আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিলেটের খাসিয়া পান

নাজমুল ইসলাম মকবুল
সিলেটের খাসিয়া পান নাজমুল ইসলাম মকবুল যদি সুন্দর একটা মুখ পাইতাম মহেশখালীর পানের খিলি তারে বানাই খাবাইতাম। কিংবা পালের নাও পালের নাও পান খেয়ে যাও, ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও। পান নিয়ে এমন বিখ্যাত অনেক গান কবিতা ছড়া ও পই প্রবাদ আছে যা আমাদের সাহিত্য ভান্ডারকে করেছে সমৃদ্ধ। পান খাইতে স্বাদ লাগেনা স্বাদ লাগে তার চুনে, সুন্দরেতে মন ভরেনা মন ভরে তার গুনে। এই ছন্দটি মহিলারা হাত রুমাল পাখাসহ নানান নকশাদার জিনিসে হাতের নিপুণ কারুকার্যের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেন যতœসহকারে।

আমার এক প্রবাসী বড়ো ভাইয়ের বিয়ে হয়েছিল বছর বিশেক পুর্বে। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা সেরে নতুন কনেকে পালকীতে চড়িয়ে ধুমধামের সাথে বরের বাড়ীতে নিয়ে এসে সবাই কনে দেখে আক্কেল গুঢ়–ম অবস্থা। সবাই বলাবলি করতে শুরু করলেন কনে কালো। বরের মনও ভীষন খারাপ। বিয়ে বাড়ীতে কালো কালো শ্লোগান নিয়ে যখন মহাহুলস্থুল কান্ড সে মুহুর্তে কনের সাথে আনা একটি উয়ালফ্রেম বের করা হলো, যাতে বড় হরফে সুই সুতার কারুকার্যময় লেখা ছিল, পান খাইতে স্বাদ লাগেনা স্বাদ লাগে তার চুনে, নারীর রূপে মন ভরেনা মন ভরে তার গুনে।

আমরা তখন টাট্টা করে নতুন ভাবীর সামনে এই শ্লোকটি উচ্চস্বরে আবৃতি করে পরম আনন্দ উপভোগ করছিলাম। তবে তাঁর অসাধারন গুনের তারিফ এখনো সকলকে করতে শুনি। সত্যিই চুন ছাড়া নাকি পানের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়না। সিলেটের ঘরে ঘরে সেই পান খাওয়ার পুরণো ঐতিহ্য ফুরিয়ে যায়নি। আমি তখন ছোট ছিলাম।

আমার নানা আমাদের বাড়ীতে বেড়াতে এলেন। আমরা বুড়ো নানার চারপাশ ঘিরে বসে আনন্দ পেতাম। আমার আম্মাও নানার পার্শ্বে গিয়ে বসলেন। নানাজি তাঁর পানের বাটা মাকে বের করে দিয়ে বললেন খাও। মা অল্প পান সুপারি নিয়ে খেতে উদ্যত হলে নানা চুনের কৌঠা বের করে দিয়ে বললেন এই নাও চুন।

মা বললেন বাবাজি আমি চুন খাইনা। নানা হেসে বললেন, চুন না খেলে পানের কি স্বাদ বুঝবা মা। দুই হাজার সালের দিকে আমি তখনও বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করতাম। সে সুবাধে মাসিক আল-ফারুক পত্রিকায়ও লেখতাম। পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মাওলানা আশরাফ আলী বিশ্বনাথী যিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন, আমাকে আদর করে কাছে বসিয়ে বললেন তুমি আমার পত্রিকার প্রতিটি সংখ্যায় একটি করে লেখা দিয়ো।

এই বলে আপ্যায়নের জন্য নিজের পানের বাটা বের করে দিয়ে বললেন পান খাও। আমি একটু পান ও একটু সুপারী নিয়ে খেতে উদ্যত হলে চুনের কৌটাটি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন এই নাও চুন। হাসিমুখে বললাম হুজুর চুন খাইনা। একথা শুনে হুজুর মুচকী হাসলেন। বুঝা গেল তখন হুজুরও মনে মনে বলছেন চুন না খেলে পানের মজা বুঝবা কেমনে।

সিলেটের গ্রামাঞ্চলসহ অধিকাংশ ঘরে গেলে এখনও অতিথি আপ্যায়নে পানের জুড়ি নেই। এমনকি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী সিলেটিদের কাছে এখনও পানের কদর কমেনি। শুধু নিজে নয় অতিথিদেরও পান দিয়ে তারা আপ্যায়িত করেন। যুক্তরাজ্যে অবস্থানরতো সিংহভাগ প্রবাসীরাই সিলেটি। এখনও পানের বাটা বা পান্দান তাদের ড্রয়িংরুমের শুভা বর্ধন করে আছে।

জাতিয় দৈনিক আমার দেশ এর সিনিয়র সহকারী সম্পাদক শ্রদ্ধেয় সঞ্জীব চৌধুরী সেদিন কথা প্রসঙ্গে বললেন যুক্তরাজ্য সফরে গিয়ে যে সকল সিলেটিদের ঘরেই বেড়াতে গেছেন তারা চা নাস্তা দেবার পূর্বেই পানের বাটা বা পান্দান নিয়ে হাজির। চা নাস্তা বা খাবার দাবার শেষেও পান দিয়ে আপ্যায়িত করা যেন বাধ্যতামুলক। সিলেটাঞ্চলে বিয়ের প্রাক প্রস্তুতি হিসেবে দিন তারিখ ঠিক করতে কনের বাড়িতে বর কনে উভয় পরে যে আনুষ্ঠানিক বৈঠক ও ভুড়িভোজন হয় সেই অনুষ্ঠানের নাম হচ্ছে পান চিনির অনুষ্ঠান। কনে বাড়িতে মিস্টি মিঠাইয়ের সাথে রঙিন কাগজে মোড়ানো পান্দান মনোরম সাজে সাজিয়ে সাথে নিতে হয় বাধ্যতামুলকভাবে। এই পান চিনির অনুষ্ঠান এতই গুরুত্বপুর্ণ যে, এতে নিকটাত্মীয় সকলকে দাওয়াত দিতে ভুল করলে তারা গোস্বা করে বিয়ের মুল আসরে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকতেও শুনা যায়।

এছাড়া বিয়ের দিন গ্রাম পঞ্চাইতের ঘরে ঘরে লোক পাঠিয়ে আনুষ্ঠানিক দাওয়াত দেয়া হয় পান তামাক খাইতা নউশা (বর) হাজাইতা (সাজাইতা)। আক্বদ অর্থাৎ ইজাব কবুলের সময়ও ঝকঝকে সুন্দর করে সাজানো একটি পান্দান উকিল শ্বশুড় নিজ হাতে বর কনের সামনে রাখার পরেই ইজাব কবুল আদায় করার রেওয়াজ এখনও সিলেটাঞ্চলে কঠোরভাবে পালন করা হয়। সেই সাজানো পান্দান না হলে আক্বদের মুল অনুষ্ঠানই শুরু হয়না। বিয়ের দিনও বরের সাথে সাজানো পান্দান নিয়ে বিয়ের আসরে যেতে হয়। এছাড়া উভয়পরে মেহমান ও সকল বরযাত্রীর ভুড়িভোজনের পর পরই সকলের খাবারের উপযোগী পর্যাপ্ত পরিমাণ পান সুপারি অবশ্যই সাথে নিয়ে যেতে হয়।

বাসর ঘরে বর কনেকে ও ভাবীদেরকে মিস্টিপানের খিলি পরিবেশনের রেওয়াজ আজও সিলেটাঞ্চলে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। প্রেমিকা তার প্রেমিককে পানের খিলি উপহার দিয়ে প্রেম নিবেদনের একটা সুযোগ খুজতেও শুনা যায়। বিয়ের আড়াইদিন পরে নতুন বর যখন কনে নিয়ে শ্বশুড় বাড়িতে আড়াইদিন অবস্থানের উদ্দেশ্যে যান তখন প্রথমে শরবত ও বাহারী পদের নাস্তা ও চা পরিবেশনের পর শালা শালী পান্দান নিয়ে হাজির হয় নতুন দুলাভাইয়ের সামনে। শুরু হয়ে যায় দুলাভাইকে হেনস্থা করার জন্য পানের পই ভাঙ্গানোর খেল। পান খাও পন্ডিত ভাই কথা মাতো টারে, এই পান জন্ম লইছে কোন পরিস্থানে, এই পানের বয়ান যদি না কইতায় পারো, ছাগল হইয়া চাবাইবায় শেওরার পাতা।

উত্তর দিতে ব্যর্থ হলে বর ও সাথীদেরকে ছাগল উপমা দেয়া হয়। তখন নতুন দুলাভাই ও তাদের সাথীরা চতুর হলে ও উত্তর জানা থাকলে উত্তরে বলেন, আওরে ভাই পাড়ো যাই, পাড়ো গিয়া লেম্বু খাই, লেম্বু খাইয়া ফালাইলাম বিছি, উঠলো গাছ, ফুল নাই কল্লি নাই ধরে বারোমাস। এছাড়া সিলেটাঞ্চলে গ্রাম্য সালিশী বিচারের আসর যেকোন বৈঠক এবং নির্বাচনী ক্যাম্পেইনও যেন পান ছাড়া জমেইনা। বাজারের লিস্টিতে প্রথমেই মাছ এবং দ্বিতীয় স্থানেই থাকে পান। বাজার থেকে পান আনতে ভুলে গেলে পানের নেশায় বিভোর কোন কোন মহিলা গৃহকর্তার সাথে ঝগড়াঝাটি শুরু করতেও কার্পণ্য করেননা।

এছাড়া নিজের ঘরে পান ফুরিয়ে গেলে অতিথি আপ্যায়ন ও নিজের পানের নেশা নিবারনের জন্য পাশের ঘর বা বাড়ী থেকে ধার কর্জ করেও পান এনে সাময়িক প্রয়োজন নিবারনের রেওয়াজ সিলেটে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। পানের সাথে সুপারি চুন সাদা (তামাক) খয়ের মিষ্টি জর্দা হাকিমপুরী জর্দা বত্রিশ মতি দারুচিনি গুয়ামুরি ভাজা বাখর পানপরাগ বাহারি জাতের খুশবুদার মসল্লা ব্যবহার করা হয়। এসবের সংমিশ্রণে পান খেলে মুখে এক ধরনের ঘ্রান অনুভুত হয় এবং ঠোট জিহবা ও মুখগহ্বর খুবই লাল রঙ ধারন করে। পান হচ্ছে এক ধরনের লতানো গাছের পাতা। তবে সিলেটের খাসিয়া পানের জুড়ি নেই অন্য কোথাও।

খাসিয়া পানের মধ্যে এক ধরনের কড়া ঝাজ আছে যা অন্য পানে নেই। তাই এই পানের চাহিদা ও বাজারমুল্য সব সময়ই বেশি। বিশেষ করে সিলেটিরা ও সিলেটের প্রবাসীরা খাসিয়া পান ছাড়া পান খেতে শান্তি পাননা। খাসিয়া পানের চাষ হয় সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার জাফলংয়ের অদুরে খাসিয়া পুঞ্জীতে। সেখানের পাহাড়ে বসবাসরতো খাসিয়া উপজাতিয়রা মাচার উপর বিশেষ পদ্ধতিতে গৃহ নির্মাণ করে বসবাস করে এবং তাদের জীবিকার একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে পান।

সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখলাম অগণিত সারি সারি সুপারি গাছ। সেই সুপারিগাছের গোড়ায় পানের গাছ রোপন করে সুপারি গাছের উপর দিয়ে তার লতা গুল্ম বেয়ে উপরে উঠেছে। আর তাতেই ধরেছে সবুজ মনোরম অগণিত পানপাতা। খাসিয়ারা বিশেষ ধরনের লম্বা মইয়ের সাহায্যে পানগুলো সংগ্রহ করে বারোটি পান দিয়ে এক গুছা বানায়। বারো গুছা একসাথে জড়ো করে বানায় এক কান্তাই।

এক কান্তাই পান বর্তমান বাজারমুল্যে প্রায় দুইশত টাকা। তবে বর্ষা মৌসুমে নতুন পানের কুড়ি ছাড়লে পানের দাম কিছুটা কমে। ডাক্তাররা পান খেতে নিষেধ করলেও পানের অপকারিতার পাশাপাশি যথেষ্ট উপকারিতাও রয়েছে। আহারের পর পান খেলে হজমের দুর্বলতা ও মুখের দুর্গন্ধ দুর হয়। এছাড়া দাতেরও ব্যয়াম হয়।

যারা পান খেয়ে অভ্যস্থ তাদের একটা নেশা হয়ে যায়। খাসিয়াদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে সিলেটের উৎকৃষ্টমানের খাসিয়া পান চাহিদার তুলনায় ফলন দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। এর অন্যতম কারন হলো শুষ্ক মৌসুমে প্রলম্বিত খরা ও অনাবৃষ্টি। তাছাড়া সেচ প্রদানের অপ্রতুলতাও অন্যতম কারন। এরপরও সিলেটের খাসিয়া পান যুক্তরাজ্যসহ প্রবাসী অধ্যুষিত বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে।

সরকারের পৃষ্টপোষকতা পেলে সিলেটের খাসিয়া পান সারা দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানী করে আরও অধিক পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।