আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেনেনিন - বাংলাদেশে ইসলামিক মৌলবাদী রাজনীতির অবস্থান

আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব।

বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে বাজারী মৌলবাদও আশ্রয় করেছে ধর্মীয় মৌলবাদকে। বাজারী মৌলবাদ যেমন বাজারকে বিকৃত করে গজিয়ে ওঠে, সেভাবে ধর্মীয় মৌলবাদ ধর্মকে বিকৃত করে গজিয়ে ওঠে এবং নিজেকে প্রসারিত করে। চিন্তা করার ক্ষমতা, ভাষা প্রয়োগের ক্ষমতা প্রতিটি সুস্থ মানুষেরই সহজাত প্রবণতা। এমন কোনো মানব গোষ্ঠী নেই, যাদের ভাষা নেই।

এই ভাষার মাধ্যমেই মানুষ পরস্পরের সাথে চিন্তার আদান-প্রদান করে তার যুক্তি প্রয়োগের ক্ষমতা দিয়ে। অনুভূতির জায়গা মানুষের জীবনে নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু সে অনুভূতি শুধু অর্থহীন উল্লাস, বিলাপ বা প্রলাপ হলে, মানুষের সমাজ তৈরি হতো না এবং মানুষ সাধারণ বন্য পশুর চেয়ে দীর্ঘজীবী, বুদ্ধিদীপ্ত বা জ্ঞানী-গুণী বলে গণ্য হতে পারতো না। ধর্মীয়ভাবেও মানুষের এ গুণাগুণগুলো স্বীকৃত। মানুষের সমাজে পুঞ্জীভূত অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুক্তির বিদ্রোহ একটি সামাজিক দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।

সংকীর্ণ ধর্মীয় মৌলবাদ সে অঙ্গীকারকে নস্যাত্ করে যুক্তির বিদ্রোহকে অন্ধবিশ্বাসের প্লাবনে ভাসিয়ে দিতে চায়। মহামতি কার্ল মার্কস ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে খন্ডন করে যুক্তিবিদ্যার আওতায় সমাজ পরিবর্তনে দ্বান্দ্বিক নিয়মে মানুষের ঐসব মহত্তম গুণাবলীর আরো উন্নত ও সমন্বিতভাবে বিস্তর পরিবর্তন তথা বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মধ্যদিয়ে বহিঃপ্রকাশ ঘটার যে দৃঢ় যুক্তি দেখিয়েছেন, আজকের উদারনৈতিক বুর্জোয়া দার্শনিক নোয়াম চমস্কি ও অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনরাও তা অকপটে স্বীকার করছেন। ধর্মীয় মৌলবাদকে পশ্চিমা বিশ্ব সচেতনভাবে কতো দেশে কতোভাবে উস্কিয়ে দিয়েছে তার ইতিহাস আজ সুবিদিত। ধর্মীয় মৌলবাদের দুই মেরুতে অবস্থিত সৌদি আরবের আমীর শাহী আর ইসরাইলের গণতন্ত্রের প্রহসন নব্য নািস সরকার। দু'টি রাষ্ট্রই হলো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোর পরম মিত্র।

ধর্মীয় মৌলবাদ দিয়ে মানুষের সত্যিকারের স্বাজাত্যবোধ ও সামাজিকতাকে নষ্ট করে ধনিক গোষ্ঠী নিয়ন্ত্রিত বাজারকে চাপিয়ে দিতে পারলে বিশ্বের ধনীদের আরও বাড় বাড়ন্ত হয়-এই অভিসন্ধি থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা এই জঘন্য প্রয়াসে লিপ্ত থেকেছে। মার্কিন যুক্তিরাষ্ট্রের এক ভূতপূর্ব পরামর্শদাতা ও রাষ্ট্রসচিব ব্রেজেনস্কি এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, ১৯৭৮-৭৯ সালেই আফগানিস্তানে কমিউনিস্ট শাসন প্রচলিত হবার সময়েই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গোপনে সেখানকার মৌলবাদীদের অর্থ এবং অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করতে আরম্ভ করে। ১৯৮১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রত্যক্ষভাবে আফগানিস্তানের সমাজতন্ত্রী সরকারকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি এবং পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে মুজাহিদদের অস্ত্র, অর্থ এবং রসদ সরবরাহ করতে থাকে। ওসামা বিন লাদেন সেই প্রয়াসেরই অংশ হয়ে আফগানিস্তানে নিজের ঘাঁটি গেঁড়ে বসেন। আজ সারা বিশ্বের নিকট সুবিদিত যে, সন্ত্রাসবাদীদের উত্খাত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিমা বিশ্বের ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো আফগানিস্তানের হাজার হাজার লোকের হত্যাকান্ডে লিপ্ত হলো, সেই সন্ত্রাসবাদকে পশ্চিমা বিশ্বেরই তৈরি 'ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানব' বললে অত্যুক্তি হবে না।

সব থেকে নির্মম পরিহাস হল তালেবান কমান্ডার ওসামা বিন লাদেনকে যারা দুধ-কলা দিয়ে পুষেছিল, সে লাদেনই তার সৃষ্টিকর্তাকে ছোবল মারতে চেষ্টা করেছে। সে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিপক্ষ হিসেবে নিজেকে আত্মপ্রকাশ করে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিপক্ষ হিসেবে তাকে হত্যা করে ধর্মীয় আচার মোতাবেক তার শবদেহকে কবর না দিয়ে সমুদ্রে ফেলে দেয়। লাদেনের অনুসারীরা বর্তমানে আফগানিস্তান, পাকিস্তানসহ সারা বিশ্বে মুসলিম ব্রাদারহুডসহ অন্যান্য সংঠগনের নামে ফ্যাসিবাদী শক্তি হিসেবে গণতন্ত্র ও মুক্তচিন্তার বিরোধী শক্তি হিসেবে বিকাশ লাভ করছে। এ অপশক্তি আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিসর, তুরস্কসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতার ভর কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

সম্প্রতি পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচনে তালেবানপন্থি এবং উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীরা পাকিস্তান পিপলস্্ পার্টিকে ক্ষমতা আসার ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে নওয়াজ শরীফের ক্ষমতায় আসার ক্ষেত্রে সক্রিয় সমর্থন যোগায়। আমাদের দেশেও ১৮ দলীয় জোটের প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে জামায়াতে ইসলাম এবং সকল মৌলবাদী চক্র বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়াকে শিখন্ডি হিসেবে সামনে রেখে বিভিন্ন মিথ্যাচার ও গুজব ছড়িয়ে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় আসার লক্ষ্যে সর্বাত্মক রণনীতি ও রণকৌশল নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জামায়াত-শিবির এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক কায়েমী স্বার্থবাদী মহল মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারকে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতাচ্যুত করার নীল-নক্শা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, দেশে চরম সাম্প্রদায়িক ও দক্ষিণপন্থি সরকার প্রতিষ্ঠা করা। জননেত্রী শেখ হাসিনা মনেপ্রাণে একজন বাঙালি হয়ে প্রাত্যহিক জীবনে যেখানে ইসলামি মূল্যবোধ ও অনুশাসনকে সমুন্নত রেখে ব্যক্তিজীবনে সেই মূল্যবোধ ও অনুশাসন লালন করেন, সেখানে জামায়াত-শিবির অপচক্র তাঁকে ও তাঁর দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে 'নাস্তিক' (যদিও আস্তিক বা নাস্তিক নির্ধারণের ক্ষমতা আল্লাহর) হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে আসছে।

অন্যদিকে বিরোধী দলীয় নেত্রী একজন বাঙালি হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে পবিত্র ইসলাম ধর্মের মূল্যবোধ ও অনুশাসনকে লালন করেন না বলে যেখানে রাজনৈতিক মহলে সর্বজনবিদিত, সেখানে তাঁকে 'আস্তিক (?)' বলে দেশে আস্তিক-নাস্তিকের মধ্যে Vertically দ্বিধাবিভক্তি করার অপচেষ্টা চালিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নন-ইস্যুকে ইস্যু করতে সচেষ্ট। এ অপশক্তি ধর্মপ্রাণ সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে ব্লগ, ফেসবুক, ইউটিউব প্রভৃতির মাধ্যমে মিথ্যা খবর ও ছবি জুড়ে দিয়ে মানুষের ধর্মীয় মনোভাবকে Exploit করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের স্বপ্নে বিভোর। বর্তমানে মৌলবাদের চলাচল বিশ্বায়নেরই রাস্তা পরিক্রমা। মৌলবাদীদের প্যান ইসলামিক পুনরুত্থানবাদ জাতীয়, আঞ্চলিক এমনকি বহুত্ববাদ স্বীকার করে না। মুসলিম সমাজগুলোকে একশীলা (মনোলিথিক) করে তোলার জন্য এরা কখনো সমাজের ভিতরে কোনো বিরোধ-বিতর্ক-জিজ্ঞাসা বরদাস্ত করতে রাজি নয়।

ঠিক যেমন রাজি নয়, বিশ্বায়নের কর্তারা। তাদের কাছে তারাই মূলধারা, বাকি সব সভ্যতা-সংস্কৃতি-সমাজ প্রান্তিক। বিশ্বায়নের মূল প্রভু দেশে দেশে বিভিন্ন কায়দায় নতুন বিশ্ব কায়েম করার বিষয়ে উদগ্রীব। আজকে আন্তর্জাতিক মৌলবাদীরা একই ভাবধারায় নিজেদের চালু করছে। তাদের হাতেও রয়েছে অস্ত্র, পুঁজি, প্রযুক্তি, তথ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা এবং পিছিয়ে পড়া দর্শন চিন্তা।

একটা প্রশ্ন সকলের নিকট ঘুরেফিরে আসছে যে, বিশ্ব জুড়ে ইসলামি মৌলবাদের এমন রমরমা বাজার কেন ? এটি যে কোনো শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন, সংবেদনশীল মানুষকে যে চিন্তায় ফেলেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ নিয়ে বহু চর্চাও হচ্ছে। এর মূল সূত্র হলো, বিশ্বায়ন এবং সংস্কৃতির সাযুজ্য বিধান ও একাকীত্বকরণের নামে পশ্চিমা বিশ্ব যেভাবে আধিপত্য চালিয়ে যাচ্ছে, তারই উল্টো দিকে মৌলবাদী চিন্তার সামাজিকীকরণ হয়েছে বহুল পরিমাণে। একটা সময় এমন ছিল যে, অর্ধশিক্ষিত গ্রাম্য মোল্লা শ্রেণির লোকদের একটা অংশ ছিল মৌলবাদী ধ্যান-ধারণার প্রবক্তা। কিন্তু গত ২৫/৩০ বছরে মৌলবাদীদের সামাজিক ভিত্তি বহুদূর বিস্তার লাভ করেছে।

আমাদের অভিজ্ঞতাতেই দেখেছি, শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিশেষ করে ছাত্র-যুবরা পশ্চিমা ধাঁচের আধুনিকতা গ্রহণে বেশি আগ্রহী ছিল। কিন্তু এখন তার বিস্তর পরিবর্তন হয়েছে। উচ্চশিক্ষিত ছাত্র-যুব সম্প্রদায়, আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি বড়ো অংশ আজ মৌলবাদের চালিকা শক্তি। বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তি আত্মস্থ করে তাদেরই হূদপিন্ডে আঘাত করার কৌশল ইতোমধ্যে তারা রপ্ত করে ফেলেছে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারের ঘটনা তারই প্রমাণ।

বর্তমানে যে বিষয়টি খুবই উল্লেখ করার মতো তা হলো, অতীতে মৌলবাদী সংগঠনগুলো কদাচিত্ মিছিল-সমাবেশ করতো। মিছিল-সমাবেশে যাদের বয়স যৌবন অতিক্রম করেছিল, তাদের উপস্থিতির প্রাধান্য ছিল। কিন্তু বর্তমানে ঐ মিছিল-মিটিং এর অবয়ব আর গভীরতা দুই-ই পাল্টে গেছে। নতুন নতুন মুখের ছাত্র-যুবক তাতে অংশীদার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের সংগঠনের ব্যাপ্তি বাড়ছে।

সম্প্রতি ১৮ দলীয় জোটের সরকার বিরোধী আন্দোলনের জামায়াত-শিবিরের যুব ও ছাত্র সম্প্রদায় আধুনিক কায়দায় পুলিশের ওপর আক্রমণ, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ, রাস্তা ব্যারিকেড এবং অতর্কিত হামলা এর প্রকৃষ্ট প্রমাণ। মৌলবাদীরা সেকারণেই আধুনিকতার সন্তান। তা যে অর্থে আমাদের সামনে প্রতিবাদ হোক না কেন। স্যামুয়েল হান্টিংটন এর নাম বুদ্ধিজীবী মহলে এখন সবিশেষ পরিচিত। তার মতামতটা আমাদের জেনে রাখা ভালো।

তিনি সভ্যতার সংঘাত (Clash of Civilization) দেখেছেন। তিনি ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর নতুন বিন্যাসের দিকে দৃষ্টি দিয়ে কালক্ষেপ করছেন। যে কোনো বিপ্লবী আন্দোলনের মতো এখানেও মূল সংগঠকরা শুধুমাত্র মাদ্রাসায় শিক্ষিতরা নয়। ভালো ভালো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবীরা এর নেতৃত্বে অগ্রগামী। এদের নেতৃত্বের অর্ধেকের বেশি এসেছে এলিট কলেজগুলো থেকে অথবা বিদ্যাবুদ্ধির সবচেয়ে বেশি দাবিদার যেসব জায়গা, সেই কারিগরি শিক্ষা প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে।

অনেকে আবার চিকিত্সাবিদ্যা ও ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার ছাত্র ও শিক্ষক। এদের ৭০ শতাংশেরও বেশিরভাগ হল মধ্যবিত্তের সন্তান। গরিব নয়, অথচ সচ্ছলও নয়। এমন অনেক পরিবারের সন্তান, যারা এ প্রজন্মেই উচ্চশিক্ষার সুযোগ পেল। এ ধরনের লোকের সংখ্যাও এদের সংগঠনে ব্যাপক।

তারা ছোট বেলায় মফস্বলে কাটালেও বড় হয়ে বিরাট শহরে পা রাখছে। সবচেয়ে বুদ্ধিমান ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণরা (সমগ্র জনসংখ্যায় তাদের অংশ খুবই কম কিন্তু তুলনামূলক বিচারে তারাই) অত্যধিক হারে মৌলবাদীদের সাথে যোগ দিয়েছে। সুতরাং তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। পৃথিবীর দেশে দেশে অবিচ্ছিন্নভাবে দৃশ্যমান এমন ঘটনা আমাদের দেশেও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমাদের দেশে তরুণ বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগ দিয়েছে শহুরে ছোট ব্যবসায়ী, সাধারণ চাকরিজীবী নিম্নবিত্ত মানুষ।

এর সাথে যোগ হয়েছে, গ্রাম থেকে নানা কারণে ছুটে আসা ছিন্নমূল জনতা। সব মিলিয়ে মৌলবাদীদের সামাজিক অংশ নানাভাবে শক্তিশালী হচ্ছে। বর্তমানে আমাদের দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক অবকাঠামোতে এদের অবস্থান পূর্বের যে কোনো সময়ের তুলনায় শক্তিশালী বলা যায়। আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে গোয়েবলসীয় কায়দায় জনগণের মধ্যে ধর্মীয় রাজনীতির মিথ্যা ও অপব্যাখ্যাকে পুঁজি করে নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার অপকৌশলে তারা সিদ্ধহস্ত। গত ৫ই মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে মিসরের তাহরীর স্কয়ারের আদলে সরকার পতনের লক্ষ্যে তাদের ষড়যন্ত্র নস্যাত্ হবার পর তারা বাঁশের কেল্লা নামে ফেসবুকে হতাহতের মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সরলপ্রাণ সাধারণ জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তির ধূম্রজাল সৃষ্টি করে অনেকটা সফল হয়েছে।

পবিত্র ইসলাম ধর্মে মিথ্যা এবং গুজব রটানো জায়েজ না হলেও ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াত-শিবির চক্র হাইতির ভূমিকম্পে নিহতদের ছবি বিকৃতভাবে প্রচার করে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করতে অনেকটা সফল হয়েছে। মূলতঃ চিন্তার দিক থেকে পশ্চাত্পদ হলেও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে এরা যথেষ্ট পারঙ্গম। নীতি কথা বলে অনৈতিক কাজের মাধ্যমে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে জামায়াত-শিবিরের জুড়ি নেই। অতিরিক্ত আগ্রাসনবাদ মৌলবাদীদের দর্শনের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। বিশ্বায়ন কর্তাদের সঙ্গে তাদের এক্ষেত্রে যথেষ্ট মিল আছে।

পশ্চিমা বিশ্বের রাষ্ট্রনায়কদের বর্তমান আগ্রাসী চিন্তা সেই পর্যায়েই পড়ে। ভারতে হিন্দু মৌলবাদীদের দিয়ে ১৯৯১ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা আগ্রাসনবাদেরই বহিঃপ্রকাশ। জনগোষ্ঠীর একাংশের মধ্যে জনপ্রিয়তা বাড়াতেও তা সাহায্য করেছে। আর একটি জনপ্রিয় কাজ মৌলবাদীরা চালাচ্ছে, তা হলো সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ। সেবাধর্ম পরিচালনার ক্ষেত্রে তারা অদ্বিতীয় হয়ে উঠেছে।

হান্টিংটন-এর পর্যালোচনাতে ফিরে গেলেই তা দেখতে পাওয়া যাবে। এ ধরনের মানবিক বা খয়রাতি কাজকর্ম শুধুমাত্র সন্ত্রাসবাদী তত্পরতার আড়াল বা আশ্রয় নয়। এইসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মৌলবাদীরা ব্যাপকভাবে সামাজিক সেবামূলক কর্মসূচি চালায়। মসজিদ ভিত্তিক শিক্ষা, স্কুল, নার্সারী, হাসপাতাল, চিকিত্সাকেন্দ্র, কৃষি ফার্ম, কারিগরি শিক্ষা-কী তাদের নেই? বাংলাদেশে এরা চট্টগ্রাম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামি ব্যাংক, ইবনে সিনা ক্লিনিকসহ বিভিন্ন ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউট, এনজিও প্রভৃতির সাহায্যে ছাত্রদের প্যান ইসলামের রাজনৈতিক দর্শনের মাধ্যমে যে সামাজিক শক্তি গড়ে তুলেছে, তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশ সৃষ্টির মূল দর্শন অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিপরীতে মূলতঃ ফ্যাসিবাদী ধর্মীয় উন্মাদনার ভিত্তিভূমি রচনা করা। এই আর্থ-সামাজিক ভিত্তি সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনকে Vertically দ্বিধাবিভক্ত করতে ইতোমধ্যে জামায়াত অনেকটা সফল হয়েছে।

বিএনপির ছত্রছায়া তাদের শক্তিকে আরো বিকশিত করতে বিভিন্ন অপকৌশলের আশ্রয় নিয়ে দেশকে আস্তিক-নাস্তিক বিভক্তির দিকে ঠেলে দিয়ে জনগণের মৌলিক সমস্যা যেমনঃ কর্মসংস্থান, বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়কে আড়াল করতে সচেষ্ট থাকছে। এরা নিজস্ব এলাকায় দুঃস্থজনের মধ্যে ঔষধ, কাপড় বা বইপত্র বিলি করে। সব মিলিয়ে আমজনতার সামাজিক-অর্থনৈতিক এবং আধ্যাত্মিক কষ্টের সময় এরা পাশে দাঁড়ায়। তাদের এই 'দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত' সেবা কাজের সঙ্গে পাল্লা দেবার চেষ্টা পশ্চিমা মানবিক সংগঠনগুলোর নেই। আমাদের দেশে ধর্মীয় জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, মৌলবাদীদের জনভিত্তি বহুলাংশে বাড়িয়ে দিয়েছে।

ইসলামি মৌলবাদের উত্থান কেবলমাত্র মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে যে ছড়িয়ে আছে তা-নয়। আগেই উল্লেখ করেছি, বিশ্বব্যাপী তার জাল ছড়িয়ে পড়েছে। ২০০১ সালে আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের মধ্যে দিয়ে তা নিয়ে আলোচনা আরও ব্যাপকতর হয়েছে। সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ বুশ একহাতে কোরআন ধরে মৌলভী-মাওলানাদের সঙ্গে সভা করেছেন, অন্যদিকে ইসলাম ও সন্ত্রাসবাদ সমার্থক বলে নিরন্তর প্রচার করেছেন। ইসলামের দুর্ভাগ্য এটাই, যে ধর্ম একদিন কেবল ঊষর আরব ভূমিতে নয়, সারা বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, সহমর্মিতা বৃদ্ধিতে ঐক্যের নিদান ঘোষণায় তত্পর হয়েছিল, এমনকি আমাদের দেশেও শান্তির বাতাবরণে মানুষ পবিত্র ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল, যার এই মানবিক রূপ প্রত্যক্ষ করে কোটি কোটি মানুষ ইসলামকে নিজেদের জীবন চর্চার সঙ্গে মিলিয়ে নিয়েছিল, তাকেই এই বদনামের ভাগীদার হতে হচ্ছে।

সেটা খুবই মর্মান্তিক। এ কারণেই মুসলিম মৌলবাদের উত্থান এবং এর বিস্তৃতি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। পবিত্র ধর্ম ইসলামের প্রকৃত আবেদনের সঙ্গে মৌলবাদীদের ক্লেদাক্ত চিন্তার কোনো মিল নেই। পবিত্র ইসলামের একটিই রূপ। পবিত্র ইসলামের দু' ধরনের রূপের যে তত্ত্ব বুশ-জামায়াতেরা দেখাচ্ছেন, তাকে অবলীলাক্রমে মিথ্যা বলে দেওয়া যায়।

সে কারণেই আরও একবার উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, বিশ্বব্যাপী মৌলবাদী পুনরুত্থান (ইসলামিক, হিন্দু, খ্রিস্টান ইত্যাদি) শুরু হয়েছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর ভাঙ্গন, অধঃপতন তথা সমাজতন্ত্রের আবেদন ভাটার সময়ে। একদিন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের দার্শনিক চিন্তায় বিশ্ব তারুণ্য মশগুল ছিল। সোভিয়েত বিপ্লবের জয়, ফ্যাসিবাদীদের পরাজয়, একটার পর একটা ঔপনিবেশিক দেশের মুক্তি সারা পৃথিবীকে মাতোয়ারা করে দিয়েছিল। সেই দার্শনিক এবং ব্যবহারিক ঘটনাবলী এখন পিছনের দিকে-সাময়িক হলেও বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় তার প্রভাব হরাস পেয়েছে। মৌলবাদীদের তত্পরতা সেই প্রেক্ষাপটে বেড়েই চলেছে।

তার সঙ্গেই যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা পুঁজিবাদী ও নয়া সাম্রাজ্যবাদী তত্পরতা। তাছাড়া বিশ্বায়নের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির প্রতিক্রিয়ায় ধর্মীয় মৌলবাদ এক শক্তিশালী রাজনৈতিক মতাদর্শে পরিণত হয়েছে। বিশ্ব ধনবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ চলমান বাজার অর্থনীতি, সামরিক একাধিপত্য বজায় রাখার স্বার্থেই বিশ্বময় নিপীড়িত ও নির্যাতিত জাতিগুলোকে বিভক্ত ও দুর্বল রাখার জন্য কোথাও বর্ণবাদ-ফ্যাসিবাদকে আবার কোথাও এরই রূপান্তরিত চেহারায় সম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয়-ফ্যাসিবাদকে লালন-পালন ও ব্যবহার করে চলেছে। মোটকথা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় মৌলবাদ হলো ধনতন্ত্রেরই দুই প্রোডাক্ট। বর্তমান বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের একাংশ বিভিন্ন সামাজিক অবস্থান থেকে সুদূর গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত বিকাশমান উগ্র সাম্প্রদয়িক শক্তির আধিপত্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাবার লক্ষ্যে মুসলিম জঙ্গীবাদীরা ক্রমশ আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।

অন্যদিকে পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী আমাদের দেশকে উদার মুসলিম দেশ বলে মূলতঃ সাম্প্রদায়িক ও উগ্র মৌবলবাদী কাজকে সমর্থন যুগিয়ে যাচ্ছে। মোটকথা, সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বে চরম আধিপত্যবাদ ছড়িয়ে দেবার জন্য আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে চলেছে। সে চলার পথে বিশ্বায়ন, মৌলবাদ, সন্ত্রাসবাদ-সবগুলোই এক একটি সাম্রাজ্যবাদী হাতিয়ার। এদের আক্রমণ কখনো জোটবদ্ধভাবে, আবার কখনো সময় বিশেষে আলাদা আলাদা। এ আধিপত্যবাদের যে আকারই থাকুক না কেন, এর বিরুদ্ধে সমস্ত প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি, উদার মনোভাবাপন্ন এবং সত্যিকারের ধার্মিক ব্যক্তিদের সমন্বয়ে নিরবচ্ছিন্ন গণআন্দোলন ও সম্মিলিত প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই।

সুত্র Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৫ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.