আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শৈশব রঙ মেলুক প্রজাপতির ডানায়

.............................................আজ এখানে বসে যখন বহু পিছনে ফিরে তাকাই, ছোট্ট পুতুলের মত একটা মেয়েকে চোখে পড়ে। কতই বা বয়স! নয়, বড়জোর দশ...প্রাইমারীর গন্ডিটাও পেরোয়নি তখনও। মেয়েটা সকাল হলেই ছুটতে ছুটতে স্কুলে যায়, সারা দুপুর নিজের মনে ছবি আঁকে আর গান গায়, বিকালবেলায় সারা পাড়া দৌড়ে মাতায় বরফ পানি, ছোঁয়াছুঁয়ি, বৌচি খেলায়, সন্ধ্যে হলেই লক্ষ্মী মেয়েটা বই নিয়ে পড়তে বসে যায়। মাত্র দুটো রুমের ছোট একটা বাসা ওদের, বাবা-মা, ভাই আর ওরা দুই বোন। এরইমধ্যে আবার এক আত্মীয়ও থাকছে সাথে, অনেক বড় একজন মানুষ...সম্পর্কটা পিতৃস্থানীয়।

মেয়েটা তার খুবই ভক্ত। সকালে বাবা চলে যান অফিসে, বড় বোন আর শিক্ষিকা মা স্কুলে, ওর স্কুল নয়টা থেকে বলে ওর দায়িত্ব হল সকালে সেই ভদ্রলোকের মশারী খুলে দেয়া আর নাস্তা শেষে চা তৈরি করে দেয়া। কাজগুলো খুব আনন্দ নিয়েই সে করে। তারপরে একদিন........................................... সকালবেলা মশারী খুলে যখন সে নামছিল বিছানা থেকে, লোকটা শুয়ে থেকেই তাকে জড়িয়ে ধরল বুকের মধ্যে। তারপর তার দেহটাকে পিষতে লাগল কেমন যেন।

মেয়েটার ভিতর তক্ষুণি একটা সাইরেন বেজে উঠল, এটা ঠিক স্বাভাবিক আদর নয়...যেমন সে এতদিন পেয়ে এসেছে। বেচারি ভয়ে কাঠ। কিছুক্ষণ পরেই লোকটা তাকে ছেড়ে দিল, ছোট্ট করে গাল টিপে দিয়ে বলল, 'যাও, স্কুলে যাও'। উদভ্রান্তের মত সে বেচারি বের হয়ে এল ঘর ছেড়ে, স্কুল ড্রেস ঠিকমত পড়া হল কি হল না, সবগুলো বই নেয়া হল কি হল না...সে জানেও না। তারপর...তারপর এই ঘটনা চলতে লাগল দিনের পর দিন।

লোকটা তাকে বুকের মধ্যে নিয়ে দলাই মলাই করে, তার ছোট্ট শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গগুলো (স্পর্শকাতরতা কি ওই বয়সে বোঝা যায়!) খুবলে খুবলে দেখে, হাতে এমন কি মুখেও, চোখে তো বটেই। ছোট্ট জলজ্যান্ত পুতুলটা ভয়ে কেমন সিঁটিয়ে যায়, প্রাণহীন হয়ে যায়। ওর চেয়ে বছর চার-পাঁচ বড় একটা মেয়ে কাজ করতো বাসায়। মেয়েটা সব বুঝতো আর ওকে প্রায়ই বলতো, 'আপু, আপনি খালাম্মাকে বলেন না কেন? 'মা'র সাথে খুব একটা স্বাভাবিক না বলে সে কাউকে বলতেও পারে না। মা'কে সে ভীষণ ভয় পায়, আসলে দুইজনের মধ্যে একটা ফারাক কেন যেন তৈরি হয়ে গেছিল শুরু থেকেই, কেউ কাউকে বুঝতে পারতো না।

ও ভাবতো মা'কে বললে মা হয়তো আরো রাগ করবে, আর ওকেই বকবে। সেই ভয়ে চুপ করে সহ্য করতো। কিন্তু একদিন লোকটা ওকে বলল কাল সকালে সে ওর সবটা দেখতে চায়। মেয়েটা কি যে ভয় পেল! অনেক অনেক ভয়ে মা'কে গিয়ে বলল সব। হ্যাঁ, মা ভয় পেয়েছিল খুব।

ভয়ে কাঁপছিল তার দেহ, আর অক্ষম একটা রাগে। বোকা মেয়েটা এতদিন কেন তাকে জানায়নি, তাই নিয়ে খুব বকলেন তাকে। বোকা মেয়েটা কিন্তু সেটা বুঝল না, ভাবল ভুলটা তারই বলে মা বকছেন তাকে। তাকে যতই বলা হল এরপর থেকে এরকম হলে অবশ্যই যেন জানানো হয়, সে ততই আরো গুটিয়ে গেল। ওই লোকটাকে এরপর আর থাকতে দেয়া হয় নি ওই বাসায়।

কিন্তু মেয়েটা আর আগের মত রইল না। বহু বহুদিন সে গোটা পুরুষ প্রজাতিটাকেই ভয় পেতো প্রচন্ড। এমন কি নিজের বাবার সঙ্গেও একা বাসায় থাকতে চাইতো না। ক্লাসের ছেলেদের সঙ্গে কথা বলতে পারতো না, কোন স্যারের সঙ্গেও না। রাস্তায় চলতো কেমন খরগোশের মত ভীরু, সন্ত্রস্ত হয়ে।

এই ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাস্তা-ঘাটে দেখা হতে লাগল এইসব পশুদের সাথে। লুকোচুরি খেলতে খেলতে পাশের বাসায় যখন লুকাল, প্রায় তিরিশ বছর বয়সী একজন তাকে ওমনি করে বুকের মধ্যে জাপটে ধরল। হেঁটে হেঁটে যখন স্কুলে যাচ্ছিল, ভয়ংকর দেখতে এক লোক খাবলে ধরল তার বুক। সে ভয় পেয়ে তাকাতেই লোকটা তার দিকে কি হিংস্র একটা দৃষ্টি ছুঁড়ে দিল। প্রায়ই রাস্তার ভিড়ে বা বাসে কোন মাঝবয়সী লোক তার শরীরে দিতো তার নোংরা হাত।

এমনি আরো কত কত ঘটনা। মেয়েটা তখন আর স্বাভাবিকভাবে কিছু ভাবতে পারতো না। ছেলেদের সে সবসময় ছেলেই ভাবতো, যারা তোমার শরীর দিয়ে নিজের ক্ষুধা মেটাতে চাইবে, যারা কখনোই তোমাকে মানুষ ভাববে না... কারণ তারা নিজেরাও তা নয়। ওইটুকু বয়সেই সে ভাবতো ছেলেদের চোখে নিজেকে শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলার কথা। সে ভাবতো ছেলে আর মেয়ের মধ্যে একটাই সম্পর্ক হতে পারে, সেটা শরীরের।

ছেলেরা শুধুই ছেলে, মানুষ নয়, বন্ধু নয়...হতেই পারে না। নিজেকে স্বাভাবিক একজন মানুষের পর্যায়ে নিয়ে যেতে মেয়েটার লেগেছিল দীর্ঘ দশটি বছর। যখন সে মানুষদের দুটো প্রজাতিতে ভাগ করে নি আর; যখন সে সবাইকেই বন্ধু ভাবতে শিখল; যখন সে নিজেকে শুধুই একটি শরীর নয়, একজন অনুভূতিশীল মানুষ হিসেবে চিনতে শিখল; যখন সে জানল শুধু একই রকম নয়, সম্পর্কের কত প্রকার যে থাকতে পারে! যদিও তারপর তাকে আর থামতে হয় নি, কিন্তু এর মাঝে চলে গেছে খুব মূল্যবান দশটি বছর। মেয়েটির হেসে-খেলে দৌঁড়-ঝাপ করে বেড়ানোর সময়, নির্মল বন্ধুত্ব পাওয়ার সময়, চিন্তার স্বাভাবিক বিকাশের সুযোগ; মেয়েটির অমূল্য শৈশব। শিশুকালটাকে নিংড়ে নেয়ার আগেই তাকে হয়ে যেতে হল অনেক অনেক বড়।

কি দোষ ছিল তার? বয়সের তুলনায় একটু বাড়ন্ত দেহ? টুকটুকে ফর্সা, পুতুলের মত দেখতে হওয়াটা? বড্ড বোকা, নিরীহ, গোবেচারা হওয়া? নাকি শুধুই মেয়ে হয়ে জন্মানোটা? কোনটা? পিছন ফিরে তাকালে আজকাল মেয়েটার জন্য ভীষণ মায়া হয় আমার। আরো কয়টা দিন নিশ্চিন্তে গোল্লাছুট আর পুতুল পুতুল খেলার সুযোগ সে পেলে কি এমন ক্ষতি হতো কার!............................................. ..............................................................................এইরকম ঘটনা আমাদের জন্য নতুন নয়। শুধু মেয়ে শিশুই নয়, এমন কি ছেলে শিশুদেরও মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং হচ্ছে প্রায়ই। এইরকম সহ্য করতে করতে শিশুটি একসময় ভাবে এটাই স্বাভাবিক, এমনটাই ঘটবে। সে মেনে নেয় এবং স্বীকার হয় একটি বিকৃতির।

যা সময়ের ব্যবধানে তাকে দিয়েও ঠিক একই কাজ করিয়ে নেয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশুটি বলতে পারে না কাউকে কিছু, কিংবা বললেও তাকে উলটে বকাই শুনতে হয়। অথচ আমরা যদি একটু সচেতন হই, আমাদের শিশুটিকে হয়তো পারি এইরকম অনাকাঙ্খিত ঘটনা এবং মানসিক বিকৃতি থেকে রক্ষা করতে। সবার প্রথমেই শিশুর সাথে বাবা-মা দুইজনই হতে পারেন বন্ধুসুলভ, যাতে শিশু নির্দ্বিধায়, নির্ভয়ে তার যেকোন সমস্যার কথা বলতে পারে। খুব ছোট বয়স থেকেই তাকে শেখাতে হবে তার শরীরের সেইসব স্পর্শকাতর অঙ্গগুলোর কথা, যেখানে অন্য কারো স্পর্শ বা প্রবেশানুমতি নেই।

তাকে শেখাতে হবে চুপ করে সহ্য না করে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ করা, নিদেনপক্ষে সেটা বাবা-মা অথবা বড় কাউকে জানানো। এবং অবশ্যই তার ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। যত বিশ্বস্তই মনে হোক না কেন, শিশুকে যে কারো তত্ত্বাবধানে ছেড়ে দেয়া যাবে না। এরপরে ব্যক্তিগত সচেতনতার ব্যাপারতো আছেই। শিশুকে ছোটবেলা থেকে শেখাতে হবে অন্যদের শ্রদ্ধা করতে।

ছেলে বা মেয়ে নয়, সবাই মানুষ এই বোধটি তৈরি করতে হবে তার মধ্যে। পরিবারের প্রতিটি বড় সদস্যকে কাজ করতে হবে শিশুর জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে। প্রায়ই দেখা যায় তরুণদের তুলনায় মাঝবয়সী, বিশেষ করে চল্লিশের কাছাকাছি লোকেদের মধ্যে এই বিকৃতিটা বেশি। বাসের ভিড়ে কি রাস্তায় তারা এই কাজটা করেন। কেন? এর ব্যাখ্যা হিসেবে আমার যেটা মনে হয়েছে তা হল, কিশোর বা তরুণদের তুলনায় এই লোকগুলো অভিজ্ঞ থাকে।

তারা জানে মেয়েদের দুর্বলতা, তারা জানে মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিবাদ করে না। এবং এই বয়সে একটা পর্যায়ে এসে তারা নিজেদের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলতে থাকে। অনেকটা এই পথেই হয়তো তারা সেটা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই লোকগুলো হয় খুব চোর চোর আর ভীতু ধরনের। একটু কড়া চোখে তাকালে বা ধমক দিলেই এরা কুকড়ে যায়।

তাই এদের ভয় না পেয়ে প্রতিবাদ করাই শ্রেয়। আমাদের তরুণেরা প্রায়ই বিপথে যায় নানারকম বিকৃত বিনোদনের কারণে এবং সঙ্গদোষে। তাদের জন্য প্রয়োজন যথাযথ কাউন্সেলিং, ভুল এবং সঠিকের জ্ঞান। এ তো হরহামেশাই হয়, এটাই স্বাভাবিক...এটাই মেনে না নিয়ে প্রথম পদক্ষেপটি আমরাই ফেলি না কেন। নিশ্চিত করি একটি উচ্ছল নিরাপদ শৈশব আমাদের শিশুদের জন্য।

........................................................................................... বহুদিন ধরে ভাবছিলাম কথাগুলো। লিখে ফেললাম আজ। বড্ড এলোমেলো হয়েছে, আরো অনেক কথাই হয়তো বলার ছিল। তারপরও, এতটুকুতো বলা হল। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।