আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধরণী থেকে হারিয়ে যাওয়া কয়েকটি প্রাণী



ক্যামেরার সাহায্যে তোলা অথবা চিত্রকরের তুলিতে আঁকা প্রানীদের ছবি দেখে তাদের অনেককে আমরা চিনতে পারি আবার অনেককে চিনি না। আবার এদের মধ্যে অনেক প্রাণী আছে যারা ছবিতে স্থান পেলেও বাস্তবে তাদের কোনো অস্তিত্ব নেই । অথচ হারিয়ে যাওয়া এই প্রানীগুলো কোন এক সময় আমাদের এই পৃথিবীর অধিবাসী ছিল। পৃথিবীর পরিবেশ ও আবহওয়া পরিবর্তনের কারণে এবং মানবজাতির বিবেকহীন,বিবেচনাহীন কর্মকান্ডের খেসারত দিতে সতেরো থেকে বিংশ শতাব্দীর মধ্যে এদের অনেককে এই ধরণী থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হয়। তবে হারিয়ে যাওয়া সে সকল প্রানীদের অবর্তমানে আজকের পৃথিবী যে কতখানি বৈচিত্রময় তা নিয়ে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়।

যাহোক তাহলে আজ কথা না বাড়িয়ে চলুন, হারিয়ে যাওয়া সে সকল কয়েকটি প্রাণী নিয়ে আপনাদের সাথে শেয়ার করি। মেক্সিকান ভালুকঃ যুক্তরাষ্ট্রের আরিজোনা , ক্যেলিফর্নিয়া, টেক্সাস এবং উত্তর মেক্সিকোর তৃণভূমি ও পার্বত্য অঞ্চল এলাকায় মেক্সিকান ভালুকের আবাসভূমি ছিল। ধুসর বর্ণের এই প্রাণীটি ছিল মেক্সিকোতে বসবাসকারী স্তন্যপায়ী প্রানীদের মধ্যে সর্ব বৃহৎ প্রাণী। এটি লম্বায় ছিল ১৮৩ সেন্টিমিটার এবং ওজন ছিল প্রায় ৩১৮ কেজি। ১৯৬৪ সালে এই প্রাণীটির বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

ড্যাডো পাখীঃ ১৬০০ শতাব্দিতে সর্বপ্রথম এই প্রাণীটি মানুষের গোচরীভূত হয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জ মরিশাসে। বিজ্ঞানীদের মতে প্রাকৃতিক ক্রমবিকাশের ফলে এই প্রাণীটির পাখা ক্রমেই ছোট এবং পা দুটি শরীরের তুলনায় বড় হতে থাকে। একটি পর্যায়ে এসে এই প্রাণীটি দৌড়ানো এবং উড়াল দেয়ার ক্ষমতা হারায়। ড্যাডো পাখীর আহার ছিল গাছ থেকে মাটিতে পড়া ফল ফলাদি। ১৬০০ সালের দিকে এই অঞ্চলে মানুষের আগমন হলে আত্মরক্ষা করতে অক্ষম প্রাণীটি মানুষের আহারে পরিনত হয় এবং এই দ্বীপে মানুষের আগমনের প্রায় ৮০ বছর পর অর্থাৎ ১৬৮১ সালে ড্যাডো পাখীর বিলুপ্তি ঘটে।

বেইজী ডলফিনঃ ১৯৭৯ সালে চীন কর্তৃপক্ষ নদীতে বসবাসকারী বেইজী ডলফিনকে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার বিপদ সংকেত ঘোষণা দেয় এবং ১৯৮৩ সালে আইনকরে এই প্রাণী শিকার নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯০ সাল অবধি এই মাছটির সংখ্যা ৩০০ থেকে ২০০ তে নেমে আসে। পরবর্তিতে সে দেশের নদীগুলোর মুখে ৩টি বৃহৎ বাঁধ নির্মান করা হলে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে বেইজী ডলফিনের অস্তিত্ব সংকটে পরে যায় এবং এক সময় এই সংখ্যা দ্রুত নীচে নেমে এসে ৭ এ পৌঁছায়। চীনা বিজ্ঞানীরা এই প্রাণীর অস্তিত্ব রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলেও এদের সন্ধান লাভে ব্যর্থ হয় তারা । অবশেষে ২০০৬ সালে চীন সরকার সরকারীভাবে এই প্রাণীর বিলুপ্তি ঘোষণা করে।

হ্যাস্ট ঈগলপাখীঃ নিউজিল্যান্ডের হ্যাস্ট ঈগলপাখী ছিল পৃথিবীতে বসবাসকারী পাখীদের মধ্যে সর্ববৃহৎ পাখী। এই পাখীর ওজন ছিল ১০ থেকে ১৫ কেজি। বর্তমানে মধ্য ও দক্ষিন আমারিকায় যে সকল বৃহৎ আকৃতির ঈগল পাওয়া যায় হ্যাস্ট ঈগলপাখীর ওজন ছিল তাদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশী। হ্যাস্ট ঈগলপাখীর প্রধান খাদ্য ছিল তৃণভোজী ও উড়তে অক্ষম ২শত কেজি ওজনের বিশাল দেহের অধিকারী মওয়া পাখী। ৭০০ বছর পূর্বে নিউজিল্যান্ডে মানুষের পদার্পণ ও বসবাস শুরু হলে এই বিশাল ও শান্ত প্রকৃতির মওয়া পাখিটিও মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।

ফলে খাদ্য সংকটে পড়ে যায় বেচারা হ্যাস্ট ঈগলপাখী। অবশেষে ২০০ বছর পর হ্যাস্ট ঈগলপাখী এই পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাসমানিয়ান বাঘঃ এই বাঘটি অনেকের নিকট তাস্মানিয়ান নেকড়ে বা থাইলাচিনি বলে পরিচিত ছিল। অস্ট্রেলিয়ায় বসবাসকারী এই মাংসাশী প্রাণীটি ক্যাঙ্গারুর ন্যায় তার পেটের তলায় থলিতে শাবক বহন করতে পারত । দেখতে অনেকটা কুকুরের দেহের ন্যায় এই বাঘটির দেহ ছিল পাতলা, পা ও লেজ ছিল চিকন এবং চোয়ালে ৪৬টি দাত দিয়ে সাজানো মুখমন্ডল ছিল সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীর মুখমন্ডল এর মত ।

অস্ট্রেলিয়ায় ব্রিটিশ উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা পর এই বাঘের প্রধান খাদ্যের বিরাট একটি অংশ মানুষের খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। ফলে খাদ্য সংকটে পড়ে এই বাঘ। একসময় খাদ্যের অন্বেষণে এসে তারা কলোনিয়ালদের মেষ ও মেষপালকের উপর হামলে পড়ে। তখন সরকারী আদেশে শুরু হয়ে যায় বাঘ নিধন। দীর্ঘদিন নির্বিচারে হত্যা করার পর এক সময় বাঘের সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেলে সরকার এই প্রাণীটির অস্তিত্ব রক্ষায় এগিয়ে আসে কিন্তু ততক্ষণে বেলা বহুদূর গড়িয়ে যায়।

১৯৩৩ সালে এই প্রজাতির সর্বশেষ নমুনাটি ধরা পড়ে এবং ১৯৩৬ সালে বাঘটির মৃত্যুর মধ্যদিয়ে তাস্মানিয়ান বাঘের বিলুপ্তি ঘটে। পার্সিয়ান বাঘঃ এই বাঘটি অনেকের নিকট কাসপিয়ান টাইগার নামে পরিচিত ছিল। এই প্রাণীটির আবাস স্থল ছিল সুদুর আনাতোলিয়া উপদ্বীপ থেকে ককেশাস , কুর্দিস্থান উত্তর ইরাক, ইরান আফগানিস্তান এবং মঙ্গোলিয়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিয়ে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও সাইবেরিয়ান বাঘের পর বৃহত্তম বাঘ হিসেবে এই বাঘের স্থান ছিল তৃতীয় স্থানে। পরবর্তিতে এই অঞ্চলগুলোতে মানুষের বসবাস বৃদ্ধি পেলে এই প্রাণীর পৃথিবী সংকুচিত হয়ে আসতে থাকে।

তাছাড়া রাশিয়ার জার ককেশাস ও মধ্য এশিয়ার অঞ্চলগুলো দখল করে সম্রাজ্যের পরিধি বাড়ানোর সময় অঞ্চলগুলোতে বসবাসকরি বাঘগুলোকে হত্যার আদেশ দিলে অতি অল্প সময়ে এদেরকে নিধন করা হয়। ১৯৬১ সালে তাজিকিস্তানে শেষ বারের মত এই বাঘটি মানুষের দৃষ্টিগোচর হয়। ক্যাপ লায়নঃ ২৫০ কেজি ওজনের বিশাল দেহের এই সিংহের আবাসভূমি ছিল দক্ষিন আফ্রিকার দক্ষিনপশ্চিম অঞ্চল কাররো এর তৃণভূমি এলাকায়। ইউরোপীয়দের দক্ষিন আফ্রিকায় উপনিবেশ শুরুর সাথে সাথে এই প্রাণীটির নির্মূল কার্য্য শুরু হয়ে যায়। যদিও ক্যাপ লায়ন এর বিলুপ্তির জন্য ডাচ উপনিবেশকদের দায়ী করা হয় কিন্তু তথ্য ও প্রমানে এই প্রাণীর বিলুপ্তির পেছনে ব্রিটিশ উপনিবেশদের সংশ্লিষ্ট থাকার যথেষ্ট প্রমান পাওয়া যায়।

উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেই ব্রিটিশরা নির্বিচারে ক্যাপ লায়ন বধ করা শুরু করে এবং ১৮৬০ সালে এসে পৃথিবী থেকে এই প্রাণীটিকে সম্পূর্ণ নিচিহ্ন করতে সমর্থ হয়। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশ জেনারেল বিসেট সর্বশেষ ক্যাপ লায়নটি হত্যা করার মধ্য দিয়ে ক্যাপ লায়ন বিলুপ্ত করার পর্বটি শেষ করেন। মহান কাঠকুড়ালি /কাঠঠোকরা পাখিঃ পৃথিবীর সুন্দর পাখীদের মধ্যে অন্যতম সুন্দর এই পাখীর বসবাস ছিল মেক্সিকো ও যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিন বনাঞ্চল এলাকায়। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকে নাটকীয়ভাবে এই পাখি বিলুপ্ত হতে থাকে। বিশ্বের আবহওয়া ও পরিবেশ পরিবর্তনের পাশাপাশি মানুষ কর্তৃক গাছগাছালি কেটে বনাঞ্চল উজার এবং অবৈধভাবে শিকার করাটাই এই পাখীর বিলুপ্ত হবার প্রধান কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

১৯৫৭ সালে এই প্রজাতির সর্বশেষ পাখিটি গোচরীভূত হয়। কোয়াগাঃ ১৮৭০ সালে দক্ষিন আফ্রিকার অধিবাসী জেব্রা প্রজাতির এই প্রাণীর সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্তি ঘটে। জেব্রাদের মতই এই প্রাণীটির মুখে, ঘাড়ে সাদা ডোরাকাটা দাগ এবং ঘাড়ে কেশর ছিল। এদের পেটের ও পায়ের চামড়ার রং ছিল সম্পূর্ণরূপে সাদা। উনবিংশ শতাব্দিতে ডাচ উপনিবেশীয়রা মাংস ও চামড়ার লোভে এই বন্যপ্রাণীদের নির্বিচারে হত্যা করে এবং ১৮৮৩ সালে ১২ আগস্ট বেঁচে থাকা সর্বশেষ কোয়াগার মৃত্যুর ভেতর দিয়ে এই প্রজাতির প্রাণীর বিলুপ্তি ঘটে।

আলকা /দানব পেঙ্গুইনঃ এই প্রাণীটি আক গোত্রের পাখীদের মধ্যে সর্ববৃহৎ পাখী। আবার অনেকেই পাখীদের "ইম্পেরিয়াল এলাকাইন" বা দানব পেঙ্গুইন বলে জানত। রোমান অমলে আটলান্টিক মহাসাগরের উপকূলবর্তী দেশ ফ্লোরিডা থেকে গ্রীনল্যান্ডসহ আইসল্যান্ড, স্ক্যানডিনাভিয়া, পশ্চিম ইউরোপের উপকূল এলাকায় এদেরকে সচরাচর দেখা যেত। সাধারনত একটি পূর্ণাঙ্গ বয়স্ক আলকা উচ্চতায় ১ মিটার পর্যন্ত হত। ১৮৪৪ সালের ২ জুন আইসল্যান্ডে এই প্রজাতির একটি জুটিকে শেষ বারের মত দেখা যায়।

বালী টাইগারঃ বাঘ প্রজাতিদের মধ্যে বালী টাইগার ছিল আকারে সর্বাপেক্ষা ছোট এবং দেখতে অনেকটা জাগুয়ারের মত। ইন্দোনেশিয়ার বালী দ্বীপের বনাঞ্চলে এই প্রাণীটির পদচারণা ছিল। শিকার করার নামে এদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হলে ১৯৩৭ সালে এরা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। নিউজিল্যান্ডের পেঁচাঃ স্ট্রীজিডাই পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই প্রাণীটি স্থানীয় ভাষায় ওইকাউ ইন মাউরি বলে পরিচিত ছিল। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে অর্থাৎ ১৯১৪ সালের দিকে এই প্রাণীটি বিলোপ হতে থাকে।

আবহওয়া ও পরিবেশের পরিবর্তন এবং খাদ্যের অপ্রতুলতা এই প্রাণীটির বিলুপ্ত হওয়ার প্রধান কারণ হিসাবে ধরা হয়েছে। টাইগার অফ জাভাঃ বাঘ পরিবারের অন্তর্ভুক্ত এই প্রাণীটিকে ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে দৃশ্যমান হত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে বার্লিন এবং রোটারড্যাম এর চিড়িয়াখানায় বেশ কয়েকটি জাভান টাইগারকে দেখা গেলেও পরে এদের কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় নাই। অবশেষে ১৯৭৯ সালে টাইগার অফ জাভাকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। জাপানিজ নেকড়েঃ বিলোপ হওয়া এই প্রাণীর বসবাস ছিল জাপানের দ্বীপপুঞ্জ হনসু , কাইউসু এবং সিকোকু এলাকায়।

১৭৩২ সালে এলাকাবাসীদের ক্রোধ ও রোষানলে পড়ে এই নেকড়েগুলোর মৃত্যু ঘটে। ১৯০৫ সালে শেষ বারের মত এই প্রাণীটিকে দেখা যায়। সমবুর্গস হরিণঃ থাইল্যান্ডের জলময় তৃণভূমি এলাকায় এই প্রাণীগুলোকে দলবেধে গাছের গাছের ফল, গুল্ম, লতাপাতা আহার করতে দেখা যেত। কিন্তু এদেরকে কখনই গহীন বনাঞ্চলে প্রবেশ করতে দেখা যেত না । উনবিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সেখানে প্রচুর ধান উৎপন্ন করার লক্ষে বিশাল জলময় জমিগুলো কৃষিকার্যের আওতায় নিয়ে আসা হলে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে হরিণদের অস্তিত্ব বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে।

অবশেষে ১৯৩২ সালে এই সমবুর্গস হরিণ পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। ক্যারিবিয়ান মন্ক সীল (মোনাচুস ট্রোপিক্যালিস)ঃ ক্যারিবিয়ান মন্ক সীল নামের এই স্তন্যপায়ী প্রাণীর বসবাস ছিল গ্রীষ্মপ্রধান অঞ্চল ক্যারিবিয়ান সাগর এবং ফ্লোরিডার উপকূলবর্তী এলাকায়। বিংশ শতাব্দির শুরুতে এই প্রাণী লোকচক্ষুর আড়াল হতে থাকলে খুঁজে বের করার জন্য কয়েক দফা চেষ্টা করা হয় কিন্তু খোঁজার পর কোনো সন্ধান না পাওয়ার কারণে ১৯৫২ সালে ক্যারিবিয়ান মন্ক সীলকে বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।