আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেট্রো টু রামাদান – ৬

আমার পরিচয় আমার রোজনামচায়। ক) কর্মক্ষেত্রের শুরু আমার কোচিং সেন্টার থেকেই বলা যায়। আমি কোচিং-এ পড়ানোর কারণে ইফতারির দাওয়াত পেয়েছি অনেক; কিন্তু গিয়েছি কম। জেনুইন, সেঙ্গুইন প্লাস, সাইফুরস, এমসিএইচ, গ্রীণ বাডস, ইউসিসি আরও অনেক কোচিং এ পড়িয়েছি। তবে ইফতার করেছিলাম সাইফুরস এ।

সাইফুরস তখন নতুন বলা যায় চিটাগং এ; ইমরান ভাই ছিলেন পরিচালক চিটাগাং ব্রাঞ্চের। স্টুডেন্ট অতটা ছিলো না। তাই ইফতার করেছিলাম স্টাফদের সাথেই; স্টুডেন্টদের সাথে করা হয় নি। কিন্তু টিউশানি করাতে গিয়ে ইফতার করেছি ছাত্রছাত্রীদের সাথে। অনেক পরে – যখন টিউশানি ছেড়ে দেবো দেবো এমন সময়ে - মোক্তার ভাইয়ের একটা কোচিং সেন্টার ছিল জামালখানে - এক্সপার্টস কেয়ার – সেখানে ইফতারি হয়েছিল।

খুব মজা হয় ছাত্রছাত্রীদের সাথে ইফতারীতে, অনেক হৈ হৈ হয়, অনেক আন্তরিকতা বাড়ে। তবে টিউশানি কোচিং করতে গিয়ে বাইরে – হোটেলে – টং এ ইফতারি করা হত। মজা করে একজন বন্ধুকে সাথে করে ইফতার কিনে চলে যেতাম প্যারেড মাঠে। খোলা উদ্যান আর খোলা আকাশের নীচে ইফতার করার মজাই আলাদা। অনেক বেশী আপন মনে হয় প্রকৃতিকে।

কোচিং এর পাশাপাশি জবকেয়ার নামের একটা কোম্পানীর মার্কেটিং কনসালটেন্সী আর রিয়েল স্টেট ব্যবসা করতাম। অনেক জায়গায় ঘুরা হয়েছে রিয়েল স্টেট ব্যবসার অভিপ্রায়ের কারণে। অনেক স্থানে ইফতার করে নিয়েছিলাম মুসাফিরের মত। খ) কোচিং ছেড়ে চলে এসেছি ঢাকায় – চাকুরী কল সেন্টার - সিটিসেল। সিটিসেল এ বকবকানির চাকুরী করেছি বেশী হলে ২৮ কর্ম দিন।

প্রথম চাকুরী। এর মধ্যে পড়ে গেছে রমজান মাস। আমার এখনও মনে আছে আমার ডেস্কে ইফতার রাখা হয়েছিল জুস-বার্গার আর মিষ্টি আর আমার কানে এক কাস্টমার আতংক নিয়ে বলছিল, “ ভাই ! মোবাইল নাকি বাস্ট করে?” রোস্টার ডিউটি ছিল বলে সব সময় ইফতার হয় নি অফিসে। সে সময় আম্মুর জন্য ভীষণ খারাপ লাগত। বউবাজার পানিরকল বাসায় আম্মু একদমই একা।

কি দিয়ে ইফতার করছে তার খবর আমি জানতে পারতাম না। কারণ আম্মুর তখন মোবাইল ছিল না। গ) পোস্টিং আমার হল সোজা মহাখালী টু নোয়াখালী। ইন্টারনাল ইন্টারভিউতে পাস করেই ট্রেইনি থেকে সোজা কাস্টমার কেয়ার এক্সিকিউটিভ। পুরা নোয়াখালী আমার দখলে।

আমি খুব খুশী ছিলাম না। তবে মাস শেষে যা বেতন পেতাম তা দিয়েই মন ভাল হয়ে যেত। নোয়াখালীতে এসে উঠেছিলাম এক মেসে – আজমীর ভবন – গোলাবাড়িয়া দীঘীর পাশে চৌমুহনী। বাবলু ছিল ওই মেসের মেইন। বাবলু খুব ভাল ছেলে – দুর্গাপুর তার বাড়ী।

এক বছর হল। নোয়াখালীতে প্রথম ইফতার। আমার বাসায় প্লেটে যেভাবে সাজানো হয় ইফতার – এখানে মেসে তা হত না। বিশাল এক খাঞ্চা এনে তাতে সব ইফতারি রেখে গুড়ো গুড়ো করে তারপর মুড়ি মাখিয়ে মেশানো হত। জিলাপী – হালিমও মেশানো হত যদিও আমার এটা পছন্দ হত না।

আমি আমার দাদা বাড়িতে কামরুল চাচ্চুর কাছে এই কালচারটা পেয়েছি। সব মাখিয়ে সবাই মিলে মাটিতে বসে মুঠো মুঠো করে ইফতার খাওয়া। আমি দেখিনি সোয়াব কি জিনিস, তবে আমার - এমন করে খাওয়াটা - মুঠোয় পুরে সোয়াব নেয়া মনে হত। আমাকে কোম্পানি থেকে ডেইলী ১৫০টাকা ইফতারী বাবদ খরচ দেয়া হত। ডিলার শফিক ভাই দেখা যেত অফিসে ইফতারীর আয়োজন করেছেন।

তাই চামে টাকা বেঁচে যেত। আমার অফিস ছিল টিন শেড এর। মোবাইল ফোনের দোকানে আমি সিটিসেলের ভাব সাব নিয়ে বসতাম। সেসময় বিটিআরসি মোবাইল ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে রি-রেজিস্ট্রেশান দেখতে চেয়ে নির্দেশ দিয়েছিল। সে কি হুলুস্থুল অবস্থা।

আমি মানুষের ফরম ফিলাপ আর অন্যান্য সার্ভিস দিতে দিতে আর পরের দিনের কাজ গুছাতে গুছাতে রাত ১০টা বাজিয়ে ফেলতাম। রোজা রেখে এতসব করার ক্লান্তি আর তার মাঝে রিফ্রেসমেন্ট ছিল প্রথম টি-২০ ক্রিকেট। বাসায় ফিরে লাল পানি দিয়ে গোসল খুব অসস্তি লাগত। ফারিনকে ফোন করে সব বলতাম। ফারিন সব বুঝতো – কিন্তু পরে আবার বুঝত না।

রোজায় লক্ষীপুর সিসিপিতে কলিগের অফিসিয়াল ঝামেলার জন্য আমাকে পাঠানো হয় সে অফিস সামলাতে। সেই সুবাদে লক্ষীপুর ঘুরাও হয়। সেখানে আমি কিছুটা টাউনভাব পেয়েছিলাম, ছিমছাম লেগেছিল। লক্ষীপুরের অফিসেই ইফতার করে সেখানের হাসপাতাল রোডে চলে যেতাম রসমালাই বা গরম রসগোল্লা খেতে। লক্ষীপুরের অফিস স্টাফরা – ডিলার মানিক ভাই – ওরা অনেক অমায়িক লোক।

লক্ষীপুর থেকে বাড়ী চট্রগ্রাম ফিরতে লাগে চার ঘন্টা। অনেক বেশী সময় লাগে বাসায় যেতে। তবে নোয়াখালীতে যখন এসেছিলাম – প্রথম বেতন পেয়েই মা কে একটা নোকিয়া ফোল্ডিং সেট কিনে দিয়েছিলাম। তাই কথা হত। আমার নোয়াখালী অফিসে এক রমজানে আগুন লেগেছিল।

আগুনে পুড়ে অফিস কাল। খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। আমার চেয়ার-ডেস্ক-কম্পিউটার সব পুড়ে গেছে শর্ট সার্কিটের কারণে। আমি তখন লক্ষীপুরে আর লক্ষীপুরের এক্সিকিউটিভকে দেয়া হয়েছে নোয়াখালীতে সাময়িকভাবে। ব্যাটার উপর খুব রাগ হল।

নিজের তৈরী কর্মক্ষেত্র পুড়ে গেলে কি কষ্টটা হয় তা কখনো বোঝানো যাবে না। রমজান শেষে ঘরে ফেরা। ঘরে ফেরার মত মধুময় কিছু নাই। যেভাবেই হোক একটা যে কোন বাসের পেছনের সীটটা হলেই হল। আমার প্রত্যেকবার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের নদী সাঁতরিয়ে মায়ের কাছে পৌঁছানোর গল্পটা মনে হত।

ঘরে ফেরার জার্নির মত দুচোখ ভরা আশা - আর কিছুই হয় না। এটা পুরো রাস্তায় প্রতিটা সেকেন্ড অনুভব করার মত। ঘ) সিটিসেল চাকুরী ছেড়ে এসেছি চট্টগ্রামের এক কোম্পানি জিটিআর এ। ম্যানেজার বন্ধু ফয়সাল। এখানে কাজের প্রেসার যাই থাক আম্মুকে মিস করার কষ্টটা নাই।

ঢাকা থেকে নানা নানু খালারা চলে আসাতে আম্মু আর একা নাই। জিটিআর এ আমার ছিল সেলস এ চাকুরী। বিভিন্ন জায়গায় চাপাবাজি সেরে অফিসে ফিরতাম সবাই একসাথে ইফতার করবো। এ অফিসের আন্তরিকতাটা ছিল এরকম। ঙ) কিন্তু আমার উচ্চাকাংখা আবার আমায় ঢাকায় পাঠিয়ে দিল।

এপেক্স ইনভেস্টমেন্ট – একটা ব্রোকার হাউজ। মজা পেলাম এখানের আবহাওয়ায়। আমি কতকটা ফ্রাস্ট্রেটেড ছিলাম অফিসে। তাই একাউন্টসের এক কোণে ফাইলে মুখ গুঁজে পড়ে থাকাটাই জীবন হিসেবে ভাবতে শুরু করলাম। হায় নিয়তি! কাজের প্রেসার নেবার কারণে এক সপ্তাহের মধ্যে দায়িত্ব পাই বাকী ব্রাঞ্চগুলার একাউন্টসের।

পরে ডিপার্টপমেন্ট বদলে চলে গিয়েছিলাম কর্পোরেট সেলসে। ঢাকা শহরের ইফতার। রকমারীর ছড়াছড়ি। লালবাগে ইফতার করেছি কাবাব টিক্কা আর কত কি। কাশ্মীরি সরবতটা চমৎকার।

বন্ধুরা মিলে খুব মজা করেছিলাম ওই ইফতারিটা। আমি ঢাকায় একটা মেসেই থাকতাম বনশ্রীতে। মাহমুদ আর ওর কয়েকজন বন্ধু ছিল। সাধারণ ইফতার করত ওরা। আমি অবশ্য এদিক ওদিক মজার খাবার খুঁজে বেড়াতাম।

আমার মুসাফিরের মত ইফতারী করার সুযোগ ছিল ওটাই। তবে ভুলতে পারবো না কর্পোরেট ইফতারী – দা এইটের। আমাদের অফিস থেকে সেই রকম ইফতারী ছিল ওটা। বুফে ইফতারী যে যা পারো কাচিয়ে খাও। আইটেম ছিল – চিকেন টিক্কা, পরাটা, কাবাব, চিকন চিকন ছোট ঘিয়ে ভাজা জিলাপী, বেগুনী, পিয়াজু, ফ্রুট সালাদ, হালিম, পায়েস, শরবত, কোল্ড টি, কফি, আরও অনেক রকমের চাটনী আইটেম, পোলাউ, বিরিয়ানী – পুরা খাবারে গিজগিজ।

আমি প্রচুর কাবাব খেয়েছি। একটা টিপস দেই - বুফে খেতে গেলে প্রথমে সিদ্ধান্ত নেবেনঃ আপনি কি ওরা (রেস্তোরাওয়ালারা) কেমন রাঁধে তা জানতে চাইছেন? নাকি ওরা যা বিল ধরাবে তা উসুল করতে চাইছেন? যদি প্রথম শর্তের সাথে একমত হন তাহলে সব গুলো ডিস একটু একটু করে পরখ করে দেখবেন। এটার জন্য পেটের রিস্ক আপনার। আর রেস্তোরাওয়ালারা অনেক সেয়ানা – তারা আজাইরা আইটেম অনেক দিয়ে রাখে, যাতে মানুষ এটা কি জিনিস ওটা কি জিনিস করে করে আসল মেনু থেকে দূরে থাকে। আর যদি দ্বিতীয় শর্তের সাথে একমত হন তাহলে এক নজরে টেবিলের সব আইটেমগুলো দেখুন।

আজাইরা আইটেম গুলা বাদ দিন। এবার লাক্সারী আইটেম গুলাতে চোখ রাখুন। তেল চুপচুপা খাবার বাদ দিন, কারণ মুখ মেরে গেলে আর পয়সা উসুল হবে না। আমার প্রতি নিয়ত খাসীর মাংস নেয়া আর গপগপ করে কাবাব খাবার স্টাইল কখনও রেস্তোরা মালিকের পছন্দ না – আমি বোরহানীর পক্ষে যাই সোডা ড্রিংকসের চাইতে। এরচেয়ে ভাল স্ট্রেটেজি অনেকের জানা থাকতে পারে, তবে ভাল ভাল ফ্রুটসের আইটেম থাকে - ওটা নিতে ভুলবেন না।

চ) তবে গুলশানে পুর্ণিমা রেস্তোরায় আমাদের ব্যাচের ক্যাডেট কলেজের পোলাপাইনের ব্যাচেলার ইফতার পার্টির চেয়ে মজা আর কিছুই ছিল না। অনেকেই বিবাহিত ছিল। কিন্তু প্ল্যান হল যে যেখানেই থাকুক – ইনফর্মালভাবে অফিস টফিস সেরে আসতে হবে ইফতারীতে – উদ্দেশ্য কিন্তু সবাই দেখা হচ্ছে তা নয় – সবাই একসাথে ক্লাস সেভেনে ফিরে যাচ্ছি। তাই বউ বাচ্চা নট এলাউড (যদিও অনেকে মাইন্ড করেছে)। ফ্যামিলি পার্টি আমরা ওএফএ থেকে পাই বা ক্যাডেট কলেজ ক্লাব থেকেও।

কিন্তু ক্লাস সেভেনে ফিরে যেতে হলে তখন ব্যাপারটা অদ্ভুত হতেই হবে। তবে যতই বাসা ছেড়ে বাইরে ইফতার করি না কেন মা কে ছাড়া আমি আর কোন রোযা ঈদ করতে চাই না। আবার চাকুরী ছেড়ে চট্টগ্রাম। এখানে যে কোম্পানিতে ঢুকলাম তা বন্ধই হয়ে গেল। আমি আমার ক্যারিয়ার এমন কিছু গড়ে তুলতে পারিনি এখনও।

তারপরও - আই এম প্রাউড টু বি আ হোম সিক এন্ড আই হ্যাভ নো রেগ্রেট ফর দা ওয়ে আই লিভ। সবার জন্য কিন্তু এ ফিলোসফি নয়। ধন্যবাদ। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১২ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।