আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিলেটের অহংকার

৭০০ বছর আগে আরবভূমি ইয়েমেন থেকে সিলেট আসেন হজরত শাহজালাল (রহ.)। ওই সময় সিলেটের রাজা গৌড় গোবিন্দ সুরমা নদী থেকে তার নৌকা ফিরিয়ে দেন, যাতে তিনি সিলেটে না থাকতে পারেন। সব বাধা জয় করে সিলেটের মাটিতেই পা রাখেন তিনি। সেই থেকে সিলেট মানেই শাহজালাল (রহ.)-এর পুণ্যভূমি। তার জন্ম ইয়েমেনে।

বাবা মাহমুদ বিন মোহাম্মদ এক ধর্মযুদ্ধে শহীদ হন। শাহজালালের বয়স তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা যান তার মা। এরপর মামা সৈয়দ আহমদ কবির সোহরাওয়ার্দী তাকে পালন করেন। একদা তিনি একমুঠো মাটি শাহজালালের হাতে দিয়ে বলেন, ‘তুমি ভারতবর্ষে যাও। ’ তিনি চলে আসেন ভারতবর্ষে, অতঃপর সিলেটে স্থায়ী হন।

১৩০৩ সালে ৩২ বছর বয়সে তিনি যখন সিলেটে পা রাখেন তখন এ অঞ্চল ছিল জঙ্গলে ঢাকা। তিনি সিলেটের রাজা গৌড় গোবিন্দের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরেন। তার বীরত্ব আর দৃঢ় চরিত্রের সামনে টিকতে পারেনি রাজা গৌড় গোবিন্দ। নিজের আদর্শ ও শিষ্য ছাড়া আর কোনো উত্তরাধিকার রেখে যাননি তিনি। কিন্তু ৭০০ বছর পরও আজ সারা দেশেই তার নাম মানুষের হূদয়ে।

সিলেটের প্রতিটি মানুষই যেন তার উত্তরসূরি। এখনো সিলেটের আকাশে পরম ভরসায় ওড়ে জালালি কবুতর।

হজরত শাহজালাল যখন সিলেটের পথে দিল্লিতে, তখন সাধক পুরুষ নিজাম উদ্দিন আউলিয়া (রহ.) বন্ধুত্বের নিদর্শনস্বরূপ এক জোড়া পায়রা উপহার দিয়েছিলেন। ধূসর রংয়ের এ পায়রার পরবর্তী ধারাকে তাই আলাদা চোখে দেখেন সিলেটের মানুষ। আলাদা চোখে দেখেন মাজার চত্বরের উত্তর দিকের পুকুরে থাকা গজার মাছগুলোকেও।

শাহজালালের (রহ.) স্মৃতি জড়িয়ে থাকায় এসব মাছকে পবিত্র জ্ঞান করেন দর্শনার্থীরা। ভক্তি নিয়ে তারা ভিড় জমান মাজারে সংরক্ষিত তার স্মৃতিচিহ্ন দেখতে। তার ব্যবহূত তলোয়ার, খড়ম, প্লেট এবং বাটি দূর থেকে দেখেও যেন চোখ জুড়ায় ভক্তদের। তার মাজারের দক্ষিণ দিকে মুফতি বাড়িতে শাহজালালের ব্যবহূত তলোয়ার ও খড়ম সংরক্ষিত আছে। প্লেট আর বাটি রাখা আছে দরগাহর মোতাওয়াল্লির বাড়িতে।

এ ছাড়া মাজারের পূর্ব দিকে একতলা ঘরের ভেতর বড় তিনটি ডেকচি রয়েছে, যা মাজারের জন্য হোসনী দালানের নির্মাতা ঢাকার মীর মুরাদ দান করেন। কথিত আছে, প্রতিটি ডেকচিতে সাতটি গরুর মাংস ও সাত মণ চাল একসঙ্গে রান্না করা যেত। যদিও ডেকচিগুলোতে এখন আর রান্না হয় না। মাজারের পশ্চিম দিকে দেয়ালে ঢাকা ঝরনা নামে পরিচিত ছোট্ট একটি কূপ রয়েছে। কথিত আছে, মক্কার পবিত্র জমজমের কূপের সঙ্গে এ কূপের সম্পর্ক রয়েছে।

ভক্তি নিয়ে তাই দর্শনার্থীরা এ কূপের পানি সংগ্রহ করেন। এ ছাড়া জনশ্রুতি রয়েছে, ওই কূপে এক সময় সোনার কৈ ও মাগুর মাছ দেখা যেত। এখনো মাজারে এসে ভক্তরা ওই কূপে সোনার কই ও মাগুর মাছ খোঁজেন। মাজারের দক্ষিণ দিকে গ্রিলে ঘেরা চিল্লাখানা নামের ছোট্ট কামরাটির জন্যও ভক্তদের আগ্রহের কমতি নেই। কথিত আছে এখানেই হজরত শাহজালাল (রহ.) জীবনের ৪৩ বছর মহান সৃষ্টিকর্তার আরাধনায় কাটিয়েছেন।

হজরত শাহজালাল (রহ.) যে ছোট্ট টিলায় বাস করতেন, মৃত্যুর পর (১৩৪৬ খ্রিস্টাব্দ) সেখানেই তাকে দাফন করা হয়। ওই সময়কার নিরিবিলি সেই টিলাটি এখন সিলেটের মধ্যমণি। তার মৃত্যু দিবস উপলক্ষে প্রতিবছর আরবি মাসের ১৯ জিলকদ ভক্ত-আশেকানরা পালন করেন ওরস মোবারক। পরকালের শান্তির আশায় মৃত্যুর পর এই মহান ব্যক্তির মাজারের পাশে শায়িত হওয়ার বাসনা থাকে অনেকেরই। মাজার সংলগ্ন গোরস্তানে শায়িত রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী, সাবেক স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী, পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য সিরাজুন্নেসা চৌধুরী, দরগা মসজিদের ইমাম হাফেজ মাওলানা আকবর আলীসহ অনেক বরেণ্য ব্যক্তি।

এ ছাড়া হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর কবরস্থানের পাশেই রয়েছে তার সফরসঙ্গী (৩৬০ আউলিয়ার অন্তর্ভুক্ত) হজরত শাহজাদা আলী (রহ.), হজরত হাজী ইউসূফ (রহ.), হজরত হাজী খলিল (রহ.), হজরত হাজী দরিয়া (রহ.)।

তার মাজারে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারও ভক্ত-আশেকানের আনাগোনা ঘটে। শুধু মুসলমানই নয়, বিভিন্ন ধর্মের নারী-পুরুষ মানত নিয়ে আসেন এই মাজারে। হজরত শাহজালাল (রহ.) ছিলেন মহান মানবতাবাদী এক দার্শনিক ব্যক্তি। তার একান্ত উদ্যোগে সিলেট অঞ্চলে ইসলামের বিস্তার ঘটে।

ধারণা করা হয়, তিনি আন্তঃধর্মের বাইরে অন্য ধর্মের মানুষদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু ও সহানুভূতিশীল ছিলেন। কেননা, আজও তার মাজারে সব ধর্মেরও সম্প্রদায়ের মানুষ সমবেত হন। তাকে পরম শ্রদ্ধা জানান। যুগশ্রেষ্ঠ এই ব্যক্তি ভ্রাতৃত্ব বন্ধনের পথিকৃত্ হিসেবে বেঁচে থাকবেন চিরকাল।



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।