আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিলেটের মরমী সাহিত্য

সুরমা নদীর তীর থেকে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন লোকঐতিহ্যের অনবদ্য ফসল মরমী সঙ্গীত বা মরমীবাদের গান। মারেফতি বা ফকিরালী গানের পোশাকী নাম মরমী সাহিত্য । প্রাচীন লোকসাহিত্য বা লোকঐতিহ্যের একাংশের রুপান্তর মরমী সাহিত্য। উল্লেখ্য যে, মরমী সঙ্গীত ও বাউল গানকে অধুনা যুগে যদিও এক করে ভাব হয়, কিন্তু এর ইতিহাস সন্ধানি সৈয়দ মোস্তফা কামাল ও অন্যান্যদের কাছে এর ভাবধারায় ভিন্নতা রয়েছে বলে অভিমত পাওয়া যায়। কারণ হিসেবে বলা হয়, মরমী সঙ্গীত হচ্ছে সূফীবাদের বহিরপ্রকাশ।

যা মুলত তাওহিদ (স্রষ্টার একত্ববাদ) রিসালতের (পয়গাম্বরের কাহিনী) উপর ভিত্তি করে রচিত এবং বাউল মতবাদ হচ্ছে স্রষ্টাই জীব জীবই স্রষ্টা ইত্যাদি বিষয়ের উপর প্রতিষ্টিত। তাই একে ভারতীয় বেদান্তের অদ্বৈত্যবাদ দ্বারা প্রভাম্বিত বলে ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী ধারণা করেন। অন্যদিকে বাংলাদেশে সূফীবাদের আগনম কাল তুর্কি বিজয়ের বহু পূর্বে ছিল বলে হিজরি তৃতীয় শতাব্দির বিখ্যাত আরব পর্যটক সোলায়মান ছয়রাফীর ভ্রমন কাহিনী থেকে জানা যায়। এ দিক দিয়ে ডঃ আশরাফ সিদ্দিকী থেকে পাওয়া যায়, মূল আরবীয় সূফীবাদ-ই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে ছিল। খ্রিস্টিয় দশম শতাব্দির পর আরবীয় সূফীবাদ যখন গ্রীক দর্শনে প্রভাম্বিত হয় তখন থেকে এটিতে স্রষ্টার একত্ববাদের সাথে জীববাদ ইত্যাদির অনুপ্রবেশ ঘটে এবং তুর্কি বিজয়ের মধ্যদিয়ে ভারতে প্রবেশ করে রাজশক্তির হাতে লালিত পালিত হয়ে বৈদান্তিক সাহিত্যের শব্দমালা মিশ্রিত হয়।

যার ফলে বৌদ্ধদের কাছে প্রসংশিত হয় এবং বৌদ্ধরা ব্রাহ্মণবাদ থেকে মুক্তির পথ পেয়ে ইলামের আর্দশ গ্রহন করে। বাংলাদেশে সূফীদের আগমনের পথ ছিল চট্টগ্রামের বিখ্যাত বন্দর । এর মধ্য দিয়ে সুফীরা বাংলায় আসেন এবং চট্টগ্রাম সহ সিলেটে আস্তানা গড়ে বসবাস করেন। হিজরী সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে সিলেট বিজয়ের মধ্যদিয়ে সর্বোপরি সুফীরা এখানে এসে বসবাস করেন। যার ফলে এ অঞ্চল সুফীবাদের রাজধানীতে পরিণত হয় ।

পরবর্তিতে এখান থেকে সূফী মতবাদ বিস্পরিত হয় সারা বাংলেদেশে । সে কারণে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে সিলেটাঞ্চলের মরমী গীতিকার প্রকারভেদ ভিন্ন বলে অনুমিত। তাই এগুলোকে এ অঞ্চলে সিলেটের মরমী সাহিত্য বলে আখ্যায়িত করা হয়। ইতিহাস অনুসন্ধানে পাওয়া যায়, মধ্যযুগের শুরু থেকে সিলেট অঞ্চলে জন্ম হয়েছে প্রখ্যাত, অজ্ঞাত অনেক মরমী সাধকদের। যারা হূদয় বীণার তারের সুরে ছন্দে রচনা করেছেন ঈশ্বর প্রেম সহ সৃষ্টির উপর অসংখ গীত।

মানুষের জীবন-জীবিকা, আচার-আচরণ ও সুখ-দুঃখ নিয়ে রচিত এক কালের লোকসাহিত্য ঈশ্বর প্রেম, সৃষ্টি তত্ব জীবে জীবে প্রেম ইত্যাদির মুল্যবুদে সৃষ্টি হয়েছে মরমী সাহিত্যের। এ পৃথিবী নশ্বর বা অনিত্য, এখানের বাসিন্দাদের মিলে মিশে একে অন্যের সাথে জীবনজ্ঞাপন করা নামটিই হচ্ছে প্রেম। প্রেমকে জাগ্রত করে মানুষের হূদয়ে স্থায়ীত্ব করাটাই হচ্ছে মরমী মতবাদের মূল লক্ষ। এ বিষয়ে মধ্য যুগের কবি আলাওল তাঁর পদ্মাবতী কাব্যে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেনঃ প্রেম বিনে ভাব নাই ভাব বিনে রস ত্রিভূবনে যাহা দেখি প্রেম হুনতে (হতে) বশ যার হূদে জন্মিলেক প্রেমের অংকুর মুক্তি পাইল সে প্রেমের ঠাকুর। সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে হূদয়ের গভীর এশক, মোহব্বত বা প্রেমের আধ্যাত্মিক বাণী ও সুর লহরীই মরমী সঙ্গীত।

ইসলামের দৃষ্টিতে মরমীবাদকে সুফী সাধনা বলা হয়েছে। মাওলানা রুমীর মতেঃ এটি কোন পৃথক মতবাদ নয়। বরং ধর্মীয় চিন্তার একটি প্রকৃতগত পদ্ধতি বিশেষ। যা সৃষ্টি কর্তার কাছে মানবের আত্মসমর্তনেরই একটি ধারা বুঝায়। মরমী কবি তার অন্তরদৃষ্টি দিয়ে দেখা দুনিয়ার পার্থিব অপার্থিব বিষয় গুলোকে ছন্দে সুরে ব্যক্ত করে যে বাণী মানুষের কাছে পৌছায়, এটিই মরমী সাহিত্য।

ডঃ মুমিনুল হক বঙ্গে সুফীবাদ গ্রন্থে বলেছেন; আরবদেশ সূফীবাদের জন্ম দিলেও পারস্য এর লালন পালন করেছে । সূফীবাদ আরবদেশ ছেড়ে যতই পুর্ব দিকে অগ্রসর হয়েছে ততই পূর্বদেশীয় ভাবধারার সম্মিলন ঘটতে থাকে। অধ্যাপক আসদ্দর আলীর মতেঃ শ্যামল বাংলায় এর বিকাশ কাল ছিল সপ্তম হিজরীর প্রমথ পাদে। সূফী আউলিয়াগণ দ্বারা এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে ধর্ম প্রচারের মাধ্যমে। শাহজালাল(রঃ) সহ ৩৬০ ষাট আউলিয়ার ভূমী সাবেক সিলেট জেলা বর্তমান সিলেট বিভাগই এর বিকাশ স্থল।

এজন্য সিলেটকে বলা হয় বাংলার আধ্যাত্মিক রাজধানী। যুগ যুগান্তর ধরে সূফী, ফকির, পীর ও আউলিয়ার ক্রমধারায় সিলেটে জন্ম হয়েছে বেশুমার ভাবুক, কবি ও সাধকদের । যারা সুর মুর্ছনার মধ্য দিয়ে মানুষকে দেখিয়েছে পরমাত্মাকে পাওয়ার পথ। সিলেট একটি প্রাচীন জনপদ । আর্যদের বহু পূর্বে এ অঞ্চলে অস্ট্রেলীয়, দ্রাবিড় মঙ্গোলীয়সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী বসবাস করত।

গারো, খাসিয়া, নাগা, কুকি প্রভৃতি আধিবাসীদের প্রাচীন কাব্য, ভাষা, ধর্মীয় রীতি-নীতি, আচার-উপচারে প্রফুল্লীত সাহিত্যে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতকে মিশ্রণ ঘটে আর্য সংস্কৃতির। অতপর সাত শত হিজরী থেকে মুসলমানদের আগমনের মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে মুসলিম সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে শাহজালাল সহ ৩৬০ ষাট আউলিয়ার আগমনে সুফীবাদের প্রচলন শুরু হয়। এখানে আগত সুফী সাধকরা ইসালামিক আদর্শ ছড়িয়ে দিতে এখানকার আদিবাসীদের বিভিন্ন ভাষায় শিক্ষা দেন ইসলামিক পদ্ধতি বা রীতি রেওয়াজ। যার মধ্যে অন্যতম আরবী ফার্সী ও উর্দু ।

উল্লেখ্যিত ভাষা গুলোর সমন্নয়ে মরমী সাহিত্য নামে জন্ম নেয় এক নতুন সাহিত্যের । যাকে আজ কাল বলা হয় সিলেটের মরমী সাহিত্য। আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় রচিত কাব্য, পুথি, গান ও পালা ইত্যাদি নিয়ে মরমী সাহিত্যের যাত্রা শুরু হয় বলে চৌধুরী গোলাম আকবর সহ গবেষকগণ বলে থাকেন। সিলেটের প্রাচীন সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে মদনুল ফওয়ায়েদ নামের ইসলামী গ্রন্থ । লিখেছেন তরফ বিজেতা নাসির উদ্দীনের প্র-পৌত্র দিল্লীর সুলতানী দরবার হতে মালেক-উল- উলামা উপাধি প্রাপ্ত শাহ সৈয়দ ইসরাইল, গ্রন্থের ভাষা ফার্সী।

শ্রীহট্টের পৈলের সৈয়দ বংশের শাহ সৈয়দ রেহান উদ্দীন ফার্সী ভাষায় কবিতা লিখে দিল্লী হতে 'বুলবুলে বাংলা' উপাধিতে খ্যাত হন। তিনি উর্দু ভাষায় 'মসনবীয়ে বাকাউলী' 'খাবনামা' গ্রন্থদ্বয় রচনা করেন আরবী ফার্সী প্রচার ও প্রসারের জন্য এ অঞ্চলে প্রবাদ ছিলঃ ফার্সী জানে না যে কুমার তারে মুহ করমু না ভাতার'। সিলেটে ফার্সী ভাষার প্রভাব ছিল বেশী। এ বিষয়টি মধ্যযুগীয় কবি সুলতান রচিত নবী বংশ গ্রন্থে এভাবে উল্লেখ্য করেন আরবী ফার্সী ভাষে কিতাব বহুত আলেমানে বুঝে, না বুঝে সুত সিলেটে ঔপনিবেশীক ভাষার আগমন ঘটলে হিন্দু সংস্কৃত ভাষায় এর প্রভাব পরে । ফলে ধীরে ধীরে সংস্কৃত ভাষা তার পরিচিতি হাড়াতে থাকে।

যার ঈঙ্গিত পাওয়া যায় চৈতন্য মঙ্গল কাব্যে, কবি জয়ানন্দের লিখা থেকেঃ তিনি লিখেনঃ ব্রাহ্মণ রাখিবে দাড়ি পারস্য পড়িবে মোজা পায়ে নড়ি হাতে কামান ধরিবে মসনবী আবৃত্তি করিবে দ্বিজবর জকাচুরি ঘাটি ঘটিবেক নিরন্তর। এছাড়া উর্দু, আরবী ও ফার্সী ভাষায় 'উর্দূ ব্যাকরণ' 'রেয়াজুল নুর' 'গোল দস্তে আকাঈদ' নামের বিভিন্ন গ্রন্থ সহ পীর আউলিয়াদের জীবনি ইত্যাদি লিখিত বহু গ্রন্থ সিলেটের প্রাচীন সাহিত্যের স্বাক্ষর হয়ে আজও সংরক্ষিত হচ্ছে। ১৪০০ সালে থেকে এ অঞ্চলে সিলেটি নাগরী নামে এক লিপির উদ্ভব ঘটে এবং এ লিপির ভাষায় লিখিত হয় বিপুল সংখক ইসলামি গ্রন্থ (কিতাব) সহ অনেক পই-পুঁথি, গজল-কবিতা, ডাক-ডিঠান, ধাঁধাঁ-ছিলক, জারী-সারী ইত্যাদি। যা বাংলা লোকসাহিত্যের আওতাভুক্ত । ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের গুড়াথেকে পীর আউলিয়ার আনিত সংস্কৃত ইসলামীক মতবাদ যখন সিলেট অঞ্চল প্লাভিত করে ছিল, তখন থেকে সাধক ফকিরদের চেষ্টা-প্রচেষ্টার ফলে মানুষকে শিক্ষার মাধ্যমে গড়ে তুলতে রচিত হয় পুঁথি পুস্তক, রাগ ও মরমী সঙ্গীত ।

যার প্রধান বিষয়বস্তু নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, ইসলামী ইতিহাস, ঐতিহ্য, কাহিনী ইত্যাদি। যার থেকে ধীরে ধীরে পীর আউলিয়ার নির্জন সাধনাগারে আধ্যাত্মিক ওয়াজ নসিয়তসহ হূদয় হতে উচ্চারণ হয় ছন্দের। পরে এটিই মুর্শিদি বা ফকিরালী গান বা মরমী সঙ্গীত নামে খ্যাত হয়। যার মুল কথা মোস্তফা কামালের ভাষায় এভাবে এসেছেঃ খোদা প্রেমিক মানুষ প্রেম পিপাসায় দগ্ধ হয়ে সুর মুর্ছনায় মাধ্যমে যে ভাবের কথা ব্যক্ত করে, গবেষকদের ভাষায় এটিই গান। মরমী সঙ্গীতের গবেষক আসদ্দর আলী বলেন; আধ্যাত্মিক সুর মুর্ছনার কাফেলায় সিলেটের অবস্থান প্রথম কাতারে।

কারণ হচ্ছে হাজার হাজার আউলিয়ার সংস্রব পেয়ে এ অঞ্চলের মানুষ যুগ যুগ ধরে ভাব দেশের বাসিন্দায় পরিণত । তাই যুগে যুগে এখানে জন্ম হয়েছে অসংখ পীর, ফকির, সাধক ও মরমী কবিদের। মরমী সঙ্গীত ভাবের কথা, ভাব ছাড়া এর মর্মবাণী উদ্ধার করা সম্ভব নয়। চন্ডিদাশ তার এক কবিতায় বলেনঃ মরম না জানে ধরম বাখানে এমন আছ-এ যারা কাজ নাই সখী তাদের কথায় বাহিরে রহুন তারা সিলেটে মরমী সঙ্গীতে প্রেম বিরহ ছাড়া সৃষ্টি তত্ব, ভাব তত্ব, ধর্ম দর্শন, মানব কল্যাণ সহ বিভিন্ন ভাব ধারার রচিত বলে গবেষকদের লিখায় পাওয়া যায়। দৃষ্টান্ত স্বরুপ মরমী গবেষক মধ্যযুগের কবি তাজ উদ্দীন মোহাম্মদের একটি কবিতা, যা সৃষ্টি তত্বের উপর কবি লিখেছেন আপনার কুদরত আগে করিতে জাহের নিজ নুরে আমার নুর পয়দা কৈলেন ফের আমার নুরেতে পয়দা তামাম জাহান আরশ, কুরশী, লওহ কলম ও লা-মাকান কবি তাজ উদ্দীনের কবিতার সারাংশ পাওয়া যায়, মধ্যযুগের কবি আলাওলের এ কবিতা থেকেঃ পূর্বেতে আছিলা প্রভূ নৈরূপ আকার ইচ্ছিলেক নিজ সখা করিতে প্রচার নিজ সখা মোহাম্মদ প্রথমে সৃজিলা সেই জ্যোতি নুরে ত্রিভূবন নির্মীলা মধ্যযুগের সিলেটের কয়েক জন মরমী কবির কবিতা ও গানের আংশিক সেতারে সে তার, বাঁজে তার, তারে তারে ধর তারে, পাবে তারে দুমের ঘরে তারের বাজনা শিখলে নারে, নামাজ পড়ো কার ।

(কবি গোলাম মোস্তফা হোসাইনি) দয়াল রসুল হবিব বিনে কে আছে আমার সকলি ছাড়িয়া দয়াল ধইরাছি চরণ তোমার। (সৈয়দ আব্দুর রহিম হোসাইনি চিশতি) কহে সুলতান, জীবন স্বপন, মরণ জানিয় সার সে পন্থ ছাড়িয়া, আসারে মজিয়া, ভুলি রইল অনির্বার । (মধ্যযুগের কবি সৈয়দ সুলতান) মরমী কবিরা তাসাউফপন্থী। মরমীবাদ ও সূফীতত্ত্ব সাধারণত মুর্শিদ প্রদর্শিত তরিকার নামে পরিচিত। এশক্, মহববত বা আল্লাহ প্রেমই মরমী সঙ্গীতের বিষয়বস্তু ।

পৃথিবীর সৃষ্টি রহস্যের ভেদবিধি নিয়েই মরমী কবিরা সঙ্গীত রচনা করেন। সিলেটের প্রায় সব মরমী কবিগণ চিশতীয়া তরিকার অনুসারী। হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তী (র.) (১১৪২-১২৩৬) দ্বাদশ শতাব্দিতে ভারত উপমহাদেশে আজমির শরীফে এ তরিকা প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম সূফী সাধকদের ইসলামের বাণী নিয়ে এ দেশে আগমনকাল থেকেই ‘মরমী বা ছামা সঙ্গীতের' প্রচলন হয়। তাই সুলতানী আমলে মরমীবাদের উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে বলে ধারণা করা হয়।

এর বিকাশের শুরু থেকেই মরমী ভাবধারা জনমনে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে এবং এই ভাবধারাই অকৃত্রিম সহজাত ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে উঠে। সৈয়দ মোস্তফা কামালের মতে পরবর্তিতে (আনুমানিক ১৬৫০খ্রিঃ) চৈতন্যবাদ ও জগন্মোহনী ভাবধারার সংমিশ্রণে বাউল মতবাদের জন্ম হওয়ায় বৈঞ্চব পদাবলীতে মরমীবাদ সাহিত্যের প্রভাব পড়ে। বৈঞ্চব পদাবলীর পুর্বরাগ, অনুরাগ, বংশী, বিরহ, সম্মিলন ইত্যাদি শব্দ নামে উপনামে সূফীবাদ থেকে সরাসরি গ্রহন করা হয়। এভাবে সূফীবাদকে বৈঞ্চব্বাদে সংযুক্ত করে একটা ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে বলে সৈয়দ মোস্তফা কামাল সহ গবেষকবৃন্দের ধারণা । সৈয়দ মোস্তফা কামাল লিখেন; জগমোহন গোসাঈ বাউল সম্প্রদায়ের প্রবর্তক।

তাকে আদি বৈষ্ণব ধর্মের প্রবর্তক হিসেবেও গণ্য করা হয়। হবিগঞ্জ সদর উপজেলার মাছুলিয়া গ্রামে তার আখড়া বিদ্যমান। জগন্মোহিনী সম্প্রদায়ের জপতপের মূলমন্ত্র ‘গুরু সত্য'। জগমোহন গোসাইর এক প্রশিষ্যের নাম রামকৃষ্ণ গোসাঈ। বানিয়াচং উপজেলার বিথঙ্গলে তার প্রধান আখড়া রয়েছে।

এ আখড়ার অধীনে প্রায় চারশ' ছোট বড় শাখা আখড়াও আছে। হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সুনামগঞ্জে এ সম্প্রদায়ের অনেক বাউল-বৈষ্ণব-বৈষ্ণবী ছিল ও আছে। রামকৃষ্ণ গোসাঈর বারো জন শিষ্যের নামে বারোটি শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ঢাকার ফরিদাবাদেও এ সম্প্রদায়ের একটি বড় আখড়া আছে। এরা কোন ধরনের জাতপাতের ধার ধারে না।

পরবর্তীকালে এদের প্রভাব এক শ্রেণীর মুসলমান বাউলদের মাঝে আছর করে। বর্তমানে বাউলদের জড় অত্যন্ত গভীরে। সূফী সাধক ও মরমী কবি সৈয়দ জহুরুল হুসেন (র.) (১৮৭৬-১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ মধুপুর-বাহুবল-হবিগঞ্জ) এদের বে-শরা কাজ কারবারের বর্ণনা করেছেন এভাবে : কি হৈল আখেরী কালে ঝুটা পীরে শিক্ষা দিল গান-বাজনা জিকিরের তালে নামাজ রোজার নাই লেশ, গান বাজনা জিকিরে বেশ অঙ্গে ঘটায় আজব বেশ, লুণ্ঠন করে হাতের তালে নামাজ রোজা নাই করিল, দলিল মতে কাফির হৈল ঈমান আমান সব হারিল ঝুটা পীরের ঠেকে জালে দল বেঁধে গান করা মানা, তালিতাল বাজায় কানা শাস্ত্রেতে নিষেধ দেখে না, মত্ত হৈল লোভের মেলে বালক পীর কাম বেপারী, ছুটে আসে কত নারী একে অন্যে মাশুকদারী, গোল ঘটায় সব এক মফিলে পীর বলে নাই আপন পর, আসা-যাওয়া কর বিস্তর অপর নারী মাশুক ধর, মত্ত হয় সব বালক দলে ‘নাউজ্জুবিল্লাহ' এই তরিকায়, শয়তান তথায় শীঘ্র যায় দলে দলে নরকে যায়, বড় পীর লিখেন দলিলে জহুর বলে ব্যক্ত কথা, মনে কেহ না পাও ব্যথা খাজা মঈনুদ্দীনের বার্তা ‘মক্তুবাতে' এসব মিলে। সূফী সাধনায় মারিফাত অন্যতম। তবে ইলমে তাসাউফের মর্মমূল হচ্ছে শরীয়ত।

মধ্যযুগের মরমী কবিরা ছিলেন ভাবুক সচেতন। তাদের রচনায় রয়েছে ভাব, বিরহ ও আল্লাহর সাথে মিলনের আশা । মরমী কবি শাহনুর প্রেম বিরহে বন্ধু পাওয়ার আশায় লিখেনঃ বন্ধু তর লাইগা-রে আমার তনু জর জর মনে লয় ছাড়িয়া যাইতাম, থইয়া বাড়ি ঘর অরণ্য জঙ্গলার মাঝে আমার ভাঙ্গা ঘর ভাইও নাই বান্ধবও নাই কে লইবে খবর অতপর অধুনা যুগে এসে মরমী কবি দেওয়ান হাসন রাজায় লিখেন বিকাইলেনি ঐ বন্ধে কিনে গো সজনী সই, বিকাইলেনী ঐ বন্ধে কিনে ছাইড়া থাকতে পারবনা গো কি হইল মোর মনে - গো সজনী সই তার লাগিয়া প্রাণে আমার দৈর্য নাহি মানে কি জানি কি কৈলগো মোরে মন-মোহনে তার সম কেহ নাই এই ত্রিভূবনে তার মত নাহি দেখি ধিয়ানে গিয়ানে মরমী সঙ্গীতকে ভাবুকদের মনের অনুরাগের ফসল বলা হয়। মরমী কবি তার হূদয়ের বাসনা আপন সৃষ্টির মাঝে ফুঁটিয়ে তুলেন কিন্তু সেখানে প্রতিবিম্ব হয় দেশ, কাল, প্রাত্রের মনের কথায়। সিলেট মরমী সাহিত্যের অব্যাহত ধারায় আরেক মহাত্ম কবি 'আরকুম শাহ' কে পাওয়া যায় সিলেট গীতি সাহিত্যেঃ আরকুম শাহ'র জনপ্রিয় একটি গানঃ সোনার পিঞ্জিরা আমার কইরা গেলায় খালিরে হায়-রে আমার যতনের পাখি সুয়ারে, একবার পিঞ্জিরায় আও দেখি আজ্ঞা মতে এই দেহাতে কইলা পরবাস এখন কেন যাও ছাড়িয়া করিয়া নৈরাশ -রে পৃথিবীতে মানুষের আগমন কাল থেকে শুরু করে হাজার হাজার বত্সর পর্যন্ত মানুষের মনে বোনা সুর যুগ যুগান্তর পুর্বের মানুষের সাহিত্য ছিল ।

যা আজ নৃত্বান্তিক ভাবে লোকবিজ্ঞানীরা স্বীকার করেন এবং সে সাহিত্য ক্রমধারাই মুলত জন্ম দিতে সফল আজকের লিখিত সাহিত্যের। অবহমান পৃথিবীতে মানুষের আসা যাওয়ার গতি থেমে নেই। তাই বলা হয়, আদিম প্রভাতের অরন্যচারী সরল মানুষের চিন্তা ভাবনাকে কেন্দ্র করেই হয়েছে কাব্যের জন্ম। যে কাব্যে মানুষ ব্যাখ্যা দিয়েছে নিজের অবার্চীন চিন্তা-চেতনার দর্শন। মানুষের এ চিন্ত-চেতনায় সর্বজীবে পৃথীবির অতিলৌকিক এক শক্তির অস্তিত্ব দেখেছে ।

যাকে মানুষ প্রেম বলে ধারণায় স্থিতি করে প্রাকাশ করেছে ভাব। যুগে যুগে এ ভাব বা প্রেমই বিভিন্ন ধর্ম বিশ্বাষের রুপান্তর বলে জেমস জেয়েস তার বিখ্যাত গ্রন্থ মনোমিথ (Mono Myth)এ বলেছেন । আদিম সভ্যতা সংস্কৃতি যেন একেক মানুষের চিন্তার একেকটি স্বপ্ন। যা জন্ম দিয়েছে একেকটি বুদ্ধদের। বিভিন্ন প্রাকৃতিক পরিবেশ ও ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা ভিন্ন চিন্তা-চেতনা, ধর্ম-বিশ্বাষ ও সংস্কৃতির উত্স।

এ ভিন্নতার সংমিশ্রণ-মিলন এবং বিরহকেই বলা হয় লোকসাহিত্য। যা এক যুগে জন্ম আর অন্য যুগে হয়েছে সংস্কার। উদাহরণ স্বরুপ ভারতীয় সংস্কৃতিকে নেয়া যাক; এক কালে ইন্দোইউরোপীয় সংস্কৃতি ও ভাবধারা এ অঞ্চল প্রফুল্লীত হয়েছিল। পরবর্তিতে বহু ধর্মীয় ভাব ও চিন্তার মিশ্রণে জন্ম দিয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের। যা আবার বিভিন্ন ভাবধারায় প্রভাম্বিত হয়ে ভিন্ন নামে প্রকাশ-বিকাশ লাভ করেছে মানব সমাজে।

 ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।