আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দাপট যখন ক্ষমতাবানদের অন্ধ করে তোলে

দাপট যখন ক্ষমতাবানদের অন্ধ করে তোলে ফকির ইলিয়াস ======================================= মাত্র একদিন আগেও তিনি ছিলেন আইএমএফের প্রধান। একদিন পরই তিনি জেলহাজতের বাসিন্দা। ডোমেনিক স্ত্রস কান। বিশ্বের অসীম ক্ষমতাধর ব্যক্তি থেকে একেবারে ধরাশায়ী। ফ্রান্সের বাসিন্দা এ ক্ষমতাবান ব্যক্তি আইএমএফের কাজে নিউইয়র্ক এসেছিলেন।

অবস্থান করছিলেন নিউইয়র্কের একটি বিলাসবহুল হোটেল সুটে। প্রতি রাতের ভাড়া তিন হাজার ডলার। সেই হোটেল সুটেই তিনি একজন 'হাউসকিপার' মহিলার ওপর অযাচিত ঝাঁপিয়ে পড়েন। ওই মহিলা সঙ্গে সঙ্গেই হোটেল সিকিউরিটি ডাকেন। এরপর তড়িঘড়ি করে হোটেল ত্যাগ করেন আইএমএফের প্রধান।

এয়ার ফ্রান্সের একটি এয়ারবাসে উঠে বসেন ফ্রান্সে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ততক্ষণে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা ঘেরাও করেছেন জেএফকে বিমানবন্দরের সেই টার্মিনাল। বিমানটি ছাড়ার ঠিক মুহূর্তে ডোমিনিক কানকে নামিয়ে আনা হয় উড়োজাহাজ থেকে, তারপর হাজির করা হয় বিশেষ আদালতে। বিচারক তার জামিন নামঞ্জুর করে পাঠিয়েছেন নিউইয়র্কের 'জঘন্য অপরাধীদের' বাসস্থান বলে কথিত রাইজার্স আইল্যান্ড জেলে। আইএমএফ প্রধান যে মহিলার ওপর চড়াও হয়েছিলেন তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের গায়ানা দেশটি থেকে ইমিগ্র্যান্ট হয়ে আসা ৩২ বছরের একজন বিধবা।

থাকেন নিউইয়র্কের ব্রংকস কাউন্টিতে। তার পনেরো বছরের একটি মেয়েও রয়েছে। ওই হোটেলে কাজ করে মহিলা তার জীবিকা নির্বাহ করেন। সেই কর্মজীবী নিম্নবিত্ত মহিলাই আইএমএফ প্রধানের যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। বিষয়টি ভাবতেই আমাদের গা শিউরে ওঠে।

এ কেমন আজব জগতে বাস করতে হচ্ছে আমাদের। প্রিয় পাঠক, আইএমএফ প্রধান এ মহিলার সঙ্গে যে আচরণ করেছেন বলে নিউইয়র্ক তথা আমেরিকার পত্রপত্রিকায় যেসব রিপোর্ট ছাপা হয়েছে তার বাংলা তরজমা আমি করতে চাই না। চাই না এজন্য, কারণ ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্ষমতাবানরা যে সারমেয় সমআচরণ করতে পারেন তাতে সাধারণ মানুষের তীব্র ঘৃণা প্রকাশ ছাড়া আর কী-ইবা করার আছে? এখানে একটি বিষয় খোলাসা হওয়া দরকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফের প্রধান মনে করেছিলেন এমন হীনকর্ম করে তিনি পার পেয়ে যাবেন। ফ্রান্সের বাসিন্দা ডোমিনিক কান নিউইয়র্ককে তার হোমটাউন প্যারিস বলেই ধরে নিয়েছিলেন।

বিশ্বের অন্যতম অর্থ সংস্থা 'ইন্টারন্যাশনাল মনিটরি ফান্ড' (আইএমএফ)-এর শীর্ষ ব্যক্তিকে কে স্পর্শ করবে। এমন একটা মানসিকতা ছিল তার। ডেইলি নিউজ লিখেছে প্যারিসে এমনটি করলে তার কিছুই হতো না! তাই সঙ্গত কারণে আমরা প্রশ্ন রাখতে পারি বিশ্বের কোন কোন খ্যাতিমান সভ্য দেশও কি এমন হীনকর্মের হোতাদেরকে প্রশ্রয় দেয়। হ্যাঁ দেয়। আর দেয় বলেই ডোমিনিক কান নিউইয়র্কে এসে এমন অবৈধ যৌনাচারে লিপ্ত হতে চেয়েছিলেন, যা গোটা মানবসভ্যতার জন্যই কলঙ্কজনক।

আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি, ডোমিনিক কানকে আইএমএফের প্রধানের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। এটাও তার একটি চরম শাস্তি বলা যায়। নিউইয়র্কের আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছেন নগদ ১ মিলিয়ন ডলার বন্ডের মাধ্যমে। তার জামিনের জন্য প্যারিস থেকে উড়ে এসেছেন তার স্ত্রী বিখ্যাত সাংবাদিক অ্যান সিনক্লেয়ার। মামলার শুনানিতে নিউইয়র্কের ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি সরকারের পক্ষে বলেছেন, মামলার বিবাদী মি. ডোমিনিক কান অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি।

তাই তিনি মামলায় প্রভাব খাটাতে পারেন, এমন ধারণা অমূলক নয়। মাননীয় বিচারক মামলা আমলে নিয়ে বলেছেন, ডোমিনিক কান নিউইয়র্কেই আপাতত গৃহবন্দী থাকবেন। তার শরীরে 'ইলেকট্রনিক মনিটরিং ডিভাইস' লাগানো থাকবে। নিজ খরচে তিনি একজন সশস্ত্র প্রহরীও রাখতে হবে। কারণ মানসিক বিশেষজ্ঞ গোয়েন্দাদের মতে, এমন প্রভাবশালী আসামির আত্মহত্যার প্রবণতা, কিংবা চেষ্টার ঘটনা বিশ্ব ইতিহাসে রয়েছে।

অবশ্য মামলা বিষয়ে ডোমিনিক কান বলেছেন, আমি নির্দোষ। সত্যের পক্ষে আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার সর্বশক্তি দিয়ে লড়ে যাব। ২০১২ সালের ফ্রান্সে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে যার প্রেসিডেন্ট পদে দাপটের সঙ্গে লড়ার কথা ছিল, সেই ডোমিনিক কান এখন অন্তরীণ নিউইয়র্কের ৫ মিলিয়ন ডলার বন্ড, পাসপোর্ট জমাদানসহ নানা রকমের সামাজিক অপদস্ততা মেনে নিতে হচ্ছে তাকে। তার ডিএনএ হয়ে গেছে। হোটেল সুটের যে রুমে তিনি ওই মহিলার ওপর চড়াও হয়েছিলেন সেই রুমের কার্পেটের টুকরো কেটে নিয়ে তাতে তার ডিএনএ মেলানো হয়েছে এবং সেটা মিলেও গেছে।

সবকিছুই ঘটে গেছে মাত্র ক'দিনের ব্যবধানে। এদিকে ক্রিস্টিন ডেভিস নামক নিউইয়র্কের একজন নামকরা 'গণিকা এজেন্ট' বলেছেন ডোমেনিক কান ছিলেন তাদের একজন 'অ্যাগ্রেসিভ ক্লায়েন্ট'। তিনি আরও জানান, কান বিভিন্ন কলগার্লের জন্য ঘণ্টায় ১২শ' ডলার পরিশোধ করতেন। ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি দু'ঘণ্টার জন্য ২৪০০ ডলার পরিশোধ করেছিলেন। অন্যদিকে নিউইয়র্কে হোটেলগুলোতে কর্মরত হাউসকিপারদের জন্য 'পেইন অ্যালার্ট' বিল তুলেছেন স্টেট অ্যাসেম্বলিম্যান মি. বরি ল্যাঞ্চম্যান।

ল্যাঞ্চম্যান তার বিলে বলেছেন, হাউসকিপাররা যদি হোটেলরুমে কাজের সময় তাদের শরীরে পেইন অ্যালার্ট ব্যবহার করেন তবে তারা হোটেল রুমে ক্লায়েন্টদের যৌন উৎপীড়ন কিংবা দৌরাত্ম্য থেকে মুক্তি পেতে পারেন। নিরাপত্তা কর্মীরা হোটেল লবি থেকে সঙ্গে সঙ্গেই সাহায্য করতে পারবেন। এই যে ধারাবাহিক ঘটনাগুলো, তা আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে বিশ্বের বিশেষ ক্ষমতাবান কিছু মানুষ এখনো তাদের মনের পশুত্বকে বধ করতে পারেনি। এখনো এরা তীব্র হীনম্মন্যতা, বর্বরতা, দীনতার পৃষ্ঠপোষক। মানবসভ্যতার বিকাশে ব্যক্তিচরিত্রের পরিশুদ্ধতা অত্যন্ত অপরিহার্য বিষয়।

ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে যারা হীনকর্মে লিপ্ত হতে পারে, তাদের হাতে মানবতার কল্যাণ আশা করা যায় না। রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি কোন মহৎ পরিকল্পনার নেতৃত্বই আসতে পারে না অসৎ কোন ব্যক্তির হাত থেকে। আইএমএফের সাবেক বসের এমন কাহিনী থেকে ক্ষমতাবানরা শিক্ষা না নিলে মানবসভ্যতার অগ্রযাত্রাই বারবার ব্যাহত হবে। নিউইয়র্ক, ২৫ মে ২০১১ ------------------------------------------------------------------------------- দৈনিক সংবাদ / ঢাকা / ২৭ মে ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.