আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছায়া পর্ব-১


১ সফিক সাহেব আয়নার সামনে দাড়িয়ে আছেন, এখন ভোর ৫ টা বাজে। সে নিজেকে আয়নাতে দেখছেন,তাকে আজ অনেক বৃদ্ধ দেখাচ্ছে। কিন্তূ তা কি করে সম্ভম????? গতকাল ও সে নিজেকে আয়না দেখেছেন তখন তো তাকে এমন বৃদ্ধ লাগেনি। তা হলেকি তার বয়স একদিনে বেড়ে গেল??? যদি বেড়ে থাকে, তবে কত বেড়েছে???তার বয়স এখন ৩৯, এই বয়সের একজন মানুষকে কি বৃদ্ধ দেখায়????? সফিক সাহেব গত ১৫ ব্ছর ধরে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ফযরের নামাজ আদায় করে,তারপর কিছুক্ষণ আয়নার সামনে দাড়িয়ে থাকেন। কেন দাড়িয়ে থাকেন তা সে জানেন না।

হয়তো তার নিজেকে আয়নায় দেখতে ভালো লাগে। । সফিক সাহেবর মাথায় প্রশ্ন গুলো গুরতে লাগলো। তার স্ত্রী সাহেনা ঘুমিয়ে আছে। সফিক সাহেব ঘর থেকে বের হয়ে তার বড় ছেলে নীলয়ের ঘরের দিকে গেল।

তার এই ছেলেটা রাত জেগে কম্পিউটারে কাজ করতে পছন্দ করে। এই রাতজাগা সফিক সাহেব পছন্দ করেন না, তার বারন করার পরেও এই ছেলে রাত জেগেথাকে। এই ছেলে তাকে যমেরমতন ভয় পায়, কেন সে তাকে এতো ভয় পায় তা সফিক সাহেব জানেন না। সফিক সাহেব নীলয়ের ঘরে ডুকতেই, নীলয় মাথা ঘুরিয়ে বাবাকে দেখে কম্পিউটার চেয়ার থেকে পরে গেল। - তুমিতো দেখছি এখনো ঠিকমতন দাড়ানোই শিখনি? হাঁঠতে জানো তো? নাকি রাস্তা দিয়ে হাঁঠার সময় ও এই ভাবে পরে যাও? - নীলয় মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে।

এই মূহত্যে তার মাথা কাজ করেছে না, মাথা ঝিমমেরে আছে। তার মুখদিয়ে ও কোন কথা বের হচ্ছে না, মনে হচ্ছেন তার জিবে গিট লেগে গেছে। কারন অনেক কষ্টে ও সে তার জিব নাড়াতে পারছেনা। - কি ব্যাপার কথা বলছোনা কেন? তোমার এস এস সি পরীক্ষাতো চলে এল, এখনো যদি তুমি কম্পিউটার নিয়ে থাক তবেতো তুমি পরীক্ষায় আন্ডা পাবে। সেই আন্ডা ও তুমি ঘরে আনতে পারবেনা, রাস্তায় আছাড় খেয়েই ভেঙে ফেলবে।

- নীলয় অনেক চেষ্টা করেও বলতে পারলো না যে, সে কিছুক্ষণ আগেও পড়ছিল। ঘুম আসছিল বলে কম্পিউটার এর সামনে বসে আছে। - আমি ঠিক করেছি আজ থেকে তোমার কম্পিউটার আমার হেফাজতে থাকবে। তোমার পরীক্ষা শেষে আবার তা ফেরত দেয়া হবে। - নীলয় তার বাবার কথা কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা।

কোন এক বিচিত্য কারনে তার কান পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। কান দিয়ে শুধু সে ঝিঝি শব্দ শোনতে পাচ্ছে। এই মূহত্যে তার কথা বলাটা জররী, না হলে তার কম্পিউটার সিজ হয়ে যাবে। এই মূহত্যে তার কি করা উচিত, তাও সে বোঝতে পারছেনা। মনে মনে নীলয় তার মাকে প্রার্থনা করছে।

শুধুমাত্র তা মাই, তাকে এই বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। - এক কাজ করো, তুমি তোমার কম্পিউটারে কিবোর্ড, মাউস, আর মনিটরের ক্যবলস গুলো আমাকে দিয়ে দাও। পুরো কম্পিউটার নিলে তোমার মা আবার ঝামেলা করবে। সে তো আবার ছেলে বলতে অজ্ঞান। - নীলয় কিছু বলতেও পারলো না, কিছু শুনতেও পেল না।

- কি হলো তুমি কি শুনতে পাওনি? দেখি জায়গা দাও- আমি নিজেই খুলে নিচ্ছি। - নীলয় কিছু বলার আগেই সফিক সাহেব তার কিবোর্ড, মাউস, আর মনিটরের ক্যবলস গুলো খুলে নিয়ে চলে গেল। নীলয় অশ্নুভরা চোখে তার কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মাথায় শুধু একটাই প্রশ্ন ঘুরছে- কেন সে কেম্যাষ্টি বই পড়ছিল?? সে ঠিক করে ছিল, কেম্যাষ্টি পড়া শেষ করে ডেসপারাড্স গেমস নিয়ে বসবে। আজ একমাস হলো ডেসপারাড্স গেমসের ৯ নাম্বার স্টেজটা তার কোন বন্ধুই পার করতে পারছিল না।

সে নিজেও পারছিলনা। আজ কেম্যাষ্টি পড়তে-পড়তে হঠাৎ করেই তার মাথায় পদ্ধতিটা চলে আসে। তাই সে ঠিক করে ছিল কেম্যাষ্টি পড়া শেষ করে ডেসপারাডসের ৯ নাম্বার স্টেজটা শেষ করবে। আর তা সম্ভব না। রাগে দুঃখে তার নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে।

গুন গুন করে কেউ একজন গান গাইছে- বঁধু কোন আলো লাগলো লাগলো চোখে। লাগলো চোখে। বঁধু কোন আলো লাগলো লাগলো চোখে। বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে। বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে।

বুঝি দীপ্তি রূপে ছিলে সর্যলোকে। বঁধু কোন আলো লাগলো চোখে। ছিলো মন তোমারো প্রতিক্ষা করি যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরে, ছিল মর্মবেদনা ঘন অন্ধকারে-- নীলয়ের ব্র কুন্চিত হলো- এতো ভোরে কে গান গাইছে? মেয়েটার গলাতো খুবিই চমৎকার!! কিন্তু গান কে গাইছে? সামীরা??? নীলয় রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে বুঝতে পারলো, - গান গাইছে উপরতলার ভাড়াটিয়া হাসনাত সাহেবের বড় মেয়ে "সামীরা"। কোন এক বিচিত্র কারনে নীলয়ের যখনই মন খারাপ থাকে, তখনই মেয়েটি গান গায়। নীলয় মাঝে মাঝেই ভাবে মেয়েটার সাথে একদিন কথা বলবে, কিন্তু বলা হয় না।

কারন তার বাবার সামনে দাড়ালে যেমন তার জিবে গিট লেগে যায় তেমনি মেয়েদের সামনে দাড়ালেও তার জিবে গিট লেগে যায়। নীলয় কিছুক্ষন সামীরার গান শুনে ছাদে উঠে এলো। রাতের অন্ধকার ভেঙে পূর্ব আকাশে আলোর ঘনঘাটা। আকাশে দিনের প্রথম সূর্যের কিরণ। নীলয় আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, আকাশে বিচিত্র রঙের খেলা।

কোন এক চিত্রকার আকাশে রং নিয়ে খেলা করছে। তার মনে হচ্ছে এমন অপরূপ দৃশ্য সে আগে কেন দেখিনি?? নীলয় আকাশ থেকে চোখ ফেরাতে পারছেনা। তার চোখ জ্বালা করছে। - কি দেখছেন, আকাশ? সুন্দর না? - নীলয় চোখ ফিরিয়ে দেখে, সামীরা তার দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে আছে। দিনের প্রথম আলোয় অসম্ভব রূপবতী এই মেয়েটিকে আরো রূপবতী লাগছে।

যেন ভোরের সূযের এক টুকুরো রঙিন আলো। - আমি মনে হয় আপনাকে ডিষ্টাব করলাম? আসলে আমি আপনাকে আগে কখনো এত ভোরে ছাদে দেখিনিতো, তাই ভাবলাম কথা বলি। আপনাকে ডিষ্টাব করায় আমি দুঃক্ষিত। - নীলয়ের খুব বলতে ইচ্ছে হলো- আমার জীবনের সবচে সুন্দর মূহুত্রটি আপনি আমাকে উপহার দিয়েছেন। কিন্তু নীলয় কিছুই বলতে পারলো না।

অসহায় ভাবে সে সামীরার দিকে তাকিয়ে রইলো। - আপনি বোধ হয় আমার উপস্হিতিতি পছন্দ করছেন না। আমি বরং চলে যাই, আপনি থাকুন। - নীলয় অনেক চেষ্টা করেও কিছু বলতে পারলো না। নীলয় তাকিয়ে আছে, সামীরা চলে যাচ্ছে।

কিন্তু সামীরার হাস্যউজ্জল মুখটা নীলয়ের চোখে চিরদিনের জন্য রেখে গেল। সাহেনা বেগম এইমূহুত্রে প্রচন্ড রেগে আছেন। তার রাগের মূলকারন তার কাজের মেয়ে। সে গিয়েছিল তার ছোট দুই ছেলেকে স্কুলে দিয়ে আসতে, আসার পথে সে অর্কদের বাসা হয়ে আসায় তার কিছুসময় বেশি লেগে যায়। বাসায় এসে দেখে তার কাজের মেয়েটি তাকে রেখেই রান্না বসিয়ে দিয়েছে।

কাজের মেয়েটি ভালো করেই জানে - তার ব্ড় ছেলে নীলয় তার মার হাতের রান্না ছাড়া খেতে পারে না। সাহেনা বেগম বাসা থেকে বের হবার সময় কাজের মেয়েটিকে তাই বলে গিয়েছিল - সে আসা না পর্যন্ত যেন রান্না না বসানো হয়। নীলয় আজ কয়েকদিন ধরেই বলছিল মটরসুটি দিয়ে শিং মাছ রান্না করতে। মটরসুটি না থাকার কারনে রান্না করতে পারছিলনা। আজ তাই সাহেনা বেগম স্কুল থেকে আসার সময় নিজে বাজার থেকে মটরসুটি নিয়ে আসে।

ভেবেছিল আজ নীলয়ের জন্য মটরসুটি দিয়ে শিং মাছের ঝোল রান্না করবে। কিন্তু তা আর সম্ভব না। কাজের মেয়েটি সমস্ত শিং মাছই রান্না করে ফেলেছে। - তোমাকে না আমি বলে গেলাম- আমাকে ছাড়া রান্না চড়াবে না। - আম্মা যে কি বলেইন, আপনার আইতে দেরি হইতাছিল তাইতো আমি রান্ধা চরাছি।

কিছুক্ষইন পরেইতো আবার খালুজান খাইতে আইবো। - আমাকে ছাড়া রান্না করছো ঠিক আাছে। কিন্তু শিং মাছ কেন? আরতো অনেক মাছ ছিল?? - আম্মা যে কি বলেইন, নীলয় বাবাজী কয়েদিইন ধইরা খালি কইতাছে হিং মাইছ খাইব। আপনে রান্ধেন না তাই আমি রান্ধলাইম। - খুব ভালো করেছো।

তুমি জাননো না নীলয় আমার হাতের রান্না ছাড়া খায় না। - আম্মা যে কি বলেইন, এইডা কেমইন কথা। আপনে যখইন থাকবেইন না তখইন সে কি খাইব?। - সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। আমি যখন থাকবো না তখন সে অন্য কারো হাতের রান্না খাওয়া শিখে নিবে।

যত দিন আমি আছি ততদিন অন্য কারো হাতের রান্না না খেলেও হবে। তোমাকে কোন কিছু বলা অর্থহীন। তুমি বরং যা করছিলে তাই করো। নীলয়ের জন্মের সময় সাহেনা বেগম তার বাপেরবাড়ি। নীলয়ের জন্মের সেই কালরাত সাহেনা আজও ভুলতে পারেনি।

সেই রাতে বাইরে কালবৈসাখী। কালবৈসাখীর সাথে শুরু হয় প্রচন্ড বৃষ্টি। তখনই তার প্রসব বেদনা শুরু হয়। রাত তখন ৩ টা। সাহেনার বাবা মোড়ল সাহেব মেয়ের প্রসবের জন্য দুই জন দাই আগে থেকেই জোগার করে রেখেছিল।

দাই দুইজন একজনও তার বাচ্চা প্রসব করাতে পারেনি। তারা বলছিলো- সন্তান পেটে নড়াচড়া করছেনা। এই সন্তানের প্রসব তাদের দ্বারা সম্ভব না। প্রচন্ড সেই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে তাকে মুস্নিগন্জ সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। তখন সাহেনার ঘ্যান নেই।

যখন সাহেনার ঘ্যান ফেরে তখন সে ঢাকার হলি ফ্যামেলি হাসপাতালে। তার সন্তানের জন্ম হয় ভোর ৬ টা ১০ মিটিয়ে প্রায় মৃত্য অবস্হায়। আকারে অনেক ছোট এই শিশুটি জন্মের পর পরই মায়ের কূলের বদলে চলে যায় - ইনস্পেটিক কেয়ারের জটিল প্রক্রিয়ার মধ্যে। ২ মাস ইনস্পেটিক কেয়ারে তাকে রাখতে হয়। কিছুটা সুস্থ হবার পর যখন ছেলেকে প্রথম তার কূলে দেওয়া হয়, ছেলে তখন তার কূল থেকে আর নামেনা।

যখনই তাকে অন্য কারো কূলে দেয়া হয়, তখনই সে সাহেনার আচল টেনে ধরে থাকে। "সবাই দেখে অবাক, - দুই মাসের এই ছোট শিশুটি কি ভাবে তার আচল ধরে রাখে? দিনের পর দিন সাহেনা এই ছেলেকে কূলে নিয়ে বসে থাকতো। যেখানেই সাহেনা যাবে সেখানেই এই ছেলে মায়ের আচল ধরে-ধরে যাবে। ধীরে-ধীরে ছেলে সাহেনার আচল ধরে বড় হতে থাকে। এই ছেলের বয়স এখন ১৭।

----------------------চলবে
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।