আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্‌উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ দামোদর নদের পাড়ে একখানি গৃহস্থবাড়ি। গৃহস্বামীর নাম বনমালী । গৃহিণীর নাম আরতি ।

বৈশাখের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে দেখে উঠানে কাপড় তুলতে এল আরতি । হঠাৎ একবার নদীর ধারে চোখ গেল আরতির। নদীর পাড়ে কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। পোশাক-আশাকে শহুরে বাবু বলেই মনে হল। আরতি দৌড়ে স্বামীর কাছে চলে এল।

উঠানের গাছপালায় পাগলা হাওয়ার শনশন শব্দ উঠেছে। ‘হট,’ ‘হট’ শব্দ করে গরু-বাছুর তাড়িয়ে গোয়ালে তুলছিল মধ্যবয়েসি বনমালী। আরতি স্বামীর কাছে এসে বলল, এখুনি একবার লদীর পাড়ে যাও। কেন গা? কি হয়েছে? হাওয়া দামাল হয়ে উঠেছে বলে আরতি চিৎকার করে বলল, লদীর পাড়ে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছ। শহুরে বাবু বলে পেরেততয় (প্রত্যয়) হয়।

ওদিকে ঝড় উঠিছে। যাও, বাবুকে ঘরে ডেইকে নিয়ে এস গে যাও। বনমালী গরু-বাছুর ফেলে নদীর পাড়ে ছুটল। দামোদর নদের তীরে পৌঁছে ঈশ্বরচন্দ্রের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। শূন্য ঘাট।

ঘাটে পারাপারের জন্য একটিও খেয়া নৌকা নেই। বৈশাখ মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে । বৈশাখের আকাশে কালো মেঘের স্তর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে এলোমেলো ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঝড় ওঠার সমূহ সম্ভাবনা।

কলিকাতা থেকে গতকাল রাত্তিরে যাত্রা করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র । রেলপথে বিলম্ব হল। তখন কে জানত যে এমন ঘোর দুর্যোগে পড়তে হবে। নদীর ঘাটে পৌঁছতে-পৌঁছতে দুপুর গড়াল। এখন ঝড় উঠলেই সর্বনাশ।

ঈশ্বরচন্দ্র জানেন বৈশাখি ঝড়ের সময়ে দামোদর নদ অত্যন্ত বিক্ষুব্দ এবং উত্তাল হয়ে ওঠে। যে করেই হোক, আমাকে নদী পেরোতেই হবে। ঈশ্বরচন্দ্র অস্ফুটস্বরে বললেন। বনমালী দৌড়ে এসে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে দাঁড়াল। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে লোকটা।

বলি, ও কর্তা, ঝড় উঠিছে যে। ঝড় না-থামা অব্দি এই গরীব-দুঃখীর বাড়ি পায়ের ধুলো দিন না কেন? নদী পাড়ের আলো-আঁধারিতে মধ্যবয়েসি লোকটিকে দেখলেন ঈশ্বরচন্দ্র । স্থানীয় লোক বলেই মনে হল। অতি সাধারণ কালো রঙের শীর্ণ চেহারা । খালি গা, ধূতি পরে আছে।

ভাঙা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি। ঈশ্বরচন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ। আমাকে যে করেই হোক নদী পেরুতেই হবে। কিন্তু, আপনি কেমন করি এ পাগলা লদী পাড়ি দেবেন কর্ত? বনমালী আর্তনাদ করে উঠল। সে রকম হলে নদী সাঁতরে পাড় হব।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কন্ঠস্বরে দৃঢ় প্রত্যয়। বনমালীর চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে এসে কপালে ঠেকল। বলছেন কি কর্তা! এ যে বড় রাক্ষুসী লদ! তুফান উঠলি এ লদ সাঁতরে পাড় হবেন কি করে গো কর্তা! ঈশ্বরচন্দ্র চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন । তিনি জানেন জোর তুফান এলে নদের ঢেউ জল পাহাড় সমান হয়ে উঠবে। তখন ক্ষরস্রোতা নদে সাঁতার কাটা মানেই যমে মানুষে টানাটানি।

তাঁর মুখেচোখে দুশ্চিন্তার প্রগাঢ় ছাপ পড়ল। ক্ষণিকের জন্য মায়ের মুখখানিও ভেসে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্রের মা অতি সত্ত্বর দেখা করার জন্য পুত্রকে সংবাদ পাঠিয়েছেন। মায়ের মুখখানি স্মরণ হওয়ায় নির্ভয় বোধ করেন ঈশ্বরচন্দ্র । কয়েক পা এগিয়ে নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ালেন।

বনমালীর বুক কেঁপে উঠল। এখানে পাড়টি বেশ উঁচু । জল অনেক নীচে। ঈশ্বরচন্দ্র শ্বাস টানলেন। আরতি উঠান থেকে কাপড় তুলে ঘরে রেখে আবার উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল।

স্বামীর দেরি দেখে বুক কাঁপছে। নারীর মন। দৌড়ে নদীর পাড়ে যেতে থাকে আরতি । তখন অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিল নদীর দু-পাড়ের চরাচর আর দূরের আবছা দিগন্ত । নীলাভ কালো আকাশে ঘন ঘন ঝলসে উঠছিল বিদ্যুতের রূপালি রেখা।

অস্থির হয়ে উঠছিল ঝড়ো হাওয়া। ঘরমুখো ভয়ার্ত গরু তুলছিল ‘হাম্বা’ রব । ঈশ্বরচন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়াল আরতি। তারপর লম্বা ঘোমটা টেনে করুণ স্বরে বলল, মিনতি করি, বাবু। আপনি এ বেলাটি গরীবের ঘরে আশ্রয় নিন।

সর্বনাশা ঝড় উঠল বলে। ঈশ্বরচন্দ্র উদ্বিগ্ন নারীকে এক পলক দেখলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, উপায় নেই মা। আমার মা আমাকে স্মরণ করেছেন। পথে এমনিতেই অহেতুক বিলম্ব হয়েছে।

যে করেই হোক আমায় এ বেলা নদী পেরুতেই হবে। আরতি আর্তনাদ করে উঠল, কিন্তু ... কিন্তু আপনি কি ভাবে এই সর্বনাশা লদ পাড়ি দিবেন বাবু? আরতি এবং বনমালীর বিস্মিত চোখের সামনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শ্যামল দেহখানি শূন্যে উঠে যায়। তারপর সে দেহখানি শূন্যেই দু’বার পাক খায়। কৃষ্ণবর্ণের আকাশের পটভূমিতে সে এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারনা হল বটে। তারপর সে মাতৃভক্ত পুত্রের দেহখানি দ্রুত কালো হয়ে ওঠা দামোদর নদীর উত্তাল জল নির্ভয়ে স্পর্শ করে ... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.