জনগণের একটি বড় অংশ বিভিন্ন ধরনের হস্ত-কারুশিল্পের সাথে যুক্ত ছিল।

হান্টারের বর্ণনা মতে ১৮৫৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত সিলেটের সাথে যোগাযোগের একটি মাত্র রাস্তা ছিল, কিন্তু তার অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। তাই ব্যবসা-বাণিজ্যের মালামাল নদীপথে পরিবহন করা হতো। সারাবছর দূরবর্তী স্থানে যাতায়াতের সুবিধার জন্য জাহাজের তুলনায় ছোট ছোট নৌকারই প্রচলন ছিল বেশি। বিশেষ করে অধিকাংশ স্থান জলের নিচে ডুবে থাকায় এই নৌকাসমূহ দ্বারা ব্যবসা-বাণিজ্য অব্যাহত থাকত । ( সুরমা উপত্যকার শিল্প ও বাণিজ্য, সিলেটের ইতিহাস ও ঐতিহ্য, প্রিয়াম গোস্বামী, পৃ. ৩৩৬) সেকালে স্থলপথে যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নত ছিল না।

তবে কলকাতা থেকে একটি রাস্তা ঢাকা হয়ে সিলেট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে জানা যায়। জলপথই ছিল চলাচলের একমাত্র মাধ্যম। কলকাতা থেকে জলপথে ঢাকা এবং ঢাকা থেকে সিলেট যাওয়ার পথে পড়ত বুড়িগঙ্গা, ছোট মেঘনা ও সুরমা নদী। ছোট মেঘনা দিয়ে সুরমা হয়ে সবচেয়ে সোজা ও সংক্ষিপ্ত পথে দাউদকান্দি থেকে সিলেট যাওয়া যেত। প্রাচীনকালে সুরমাপাড়ের জনপদগুলোতে ছোট ছোট গৃহজাত শিল্পের সাথে লৌহশিল্প ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।

সিলেটের তৈরি ঢালেরও খ্যাতি ছিল ভারতজোড়া। ইটা পরগনার জনার্দন কর্মকার মুর্শিদাবাদের নবাবের জন্য জাহানকোষ নামে একটি কামান তৈরি করেছিলেন। কামানটি এখনো মুর্শিদাবাদের হাজার-দুয়ারীতে রক্ষিত আছে। এছাড়া গৃহজাত শিল্পের মধ্যে লস্করপুরের উর্ণিচাদর, মাছুলিয়া গ্রামের এন্ডি, গায়ে দেয়ার গেলাপ, মাছ ধরার ঝাকিজাল, উড়াজাল, উথালজাল , হৈফাজাল, হাটজাল, পেলুইনজাল ইত্যাদি নানা জাতের জাল, সুনামগঞ্জের রঙিন কাঠের খেলনা ও খড়ম, তরপের বেহালা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সিলেটের পাটিয়ারা দাস নামক এক শ্রেণীর লোক উৎকৃষ্ট শীতলপাটি তৈরি করত।

কাঁথা সেলাই কাজে মেয়েদের সুখ্যাতি ছিল। এছাড়া সিলেটে হাতির দাঁতের কাজ, শাঁখাশিলা, বাঁশবেতের নানান বস্তু তৈরি ও পাতার ছাতি তৈরির জন্যেও সুনাম অর্জন করে । ( দীনেশ চন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, ২য় খণ্ড-পৃ.১৭১-৭২, ২১, ২৯৩) মণিপুরী সম্প্রদায় হস্তশিল্প তৈরিতে এক উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে আছে। এরা তাদের নিজস্ব তাঁতে চাদর ও শাড়ি সহ বিভিন্ন রকমের বস্ত্র তৈরি করে থাকে। প্রাচীনকালে সুরমা উপত্যকায় প্রচুর হাতি পাওয়া যেত।

তাই হাতির দাঁতের পাটির সুনাম এক সময় দিগি¦দিক ছড়িয়ে পড়েছিল। হাতির দাঁত থেকে চুলের মতো চিকন বেত তৈরি করে পাটি বোনা হতো এবং সেই পাটি প্রচুর দামে বিক্রি করা হতো। এছাড়া হাতির দাঁত থেকে পাখা, চুড়ি, চিরুনি, খড়মের গুটি, লাঠি, দাবা ও পাশা খেলার গুটি তৈরি হতো। শীতলপাটিও সুরমাপাড়ের হস্তশিল্পের উল্লেখযোগ্য নির্দশন। র্মুতা নামক এক প্রকার বনজ গাছ থেকে বেত সংগ্রহ করে শীতলপাটি তৈরি করা হয়।

র্মুতা থেকে বেত তুলে তা বিশেষ পদ্ধতিতে সিদ্ধ করার পর পাটি বোনা হয়। পাটিতে নিপুণভাবে বিভিন্ন নকশা ফুটিয়ে তোলা হয়। এছাড়া বেতের তৈরি আসবাবপত্রও সুরমাপাড়ের একটি অন্যতম শিল্প হিসেবে পরিচিত। সুরমাপাড়ের জঙ্গলগুলোতে প্রচুর জালিবেত পাওয়া যায়। আর বেত দিয়ে খাট, চেয়ার, টেবিল, শেলফ, বাকশো-পেটরা, সোফা প্রভৃতি আসবাবপত্র তৈরি হয়।

শহরবাসীর কাছে এসব শিল্পের কদর কম নয়। শেষ কথা সুরমাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে সিলেটের সংস্কৃতি ও সভ্যতা। সিলেটের প্রকৃতি ও জীবনের সাথে এ নদী অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। সিলেটের অস্তিত্বের শেষ দিন পর্যন্তও যেন বেঁচে থাকে এ নদী।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.