আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একজন সাধারণের দৃষ্টিতে পুঁজিবাদ

আমার ব্লগে স্বাগতম (এই লেখাটি ডিসেম্বর ২০১০-এ লেখা। যখন পোস্ট দিছিলাম, তখন আমি 'সামু'-তে অবজার্ভেশনে ছিলাম তাই প্রথম পৃষ্ঠায় আসেনি। এখন আমি সেইফ। যারা মিস্‌ করেছেন তাদের জন্য রিপোস্ট দিলাম) পুঁজিবাদী ব্যবস্থা কিংবা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা - এই দুই ব্যবস্থা নিয়ে অনেক রকম কথাই শুনি, পড়ি। আমি ব্যাপারগুলো খুব একটা বুঝি না কারণ ওটা আমার বিষয় নয়।

স্কুল পর্যায়ের পড়াশোনা কিংবা পরে পত্র-পত্রিকা পড়ে আমার জ্ঞান। কথা হল তাহলে এ বিষয় নিয়ে লেখা কেন? দেশের নেতা-নেত্রী নির্বাচনে এ ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে আমার ভাবনা সাধারণ একজন মানুষের মতই। তবে কিছু কিছু বিষয় জলের মতই পরিষ্কার - যা সাধারণ একজন মানুষের দৃষ্টি এড়ায় না, আর ঠিক এ বিষয়গুলোর উপরই আমি আলোকপাত করতে চাই। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যে আজ বিলুপ্তপ্রায়- এটা আমাকে আর নূতন করে বলতে হবে না, এটা যেকোন সচেতন ব্যক্তি-মাত্রই জানেন। তাহলে আমাদের আলোচনা থেকে সমাজতন্ত্র প্রথমেই বাদ পড়ে গেল।

পুঁজিবাদ ব্যবস্থা বইতে পড়ে নয়, আমি এখানে আমেরিকায় যেমন দেখি বা ভিনদেশী বন্ধু-বান্ধবের সাথে আলোচনা করে যেটুকু জানি সেটাই বলব। যেমন বন্ধু কেনেথ বলল, সরকারের কাজ হল সবার জন্য ফাঁকা একটা মাঠ তৈরি করা যেখানে অবকাঠামোগত সবধরনের সুবিধা থাকবে যাতে যে কেউ ইচ্ছা করলে নিজ যোগ্যতায় নিজের লক্ষ্যে পৌছুতে পারে। এখানে উত্তরাধিকার সূত্রে কারো সম্পদ থাকার দরকার নাই, বা থাকলেও কোন সমস্যা নাই। কারো মস্তিষ্কে যদি নূতন আইডিয়া থাকে, উদ্যোক্তা গুন থাকে তাহলে অবকাঠামো যাতে তার আইডিয়া বাস্তবায়নে অন্তরায় না হয়ে দাঁড়ায়। যেমন ধরুন ব্যবসায় স্থাপনে নিয়মনীতি বিষয়ক জটিলতা।

ট্রেড লাইসেন্স, বিভিন্ন অনুমতি (permit), ট্যাক্স সংক্রান্ত ব্যাপার, ইউটিলিটি (বিদ্যুৎ, পানি, টেলিফোন) ইত্যাদি ব্যাপারগুলো যাতে খুব সহজেই সম্পন্ন করা যায় সরকার সে ব্যবস্থা করে রাখবে। কিন্ত আমাদের দেশে কী হচ্ছে ? বেশ কিছুদিন আগে, জনাব জাকারিয়া স্বপনের রচনায় “একটু” নাটকটি দেখলেই বোঝা যায়, আমাদের দেশে সরকার আসলে কী করছে ? সেখানে নায়ক বিদেশের চমৎকার জীবন ব্যবস্থা জলাঞ্জলি দিয়ে দেশের টান দেশে ফিরে গেল একটা “আইএসপি” প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য এবং নিজের পয়সায়। ব্যবসায় শুরু করার আগে প্রয়োজনীয় কাজগুলি করার জন্য যে পরিমাণ জটিলতা বা ঘুষের বা অনিয়মের সম্মুখীন তাকে হতে হয়েছে, তাতে যেকেউ খুব সহজেই নিরুৎসাহিত হয়ে আবার বিদেশে ফেরত যাবে। পুঁজিবাদী অর্থনীতি আমাদের দেশে শুধুমাত্র নামে মাত্র আছে। আবার ধরুন, কারো মাথায় চমৎকার আইডিয়া আছে কিন্ত সেটা শুরু করার জন্য পর্যাপ্ত মূলধন নাই।

ব্যাংকগুলো এমন হবে যাতে আইডিয়া চমৎকার হলে খুব সহজেই ঋণ দেয়। ব্যাংকগুলোর ঋণ দেবার শর্ত হবে, প্রজেক্ট খতিয়ে দেখা, বা ঋণগ্রহীতার ঋণ বিষয়ক রেকর্ড পরীক্ষা করে দেখা - ঋণ গ্রহীতা আগে কখনো ঋণ নিয়েছে কিনা, নিয়ে থাকলে ঠিক সময়ে ঋণ পরিশোধ করেছে কিনা, এসব ঠিক থাকলে কোন রকম জামানত অর্থ বা সম্পদ ছাড়াই ঋণ দিবে কারণ চমৎকার একটি প্রজেক্ট এবং ঋণগ্রহীতার সততাই এখানে জামানত হবার জন্য যথেষ্ঠ। বাড়তি জামানতের প্রয়োজন নাই। আমাদের দেশে সরকার এমন একটি ফাঁকা মাঠ কি তৈরি করে দিচ্ছে? আমাদের দেশে জামানত ছাড়া ঋণ পাওয়া যায় না। আর কিছু লোক তো ঘুষ প্রদানের মাধ্যমে জামানতের কয়েকগুণ বেশী ঋণ নিয়ে ইচ্ছে করে প্রজেক্ট ফেইল করছে।

সরকারের কাজ হল এসব পর্যবেক্ষণে রাখা যাতে সবার জন্য চমৎকার একটি মাঠ থাকে। আমাদের সংসদে দলীয় নেতা ও অন্যান্য সাংসদগন এসব নিয়ে আলোচনা/বাদানুবাদ করেন না। কার বাসায় কেমন সম্পদ পাওয়া গেল - এটা তাদের আলোচ্য বিষয় এবং এসব আলোচনা করতে গিয়ে নিজেদের অতীত রেকর্ডও বের হয়ে আসে। এখানে একটি বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়, বিশ্বের সর্বোচ্চ ধনী লোকের তালিকায় যতজন আমেরিকান আছেন তাদের অধিকাংশই (আমার জানামতে সবাই) নিজ যোগ্যতায় ধনী, উত্তরাধিকার সূত্রে নয় ! বন্ধু রিচার্ড আবার আয়ের পুনর্বন্টনের (income resdistribution) ব্যাপারটি আলোচনায় নিয়ে এল। ব্যক্তিগত আয়কর ফাইল বলে একটি ব্যাপার আছে যা আমেরিকাতে বছর শেষে সবাইকে করতে হয়।

ব্যাপারটি খুবই সহজ। সরকার প্রত্যেকের আয়ের উপর ভিত্তি করে একটি নির্দিষ্ট হারে বেতন থেকে কর কেটে নয়। ব্যাপারটিকে বলা হয় উৎসস্থলে কর-কর্তন। তারপর বছর শেষে আয়কর ফাইল করতে হয় যা এতটাই সহজ যে সাধারণ মানের ট্যাক্স-ফাইল কোন পেশাধারীর কাছে না গিয়ে নিজেই করা যায়। এক্ষেত্রে হিসেব করে দেখা হয়, আপনার আয়ের উপর ভিত্তি করে আপনার জন্য সারাবছরে যে পরিমাণ কর ধার্য করা হয়েছে তা আপনি দিয়েছেন কিনা।

যদি না দিয়ে থাকেন, কিংবা যদি কম দিয়ে থাকেন তাহলে যে পরিমাণ কম দিয়েছেন তা আয়কর বিভাগকে দিতে হবে। আর যদি বেশী দিয়ে থাকেন তাহলে যে পরিমাণ বেশী দিয়েছেন তা আয়কর বিভাগ ফেরত দিবে। খুবই সুন্দর ব্যবস্থা। আবার আয়কর বিভাগে আছে অডিট বিভাগ যারা আপনার ফাইলকৃত কর পরীক্ষা করে দেখবে আপনি কোনরকম ভুল করেছেন বা ফাঁকি দিয়েছেন কিনা। আবার কেউ যদি ট্যাক্স ফাইল করার পর আয়কর বিভাগের পাওনা না দেন, তাহলে আয়কর বিভাগ এতটাই শক্তিশালী যে, তারা আপনার ব্যাংক থেকে তাদের পাওনা কেটে নিতে পারবে।

যাই হোক আয়ের পুনর্বন্টনের ব্যাপারে ফিরে আসি। এখানে আয়কর হার এমনভাবে নির্ধারণ করা হয় যে, যার আয় যত বেশী, তাকে করও তত বেশী দিতে হবে- এটা সাধারণ একটা হিসাব, এখানে অন্যান্য ব্যাপারও বিবেচনা করা হয় যেমন আপনার পারিবারিক অবস্থা , আপনার অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ, ইত্যাদি। ধরা যাক, কোন একজনের বাৎসরিক আয় ৩৫,০০০ ডলার, কিন্ত তার দুটি সন্তান আছে। তার জন্য কর হার হবে খুব কম কারণ পরিবারে ব্যক্তির সংখ্যার তুলনায় তার আয় কম। তাছাড়া যেহেতু তার আয় কম কিন্ত দুটি সন্তান আছে , তাকে সরকার কিছু অর্থ ট্যাক্স ক্রেডিট হিসেবেও ট্যাক্স ফাইল করার পর দিবে।

আবার যার বাৎসরিক আয় ২৫০,০০০ ডলার তার কাছ থেকে অনেক বেশী পরিমাণে কর কাটা হবে কারণ পারিবারে ব্যক্তির (আগের মতই দুটি সন্তান) সংখ্যার তুলনায় তার আয় অনেক বেশী। বাস্তবিক যেটা হচ্ছে সেটা হল, যার আয় বেশী তার কাছ থেকে অর্থ নিয়ে যার আয় কম তাকে দেওয়া হচ্ছে। আয়ের চমৎকার পুনর্বন্টন ব্যবস্থা। এখানে একটা ব্যাপার মনে রাখা দরকার, যার আয় বেশী তার কাছ থেকে বেশী কর নেওয়া হয় ঠিকই কিন্ত কখনোই আবার এত বেশী কর নেওয়া হয় না যাতে করে তার যোগ্যতার উপর অবিচার করা হয় কারণ সে তার যোগ্যতাবলেই বেশী আয় করছে। সরকার যেমন আয়ের পুনর্বন্টনের ব্যবস্থা রেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে ব্যক্তির যোগ্যতার মূল্যায়নের কথাও ভুলে যান না।

আমি খুবই সংক্ষেপে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করলাম, এখানে আরো অনেক ব্যাপার আছে। আমাদের দেশেও আয়কর ফাইলের ব্যাপারটি আছে। কিন্ত ব্যাপারটার বাস্তবায়ন মোটেই নেই। বেশীর ভাগ লোক আয়কর ব্যাপারটা বোঝেই না। একজন শিক্ষাহীন দিনমজুরের এটা বোঝার প্রশ্নই আসে না, বাকী লোকের বেশীর ভাগই আয়কর ফাইল করেন না বা করলেও চমৎকারভাবে কর ফাঁকি দিয়ে যান।

আমাদের দেশে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আছে কিন্ত বাস্তবায়ন নাই। আমাদের বুদ্ধিজীবিগন প্রায়ই পুঁজিবাদের মুন্ডুপাত করেন। তারা করতেই পারেন কারণ এ বিষয়ে তাদের জ্ঞান আমার চেয়ে অনেক বেশী। এটা নিঃসন্দেহে সত্যি যে, পুঁজিবাদ অত্যন্ত জটিল একটি ব্যাপার এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বা অর্থনীতিবিদগন এটা ভালো বোঝেন কিন্ত আমি আমাদের দেশে সাধারণভাবে দৃশ্যমান এ ব্যাপারগুলিরও বাস্তবায়ন কখনোই দেখি নাই। আমার সন্দেহ, আমাদের দেশের যারা নিয়ন্ত্রক তারা নিজেরা তাদের আয়কর ফাইল করেন তো? সঞ্চয় রহমান, ভার্জিনিয়া,যুক্তরাষ্ট্র।

 ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.