আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রেট্রো টু রামাদান - ১

আমার পরিচয় আমার রোজনামচায়। ক) “নামায পারলো, সাহরী খালো। ভাইয়ো - নামায পারলো, সাহরী খালো। ” আমার কানে এখনো বেজে ওঠে সেই ভাঙ্গাচোরা বিহারী দারোয়ানটার কন্ঠ। সারা লালখানবাজার এলাকায় হয়ত একাই ডেকে ডেকে সবাইকে ওঠাতো।

আমি তাকে কখনও দেখিনি। আমি শুধু তাকে শুনেছি। শুনেছি তার হাতের ঝুনঝুন লাঠির আওয়াজ – দুমদাম করে গেইটে বারি দিত। আর সবাইকে চেঁচিয়ে বলত – “নামায পারলো, সাহরী খালো। ভাইয়ো - নামায পারলো, সাহরী খালো।

” কি বিরক্তি ছিল তার কন্ঠে! যেন কারো না উঠতে দেখে সে খুব চটে যেত। যে বাড়িতে লাইট জ্বলতো না সেখানে চেঁচাতো বেশী। শুনেছি সে এর জন্য কমপ্লেইন খেয়েছে, কিন্তু তার ডিউটি সে মন থেকেই করে গেছে। আমি তখন স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম নতুন। ছোট্ট থাকতে আমার অনেক কিউরিওসিটি ছিল।

আমি দারোয়ানটার আওয়াজ শুনেই দৌড়ে যেতে চাইতাম দেখতে, কিন্তু আমাকে ধরে রাখতো আমার মা না হয় আমার বাবা। জিজ্ঞেস করত, “কই যাও?” আমি কচি কন্ঠে বলতাম, “ওই লোকটা দেখব। ” উত্তর পেতাম, “কি দারোয়ান দেখবি – ঘুমাও। কাল স্কুল আছে। ” আমি কিন্তু মনে মনে দারোয়ানটার ছবি এঁকে ফেলেছিলাম।

মাস্তকালান্দার জটাধারী তাবিজ কবচ জড়ানো কিছু একটা হবে সে। এখনো শুনি সেহরী হলে তার কন্ঠ, প্রতি বছর - প্রতি রোজায় – আমার মনের চিলেকোঠায়। তিনি হয়ত আর পৃথিবীতে নেই, কিন্তু যতবার আমি মনে মনে শুনবো তিনি নিশ্চয়ই সোয়াব পাবেন। আমি তার জন্য দোয়া করি। খ) কিন্তু সেহরী আমার ছোট্টবেলায় প্রথমে বড়ই অপছন্দের ছিল।

জীবনের প্রথম রমজান কেমন ছিল বলতে পারবো না – তবে প্রথম জ্ঞান হবার পর এটা বুঝতাম - ইসলাম ধর্মের সংস্কৃতিটা আমার পরিবারে পালন হত খুব আগ্রহ নিয়ে উৎসবের মত করে। আমার মনে আছে আমি আর আমার কাজিন ন্যান্সিকে বলে দেয়া হল কাল থেকে রোজা। রোজা কি? এটা রাখতে হয়। কোথায়? তার ডেফিনেশানটা তখন আমাদের মাথার ফ্রিকোয়েন্সির উপর দিয়ে গেছে। যাই হোক ইফতার হবে এরপর দিন।

আমি খুব খুশী। ইফতারকে দেখবো – তবে তার আগে সেহরী আছে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে সেহরীকে আমি বিরানী-তেহরী এ জাতীয় কিছু ভেবে রেখেছিলাম। মজার খাবার হবে – তবে এটা অনেক রাতে উঠে খেতে হয়। আমার কাছে অনেক রাত মানেই হল ওই টাইমে ভূত-পেত্নী আসে আর তাদের মারতে লাল কমল আর নীল কমলকে থাকা চাই।

আমার গা ছমছম করা শুরু করল। ঘুমানোর জন্য যে পরিমাণ গল্পের নামে ভয় দেখানো হত তাতে ভোর রাত আমার কাছে পাতালপুরীর অন্ধকারে ছেড়ে দেবার মতই। যাই হোক ভোর রাতে উঠা হল। একি! গা ছমছমের কিছু পেলাম না। সবাই আমার এত সুখের ঘুমটার বরবাদ করে দিয়ে উঠে রাতের ডিনারটা আবার করতে লাগল।

একই খাবার, একই প্লেট, একই পানি – কিন্তু সেহরী কই? সবাই আমার দিকে খুশি খুশি মনে দেখছে, “ওলে বাবালে তুমি উঠসো, ছোট্ট রোজাদার?”, এই আহ্লাদীও চলছে, মুরগীর রান তুলে দিচ্ছে – ভাত দেখিয়ে “আরেকটু দি, আরেকটু দি” বলছে – কিন্তু সেহরী কেউ দিচ্ছে না। আমি আর থাকতে পারলাম না – চেঁচিয়ে উঠলাম, “সেহরী কই?” বাসার সবাই একসাথে বলল, “এই তো সেহরী। ” আমিঃ এটা তো ঘুমানোর আগেই খাওয়া হল। সবাইঃ এটাই সেহেরী বাবা। এই যুক্তি আমার পছন্দ হল না।

আমি সেহরী মেনুটা দেখতে চাই। আমিঃ তোমরা যে বললা সেহরী খাবা। ওটা কই? সবাই রিপিটঃ এটাই তো সেহরী। আমার মেজাজ ধরে গেল। সবাই এই ভোররাতে মস্কারী করার আর টাইম পেল না।

ঘুমটাতো নষ্ট করল সেহরীর দোহাই দিয়ে – এখন ডাল-ভাত দেখিয়ে বলে এটাই সেহরী। যাই হোক ন্যান্সীর সাথে পরামর্শ করা লাগবে। তাকে সেহরী টাইমে দেখলাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠে ন্যান্সীকে জানালাম – এই শোন! কালকে আমাকে বলসে সবাই সেহরী খাবে কিন্তু খায় নাই – তুই একটু ফ্রীজ টিজ এ দেখিস তো সেহরী পাস কিনা। আমরা ছোট বলে আমাদের থেকে লুকায় রাখসে হয়ত।

ন্যান্সী বলেঃ কালকেই তো সেহেরী খেলাম। আমিঃ কই? কোথায়? ন্যান্সীঃ ওই যা খেলাম। আমিঃ আমাকে তুইও মিথ্যা বলিস! আমি না তোর বড় ভাই? হায় রে আমার সেহরী! বুঝতে আরো তিন বছর লেগেছিল। গ) বিটিভি কোন রমজানে একবার রাতে হামদ ও নাথ এবং আযান প্রচারের সিদ্ধান্ত নিল। আর আমার যে কি মজা।

আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে প্রিয় ওই একটাই চ্যানেল – বিটিভি। আহ! বিটিভি এত্ত রাতে হামদ ও নাথ দেখাবে – ভোরের আযান দেখাবে। কি মজা। কেন যে সারাটা দিন দেখায় না! মজাটা আসলে হামদ ও নাথে নয়, ইলেক্ট্রনিক বাক্সটা চালু হয়ে আওয়াজ দিলেই আমাদের আনন্দের সীমা থাকেনা। যাই দেখাক সবই সুন্দর।

আমার মধ্যবিত্ত বাবার বাসায় টিভি ছিল সাদা কালো ১২ ইঞ্চি ন্যাশনাল টিভি। নানার বাসায় কালার টিভি – ইঞ্চি কত জানি না, তবে অনেক অনেক বড়। মনে পড়ে হুজুরেরা বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে আলোচণা করা শুরু করতেন অনেক ভাল লাগত। খুব সুর করে বিসমিল্লাহ বলতো। আলোচণার আগে অনেক হুজুর ‘আম্মা বাদ’ বলতেন – আর আমার মামা-খালারা দুষ্টামী করে নানুকে দেখিয়ে বলতেন – “আম্মা – তুমি বাদ, যাও শুয়ে পড়।

” আমি প্রতি সেহেরীতে উঠেই টিভি ছেড়ে দেই। এখন তো অনেক চ্যানেল। কোন একটা চ্যানেলে সারা রাত আল-কোরান পড়ে। আমি শুনি। আমার ৮৫ বছরের নানুও টিভি দেখে – বলে, “এই হুজুরগুলা আম্মা বা’দ বলে না?” যেন এই হুজুরগুলা উনাকে টিভি দেখা থেকে সরে যেতে বারণ করে নাই।

যাক এই হুজুরেরা সম্মান দেখিয়েছেন। তবে আসল কথা কি - এই সেহরী না হলে আর রাত জেগে কোরান তেলাওয়াত শোনার আকীদা টা কি পেতাম? ঘ) আমি যখন ক্লাস টু তে তখন মুরাদ পুরে থাকি - এক রমজানে সেহরীর সময়ে আবিস্কার করলাম – অনেক অনেক মসজিদে বিভিন্ন সুরে এক এক জন মুয়াজ্জিন আযান দেন। কি পরিস্কার প্রত্যেকটা আযান। অনেক দূরের আযান – অনেক কাছের আযান। আমার শোনা একটা মসজিদের আযান ছিল সবচেয়ে সুন্দর।

এত মধুর আযান আজ পর্যন্ত আমি কখনই শুনি নি। আমার মনে সে কন্ঠটা বাজে – অনেকটা ওস্তাদ হামিদ আলি খাঁ এর কন্ঠের মতন। চোখে পানি এনে দিত। কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে – কি যেন চলে যাচ্ছে – এই সময় – এই নামায । কায়কোবাদের কবিতার লাইনের মত।

“কে ওই শোনালো মোরে আযানের ধ্বনি মর্মে মর্মে সে সুর বাজিল কি সুমধুর আকুল হইল প্রাণ নাচিল ধমণী” অন্যের ঈমান রাখতে - নামায পড়াতে - এত মরমী সুরে মুয়াজ্জিন কেন ডাকে? কেন এত দরদী হয়ে উঠে? মুয়াজ্জিন কেন আমার ঈমান রাখার জন্য প্রতি পাঁচ ওয়াক্ত আমাকে আহ্বান করে? আমরা ইসলামের প্রতি কতটুকু দরদী হয়েছি? সেই দরদী আযান আমাকে প্রতিটি মুয়াজ্জিনের জন্য শ্রদ্ধা শিখিয়েছে , আল্লাহ রাসুলের প্রতি দরদী হয়ে কাঁদতে শিখিয়েছে, আর শিখিয়েছে –ভূত-পেত্নীর ভয় ভুলে- ভোর রাতে জেগে উঠা। আমার কৈশোরের সাহস ছিল সেই আযান যা আমি ওই বছরের সেহরী থেকেই পেয়েছি। ঙ) সেহেরী আর ঋতুর অনেক মজার মিল আছে। ইসলামে চাঁদ মাস হিসেবের কারণে বিভিন্ন ঋতুতে রোজা ঈদ পাওয়া যায়। আমি ছোট থাকতে রোজা পেয়েছি গরমের।

আম দুধ ভাত বা দুধ কলা ভাত ছিল আমার প্রিয় সেহেরী। সাথে গুড় হলে তো কথাই নেই। সেহেরীতে ঝাল ভাল লাগত না। একবার সেহেরীতে আনারস কাটা হল, সেদিন আমাকে দুধ ভাত দিল না। আনারস খেয়ে দুধ খেলে ফুড পয়জন হয়ে মারা যেতে পারে।

আমি ভয়ও পেয়েছিলাম। শীতের সেহেরী বড় কষ্টের, তার চেয়ে বেশী কষ্ট হয় যখন আম্মু অসুস্থ হয়ে পড়েন কিন্তু সেহেরীর সময় সবার জন্য খাবার রেডী করেন। প্রচন্ড ঠান্ডায় আম্মুর এক্সিডেন্টে ভাঙ্গা পা নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে খাবার গরম করেন। আমি সাহায্য করতে চাই – কিন্তু ওই এক কথা, “তুমি পারবা না”। আমি সব সময় হাবা গোবা হয়ে যাই, এখনও হাবাগোবা।

রান্নাটা শিখিনি যে, খাবার গরম তাও না। আমার রোজার জন্য সেহেরীর সময় আমার মা কেও কষ্ট করতে হয়। চ) এবার বলি ঝড়ের রাতের সেহেরীর কথা। প্রচন্ড দমকা হাওয়া – ঝমঝম করা বৃষ্টি আর সেহেরী খেতে বসেই লাইটস অফ। কারেন্ট নাই।

কি ভয়ংকর কালো! খট খট করছে দরজা – ডাইনী বাতাসের হু হু শব্দে ভেঙ্গে দেবে জানালা। মোমবাতির টিম টিমে আলো আর আমরা পরিবারের ক’জন তাড়াতাড়ি সেহেরী শেষ করতে বসেছি। এমন সময় – আমার গলাফাটানো চিৎকার – কি হল! কি হল! “আম্মু! তেলাপোকা!” দু’একটা রাত আমার উড়ন্ত তেলাপোকা হত্যাযজ্ঞে নেমে পড়তে হয়েছিল স্পঞ্জ সেন্ডেল হাতে। সেহেরীর সময় - ফজরের আযান দেয়ার আগেই - কারেন্ট না থাকা অবস্থায় - উড়ন্ত তেলাপোকা মারাটা সত্যিই খুবই টাইম চ্যালেঞ্জিং। ছ) একটা অভ্যাস এখনও যায় নি।

আযান দেয়া মাত্রই পানি খাওয়া। জানি না এটা কতটুকু শুদ্ধ অশুদ্ধ – তবে আযান দিয়েছে মানেই তাড়াহুড়ো করে পানি খাওয়া। যেন আমার সারাদিনের পানি খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আসলেই কি তাই নয়? একটা নির্দিষ্ট সময় পর আমার রিযিক বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আমি আর এই পবিত্র সেহেরীকে পাবো না।

একটা মরমী আযান হবে – মুরাদপুরের মুয়াজ্জিনটার– কি হারিয়েছি কি হারিয়েছি – আর তারপর সব বন্ধ। আমার রাহমাত পাবার - গুনাহ মাফের - সব কিছুর। আমি হাবাগোবা জিজ্ঞেস করব, “সেহেরী কই? কি ছিল সেহেরী? শুধু খাবার? শুধু সংস্কৃতি? ” আমার চোখে তখন হয়ত ভেসে উঠবে সেহেরীর সময়ে আমার মায়ের কষ্ট। আর সেই লালখান বাজারের দারোয়ানটা। তার সেই ভাঙ্গাচোরা কন্ঠ – “নামায পারলো, সাহরী খালো।

ভাইয়ো - নামায পারলো, সাহরী খালো। ” বড়ই বিরক্তমাখা সেই কন্ঠ। তখন সব শেষে হয়ত আমি বুঝবো – তার এই বিরক্তিটা কেন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।