আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কিংকর্তব্যবিমূঢ় মহানাগরিক জন

পারলৌকিক হ্যাঙ্গারে হ্যাঙ্গ হয়ে আছে ইহকাল / পুনরায় জন্ম নেয়া এখন বিশেষ প্রয়োজন যখন কিছুই করার থাকে না তখন সবাই কী করে! কী করতে পারলে কিছু করতে না পারার বেদনা খানিকটা লাঘব হয় আমার জানা হয়নি। বহুবার আমারও এমনই হয়েছে। আমি অন্যদের এমন অনুভূতির সাথে পরিচিত। অন্য অনেককে দেখেছি তারা কিছুই করার থাকে না বলে মাদক সেবন করে। কিছুই করার নেই বলে যে মাদক সেবন করে তা কিন্তু আমার মনে হয়নি।

তারা একটা অযুহাত দেখাবার অপচেষ্টা করে। তারা কৃত্রিম হতাশার ছবি ফুটিয়ে রাখে মুখের উপর। তাদের হতাশ মুখ দেখে আমাদের অনেকের ভেতর হতাশা সৃষ্টি হয়। যাদের কিছুই করার থাকে না তারা সাধ্যমত নিজের প্রতি মনযোগ দেয়। মনযোগ দেবার পদ্ধতিটি বেশ মজার।

আমার জনৈক বন্ধু শুষ্ক মঞ্জুরি সেবন করে। শুষ্ক মঞ্জুরি নামটি সম্ভবত কবি নির্মলেন্দু গুন দিয়েছেন। নির্মলেন্দু গুন গুনী কবি। তার দেয়া নামটি আমার খুবই পছন্দ হয়েছে। গাঁজার নাম শুষ্ক মঞ্জুরি দেয়ায় এ জিনিসটিকে বেশ কাব্যিক আর শিল্পময় লাগে।

মাদক হিসেবে এই শুষ্ক মঞ্জুরির ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এটিকে মেধাবীদের ধ্যানমগ্ন হবার টনিকও বলা হয়, কারণ মেধাবীরাই এটা বেশি সেবন করে। আমার দু’একজন মেধাবী বন্ধু, যারা বুয়েট-মেডিকেলে পড়ে, তাদের মতে, একাগ্রতা লাভের উদ্দেশ্যেই তারা এটি সেবন করে। আমি তাদের কথা বিশ্বাস করেছি। লালনের আখড়ার সবাই এটি সেবন করে।

লালন অনুসারী বেশ কয়েকজন বাউলকে দেখেছি যে তাঁদের গাল ভেতরে ঢুকে গেছে, তাঁরা মহিষের শিং কলকে হিসেবে ব্যবহার করে এটি সেবন করে। আমি ওঁদের ঈর্ষা করি। কারণ আমি গোবেচারা টাইপ মানুষ, ধূমপান করা শিখি নাই। কিন্তু বেশ কয়েকজন ধূমপায়ী বন্ধুকে রসিকতাচ্ছলে পরামর্শ দিয়েছি, যেন তারা ধূমপান ত্যাগ করে শুষ্ক মঞ্জুরি সেবন করে। কারণ সিগারেটে তামাকের সাথে থাকে কেমিকেল।

আর গাঁজা, পুরোপুরি প্রাকৃতিক, প্রকৃতি থেকে সরাসরি প্রাপ্ত। মানুষ যেহেতু প্রকৃতির সবচেয়ে নিবিড় সৃষ্টি, তাই মানুষের শরীরে এটি বেশ ভালভাবেই মানিয়ে যায়। মগজে এটি বেশ প্রভাব সৃষ্টি করে, যে কারণে যেকোনও কিছুতে মননিবেশ করতে সুবিধে হয়। এ জন্যই হয়তো শিল্পীরা এটিকে পছন্দ করেন। খেয়াল করে দেখলাম এমন কোনও পেশার মানুষ নাই যে এটি সেবন করেন না।

ঢাকা শহরের প্রতিটি মানুষের মুখের দিকে তাকালে মনে হয় সবাই শুষ্ক মঞ্জুরি সেবন করে। শুষ্ক মঞ্জুরি করুক আর যাই করুক, সবার ব্যক্তিগত একটি একাগ্র হবার টনিক থাকে। আমার জনৈক বন্ধু প্রচুর পরিমানে মদ্যপান করেন। তিনি ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে মদ্যপানের সময় আমাকে টিটকারি করে বলেন, যতদিন এসব পান করা শিখবে না ততদিন শিশুই থেকে যাবে। আমি শিশুর মত হাসি।

তার খপ্পরে পড়ে আমার অ্যালকোহলের অভিজ্ঞতা হয়ে যায়। ঢাকা শহরের মানুষেরা যে-যার সাধ্যমত মাদক সেবন করে। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এ শহরের মানুষেরা যে পরিমাণ অর্থ মাদকের পেছনে খরচ করে তা যেন জাতীয় অর্থনীতির খুব মেজর একটা অংশ। আমার বাসা কমলাপুর। দেখা যায় সেনাকল্যান ভবন ছাড়িয়ে খানিকটা ভেতরের দিকে এগিয়ে গেলে দেখা যায় ঝুড়িভরা মদের বোতল, বিক্রি হচ্ছে।

মানুষ কী পরিমানে মদ্যপান করে তা দেখলে বিস্মিত হতে হয়। এ শহরের পথশিশু আর ভিক্ষুকরাও মাদকাসক্ত। তারা কী মাদক খায়! তারা সল্যুশন খায়। সল্যুশন হলো ‘সমাধান’ সেটা আবার কীভাবে খায়? স্যান্ডেলে লাগানো আঠা। পলিথিনে ভরে বাতাস নেয়।

দেখলে মায়া লাগে। অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হলে হয়তো অন্য কিছু খেত। সল্যুশন তাদের কিছুই করতে না পারা জীবনের সমাধান দেয় না। ছবির হাটে একজন আইটি প্রফেশনালের সাথে পরিচয় হলো। বন্ধুর বন্ধু।

সেহেতু বন্ধু। বর্ণনা করছিলেন ইয়াবা খাওয়ার অভিজ্ঞতা। তার বর্ণনা এমন, ‘আরে খাইলে কিছুই হয় না। সমস্যা একটাই, সেক্স কইমা যায়। সেক্স কইমা গেলে কী হইবো, হইব কী এত সেক্স দিয়া, কার জন্য রাখমু এত সেক্স?’ মার্চের শেষ রাতে আমার এক বন্ধু মায়ের শাড়ি গলায় পেচিয়ে চলে গেছেন।

তিনিও মাদকে আসক্ত ছিলেন। তিনি বললে ভুল হবে। মাদক তাতে আসক্ত ছিল। এলএসডি ট্যাবলেটও তিনি জোগাড় করে টেস্ট করেছিলেন জীবদ্দশায়। প্যাথেড্রিন নিতে নিতে সেগুলো তার শরীর থেকে চুইয়ে চুইয়ে বেরিয়ে আসতে লাগলো একসময়।

তার হতাশা ছিল কী হবে এ জীবন দিয়ে? যে দেশ আমরা চেয়েছিলাম সেই দেশ তো পাওয়া হয়নি। চারিদিকে দেশ জাতির বিরুদ্ধে এত ষরযন্ত্র। তিনি তাই মাদক সেবন করে সেই ষড়যন্ত্র ভুলে থাকার চেষ্টা করতেন। তার বাবা মাঝে মধ্যে তাকে জেলে রেখে আসতেন, যখন তার আসক্তি অস্বাভাবিক হয়ে উঠতো। তার জীবনে এত মাদক তিনি সেবন করেছেন যা অনেকে নামও শোনেনি।

জেল থেকে বেরিয়ে তিনি বিরক্ত বোধ করে বলতেন, জেলের ভেতরে সাপ্লাই আছে, বাইরে নাই, তাইলে ক্যান আমি বাইরে থাকবো। তিনি জেলের ভেতরে লাইব্রেরীতে কাজ করতেন। সবাইকে পড়াতেন জোর জবরদস্ত করে। যে কটা টাকা পেতেন নিজের মাদক সেবানের জন্য কিছু রেখে বাকীটা বন্টন করে দিতেন। আমার এ প্রয়াত বন্ধুটি তার সময়ের সবচেয়ে মেধাবী মানুষ।

তাকে সাথে নিয়ে মেঘরাখাল নামে একটি ছোটকাগজ বের করেছিলাম। তখন আমারও কিছু করার ছিল না। কিছু করার না থাকলে কিছু তো একটা করতেই হয়। কিছু করার না থাকলে অনেক কষ্ট হয়। যখন কষ্ট হয় তখন কিছু একটা করতেই হয়।

একবার এক এনজিও কর্মী তার বিশেষ প্রজেক্টের কাজে রেললাইনের পাশে বসবাসরত মানুষের সাথে কথা বলতে গেলেন। তার প্রশ্নমালার তালিকা বের করে রেললাইনের পাশে বস্তীতে বসবাসকারী এক গৃহকর্তাকে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন। আপনার ছেলে মেয়ে কয় জন? চাইড্ডা পোলা সয়টা মাইয়া। এতগুলো ছেলে মেয়ে কেন নিলেন? আপনিতো রীতিমত অপরাধ করে ফেলেছেন। বাঙালীর অন্যের কাধে দোষ চাপিয়ে দেবার প্রবণতাটি খুবই স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

সে বলল, আমার কী দোষ কন, সব দোষ ঐ ট্রেনের। এনজিও কর্মী হতবাক। আপনার এতগুলো ছেলে মেয়ে হওয়ার দোষ ট্রেনের, কীভাবে? লোকটি জবাব দেয় -- রাইত তিনডার সুমায় টেরেন যায়গা, তখ্খন গুম জায়গা বাইঙ্গা। কী করমু কন, কিছুতো এট্টা করন লাগবো। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।