আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভ্রমনের গল্প : দিন পেরিয়ে দিনাজপুরে



প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা এক লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে যেই টিকিট কিনতে টাকা বাড়ালাম, কাউন্টারের ভেতর থেকে জনৈক টিকিট বিক্রেতা বিরক্তিসহকারে জানিয়ে দিলেন আপনার টিকিট পাশের বিল্ডিংয়ে। এ কাউন্টার আপনার জন্য নয়। দৌড়ে গিয়ে অপর প্রান্তে দাঁড়ালাম। মোটামুটি আবার সেই লাইন। আবার আধঘণ্টা।

কিচ্ছু করার নেই। তাই 'সবুরে টিকিট মেলে' জাতীয় একটা সান্ত্বনামূলক প্রবাদ নিজেই তৈরি করে নিলাম। মনে সুখ সৃষ্টি করে দাঁড়িয়ে রইলাম। একটা সময় মিলল টিকিট পেলাম। দুদিন পরে ট্রেন ।

ট্রেনের নাম একতা। নাম শুনে ভাবনায় পড়ে গেলাম, ট্রেনগুলো আর মানুষ হল না। বাসগুলো সবই প্রায় মানুষ হয়ে গেছে। মানুষের মতো নাম তাদের। হানিফ, এস আলম, রোজিনা, সোহাগ আরও কত কী! বাসের কথা ভুলে আমার দুই ভাই, বন্ধুর কথা মনে হলো।

যারা আজ চলে যাবে। আমি যাব পরে। দিনভর মন খারাপ, তাদের সঙ্গে যাওয়া হল না। দিনভর মন খারাপ থাকলে রাতভর ব্যাপক ভালো লাগা নিয়ে কাটালাম। যখন স্টেশন থেকে তারা একের পর এক ম্যাসেজ পাঠাচ্ছে রেলওয়ের গুষ্টি উদ্ধার করে।

ঘটনা খুবই করুণ। সন্ধ্যা ৭টা ৪৫-এর ট্রেন। তারা ৭টায় এসে হাজির। এসে জানতে পারল ট্রেন আসতে দেরি হবে। কত দেরি তা আর ফোন করে জানার সাহস পেলাম না।

তবে ধারণা করলাম, রাত ৩টার পর এসএমএস বৃষ্টি যেহেতু থেমেছে, নিশ্চয় তখনই তারা ট্রেনে উঠেছে। পরে জানলাম সেটাই সত্যি। বাংলাদেশ রেলওয়ের 'সেবা' নিয়ে 'দ্রুতযান' নামক ট্রেনযোগে তারা এত দ্রুতই পৌঁছল যা দেখে আমি পরদিন সকালে গিয়ে ৯০ টাকা তি স্বীকার করে টিকিট ফেরত দিয়ে এলাম। টিকিট ফেরত দেয়া দেখে, কাউন্টার থেকে টিকিট বিক্রেতা কিছুটা অবাক হওয়ার অভিনয় করে বললেন, যাবেন না! আমি বললাম, দ্রুতযানেরই যে অবস্থা, একতার তাহলে কী হতে পারে? একতা নামক ট্রেনটি যদি স্টেশনের সঙ্গে তার একতা প্রদর্শন করে তাহলে তো আর বাঁচা নাই। দীর্ঘ সাড়ে ৭ ঘণ্টার পথ পার করে দিনের শেষে গিয়ে দিনাজপুর পৌঁছলাম।

তবে ৭ ঘন্টা খুব বেশি মনে হলোনা, কারণ আমার সামনের সিটের এক শিশু সহযাত্রীর কার্যকলাপ আমাকে মুগ্ধ করে রেখেছিল। কখনো পেছনে তাকায়। কখনো মাথা বের করে দেয় রাস্তার দিকে। তার যা খুশি, সে করেই চলছে। ২. অচেনা দিনাজপুর শহরে নেমেই ফোন দিলাম আমার বন্ধুদের।

জানাল, আধঘণ্টা। আসছে। এমনিতে 'আধঘণ্টা' আধঘণ্টায় শেষ হলেও অপেক্ষার 'আধঘণ্টা' প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলে। যার শিক্ষা ইতিমধ্যে আমি বাসে পেয়ে ফেলেছি। দিনাজপুর পৌঁছতে আর কতক্ষণ লাগবে? এমন প্রশ্ন যাকেই জিজ্ঞাসা করেছি সে-ই বেশ বিজ্ঞের ভাব নিয়ে জবাব দিয়েছেন, এই তো এসে গেছি।

আর বড় জোর আধঘণ্টা। যা প্রায় দুই ঘণ্টা পরে গিয়ে শেষ হয়েছিল। তাই আমি অপেক্ষার দীর্ঘ প্রহরকে দীর্ঘ না করে এক রিকশাচালককে নিয়ে রওনা হলাম শহরের ভেতরের দর্শনীয় কিছু দেখার ইচ্ছায়। চালকের নাম রফিকুল। মাস্টার্স পাস।

আগে এসব শুনে বেশ অবাক হতাম। হায় আল্লাহ, আপনি এত লেখাপড়া করে রিকশা চালাচ্ছেন! এখন হই না। এমন অনেক ঘটনা দেখেছি। 'এ' গ্রেড পাওয়া, গ্রাজুয়েট রিকশাচালকদের রিকশায় উঠেছি বহুবার। শিক্ষিত রিকশাচালককে পেয়ে যে লাভ হল সে মোটামুটি গাইডেরও কাজ দিল।

ঘণ্টাখানেক শহরের বিভিন্ন অলিগুলি ঘুরিয়ে দেখাল। সঙ্গে বিবরণও দিল। রাজবাড়ী, মন্দির, রেলস্টেশন, বড় মাঠসহ অনেক কিছুই দেখলাম। বেশিক্ষণ দেখা হল না, কারণ যারা আমাকে অপেক্ষায় রেখেছিল, ইতিমধ্যে তারাই অপেক্ষায় বসে আছে। তাদের সঙ্গে অপেক্ষায় আছেন স্থানীয় উপজেলা নবাবগঞ্জের চেয়ারম্যান শিবলী সাদিক।

সঙ্গে তার স্ত্রী ক্লোজআপ তারকা সালমা। তাই ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্স করা রিকশাচালক রফিকুলকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলাম। ৩. আমাদের থাকার আয়োজন ছিল স্বপ্নপুরী নামক বিনোদন কেন্দ্র। শিবলী ভাইয়ের গাড়িতে আমরা স্বপ্নপুরীতে গেলাম। চিরকালই চেয়ারম্যান সম্পর্কে আমার যে ধারণা ছিল তাতে মিনিমাম ৫০ ঊর্ধ্ব মানুষই হতে হবে চেয়ারম্যান।

বয়সে তরুণ, স্মার্ট শিবলী ভাইকে দেখে আমার ধারণা ভেঙে কত টুকরো হল তা আর গোনা হল না, কারণ আমি তখন গুনতে ব্যস্ত গন্তব্য কতদূর! অবস্থা খারাপ আমার। দিনভর জার্নিজনিত যন্ত্রণায় শেষ। একটা সময় না ঘুমিয়েই স্বপ্নপুরীতে পৌঁছলাম। তবে গিয়ে একটা ঘুম দিলাম। ঘুমে অবশ্য কোন স্বপ্নপুরীর দেখা পেলাম না।

স্বপ্নপুরীতে ঘুমালে স্বপ্ন হয়তো আসে না। পরদিন কাজ এবং স্বপ্নপুরী ঘুরে দেখেই দিন কাটল। সে এক জটিল জিনিস তৈরি হচ্ছে। মাঠ, দীঘি, পিকনিক স্পট ছাড়াও তিনটি অসাধারণ ওয়ার্ল্ড তৈরি হচ্ছে। ফিশ ওয়ার্ল্ড, আইস ওয়ার্ল্ড এবং আর্টিফিসিয়াল ওয়ার্ল্ড।

যা এখনও প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু শেষ হলে যা দাঁড়াবে তা লিখে বোঝানো কঠিন। এগুলোর সবচেয়ে মজা হচ্ছে, এখানে সাপ-ব্যাঙ থেকে শুরু করে পরী, সামুদ্রিক মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী এমনকি বিশাল বিশাল ডাইনোসর তৈরি করা হয়েছে কোন শিল্পীর স্পর্শ ছাড়াই। ছবি সংগ্রহ ও নকশা তৈরি করে দিয়েছেন শিবলী ভাই। তারপর অসাধারণ সব কাজ করেছে একদল রাজমিস্ত্রি।

যা দেখে তাদের ধন্যবাদ না দিয়ে পারিনি। ৪. আমাদের ভ্রমণের অনেক উল্লেখযোগ্য অংশ আছে। সবচেয়ে উলেখযোগ্য শিবলী ভাইয়ের অতি আন্তরিকতা। অসম্ভব জনপ্রিয় এ চেয়ারম্যানকে দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আমরা চলে আসার দিন যা সবচেয়ে বেশি টের পেয়েছি।

চলে আসার দিন আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন পিকনিকে। পথের মোড়ে মোড়ে তার গাড়ি থামিয়ে সাধারণ মানুষের অভ্যর্থনা দেখার মতো। মানুষের সঙ্গে তিনি নিজেও যেভাবে মিশে যান তাও মুগ্ধ করার মতো। আমাদের পিকনিক স্পট ছিল একটা দীর্ঘ শালবনের ভেতরে। মাঝখানে সীতাকোট বিহার নামে একটা জায়গায় নামলাম।

প্রচলিত আছে এখানেই নাকি মূলত সীতার বাসস্থান ছিল। বর্ণনা থেকে জানা যায়, এই প্রত্নস্থলটি স্থানীয়ভাবে সীতার বাসস্থান হিসেবে পরিচিত। খ্রিঃ ১৯৬৮ এবং ১৯৭২-৭৩ সালে এ প্রত্নস্থলে উৎখনন পরিচালনা করে ৬৫মিঢ৬৫মি বর্গাকৃতি পরিমাপের একটি বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসাবশেষসহ বেশকিছু হস্তান্তরযোগ্য প্রত্নবস্তু আবিষ্কৃত হয়। এর উত্তরবাহুর মধ্যস্থলে রয়েছে ১.৮৩মি প্রশস্ত প্রবেশপথ। বিহারে মোট ৪১টি ভিক্ষুক আছে।

কগুলো ৭মিঢ৩.৩৫মিঢ৩.৫০মিঢ৩.৩৫মি আয়তনবিশিষ্ট। পেছনে দেয়াল এবং সব করেই প্রবেশ পথ আছে। আছে বারান্দা, আঙিনাও। গঠনপ্রণালী অনুযায়ী ধারণা করা হয় এটি ৭ম-৮ম শতকে নির্মিত হয়ে থাকতে পারে। সীতার আবাসস্থল দেখার পর আমাদের চলে যেতে হয়েছিল।

কারণ এখানে থাকার খুব বেশি যৌক্তিকতা নেই। এ আবাসস্থল এখন ধ্বংসাবশেষ। এখানে কোন এককালে হয়তো রান্নাঘর থাকলেও থাকতে পারে যা এখন নেই এবং যাতে চুলো জ্বলে না। খাবার তৈরি হয় না। কিন্তু আমাদের খেতে হবে।

আমাদের পেটে আগুন জ্বলছে। তাই দেরি না করে রওনা দিলাম শালবনের দিকে। যেখানে খাবার আছে। শালবনে অসংখ্য নাম না জানা পাখির ডাক কানে নিয়ে ঢুকতে হয়। কে জানে আমাদের অভ্যর্থনাতে নাকি এমন ডাকাডাকি সবসময়ই করে।

তবে মজার ব্যাপার শিবলী ভাই মানে চেয়ারম্যান সাহেব পাখির ডাক শুনে নাম বলে দিচ্ছেন। গায়ের রঙের বর্ণনাও দিচ্ছেন সঙ্গে সঙ্গে। অবাক হয়েছি শুনে। শালবন পরিদর্শন এবং আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধতা গায়ে মেখে নিলাম দীর্ঘক্ষণ ধরে। শালবনের স্থানে স্থানে পিঁপড়াদের সুরম্য অট্টালিকা দেখার মতো।

দেখার মতো ছিল পাশের জমিতে কৃষকের ধানকাটা। অনেক দিন পর অসাধারণ দৃশ্য। সম্ভবত এ দেশে ধানকাটা এবং তা নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যের চেয়ে সুন্দর দৃশ্য খুব বেশি একটা নেই। এসব দেখতে দেখতে কখন যে দিন শেষ হয়ে এলো। আমরা ফিরে গেলাম আমাদের আপাত বাসস্থানে।

রাতে বাস। চলে যেতে হবে। স্বপ্নপুরী ছেড়ে রুঢ়বাস্তব ইটের শহরে। ৫. সান্ধ্যকালীন আরেকদফা স্বপ্নপুরী দেখে বিশেষ করে পানিতে ৭২ ঘণ্টা ডুবে থাকতে পারা নওশেরকে দেখে এক রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা নিয়ে রাতে রওনা হলাম। আমাদের পৌঁছে দিতে আবারও প্রস্তুত শিবলী ভাই।

সঙ্গে তার স্ত্রী সালমা। বাসস্টেশনে পৌঁছে দিতে দিতে শিবলী ভাইয়ের আরও কিছু মুগ্ধ হওয়ার মতো কথা শুনলাম। তিনি ভরা পূর্ণিমায় তার স্বপ্নপুরীর সব লাইট বন্ধ করে দেন। মনে পড়ল সুনামগঞ্জের সাবেক পৌর মেয়রের কথা। মমিনুল ময়েজউদ্দিন ছিল খুব সম্ভবত ওনার নাম।

যিনি ভরা পূর্ণিমার রাতে তার শহরে বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিতেন। যিনি কবিও ছিলেন। তবে শিবলী ভাই কবি নন। শিল্পী। তিনি গান করেন।

আসার পথে একটা চমকপ্রদ তথ্য দিলেন। রাস্তার দু'পাশে অসংখ্য মানুষ হেঁটে যাচ্ছিল, যাদের দেখিয়ে শিবলী ভাই জানালেন, তারা কোথায় যাচ্ছে জানেন? আমরা না সূচক মাথা নাড়ালাম। বললেন, আজ আমার এক জায়গায় গান গাওয়ার কথা। শুনে এবার আর মুগ্ধ হলাম না বরং মজা পেলাম এই উপজেলার অধিবাসীদের ভাগ্য দেখে, যাদের চেয়ারম্যান একজন শিল্পী। একটা সময় সব কিছু পেছনে ফেলে বাসে ওঠে বসলাম।

সালমা, শিবলী ভাইও চলে গেছেন। শুধু টের পেলাম আমাদের পেছনে একটা সুর আসছে। কোথা থেকে আসছে কে জানে? শিবলী ভাই কি গাইছে নাকি? ছবি : ১. বাসের সামনে পিচ্ছি ২.মন্দিরের গেটে সিংহের ভাষ্কর্যের লাইট জালানোর সময় ৩, ৪, ৫, ৭, ৯. স্বপ্নপুরীর ভেতরে ৬. পাচঁ পাওয়ালা গরু ১০ সিতাবিহার ১১. পানিতে ৭২ ঘন্টা ডুবে থাকতে পারা নওশের ১২. সালমা এবং শিবলী ভাই

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.