আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাল্যবিবাহ

"There are too many people, and too few human beings." - Robert Zend

আমাদের দেশে বর্তমানে বাল্যবিবাহের হার কত? ভাবছেন হঠাৎ এই প্রশ্ন? আসলে আমরা জীবন ব্যস্ততার চরকি ঘুরতে ঘুরতে বাস্তবের অনেক কিছুর দিকেই চোখ ফেরানোর সময় পাইনা। আর সময়ের আবর্তনের সাথে সাথে আমরাও আবর্তিত হতে থাকি সব অদ্ভুত কুৎসিত বাস্তব গুলোর ভেতর দিয়ে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলছি। আমাদেরই গ্রামে গিয়েছিলাম জনৈক আত্নীয়ের বিয়েতে। ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলা সদরের কয়েক কিলো ভেতরে আমাদের গ্রাম।

বিয়ের দিন সাতসকালে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম গ্রামের উদ্দেশ্যে। প্ল্যান ছিল দুইদিনব্যপী বিয়ের সব অনুষ্ঠান শেষ করে বাসায় ফেরার। ফুপুর বাসায় গিয়ে জানা গেল আমার ফুপাত ভাইয়ের বিয়ে হচ্ছে একটা বাচ্চা মেয়ের সাথে!বয়স হবে ১৪-১৫,পড়ছে ক্লাস এইটে। অবশ্য বিয়ে ঠিক হয় এত অল্প সময়ের ভেতরে যে আমাদের পরিবারের কারোরই তেমন কিছু জানার সুযোগ ঘটেনি। সুতরাং,আমরা বলতে গেলে অন্ধকারের মদ্ধে ছিলাম।

গ্রামে এই ধরনের ঘটনা ঘটে অহরহ,সুতরাং তাজ্জব হওয়ার মত কিছু নয়। কিন্তু আমার কাছে খুব খটকা লাগলো ব্যাপারটা। মনে মনে খুব পীড়িত হচ্ছিলাম। এই রকম একটা ঘটনার নীরব সাক্ষী হব আমি?মন থেকে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছিলাম না। যাই হোক,যথাসময়ে বরযাত্রী গেলাম আমরা।

একই গ্রামে অনতিদূরে মেয়েদের বাড়ি,পায়ে হেঁটেই গেল সবাই। শুধু বরের জন্য ছিল প্রাইভেটকারের ব্যবস্থা!যথাসময়ে ভোজনপর্ব শুরু হলো। এরই মধ্যে আমি বউকে দেখে এসেছি একবার। খুব সাজানো গোছানো একটা কচি মেয়ের অসহায়-ক্লান্ত মায়াবি মুখ ভেসে উঠেছিল আমার চোখের সামনে। মেয়েটা ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল নিচের দিকে।

ওর বোবা চোখের চাহনিতে যেনো মিশে ছিলো ক্লান্তি আর বিষণ্নতার অবসাদ। এতটুকু কচি বয়সে ঘটনার মর্মার্থ উপলব্ধি করবার মত মানসিক পরিপক্বতা নেই তার,আর তাইত খুব স্বাভাবিক!তবু সে জানে,বিয়ের পর মেয়েদের বাপ-মা ছেড়ে থাকতে হয় শ্বশুরবাড়িতে। মাকে ছেড়ে যাবার নিদারুণ মর্মবেদনায় তার শিশুমন ভারাক্রান্ত। আর তাই গত দুইদিন শতচেষ্টাতেও মুখে একফোঁটা দানাপানি তোলেনি সে। বিয়ের কলমা পরার আগে কাবিনে স্বাক্ষর দেয়ার সময় নির্দ্বিধায় পুরোনাম লিখে দিলো মেয়েটা।

যেন দ্বিতীয়বার চিন্তাকরার মত সময় নেই তার। তাই বিয়ের কাজিও বলেই ফেললেন,মেয়েটা বোঝেইনি যে কিসে স্বাক্ষর দিতে যাচ্ছে!আর সেই বিয়ের নীরব সাক্ষী আমরা,জানতাম প্রতিবাদ করে বিয়ে ঠেকাতে পারবনা। তাই নিজের অসহায়ত্বকে মেনে নিয়ে হয়ে রইলাম বোবা সাক্ষী! আমাদের মত শিক্ষিত(!)লোকেরাই নিজেদের শিক্ষার যথার্থ প্রয়োগ ঘটাতে পারিনা ক্ষেত্রবিশেষে। তার কারণ,অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষা আমাদের মাঝে গতানুগতিক শিক্ষিত চিন্তাধারার অস্থিমজ্জা গড়ে তোলে,কিন্তু মর্মমূলে গিয়ে অনুভুতিপ্রবণ করে তুলতে ব্যর্থ হয়। পাশ করে ডিগ্রি অর্জনের শিক্ষাটুকু নিতে পেরেই আমরা যারপরনাই খুশি,তাই চোখের সামনে ঘটে যাওয়া বেআইনি আর অনৈতিক ঘটনাগুলো নির্বিকারচিত্তে মেনে নেই,অথচ সাহসী প্রতিবাদ করতে হই ব্যর্থ।

পৃথিবীব্যপি উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এখনো ব্যাপক হারে প্রচলিত আছে বাল্যবিবাহ। বর্তমানে পৃথিবীজুড়ে বিবাহিত কন্যাশিশুর সংখ্যা ৬০ মিলিয়নেরও বেশি(ICRW)। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এইসব দেশের মোট সংখ্যার অর্ধেক পরিমাণ মেয়েদের বিয়ে হয় শিশুবয়সে(১৮ এর নিচে)। আমাদের দেশে এই সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ। UN State of World’s Children এর মতে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ৬৪%।

যার মধ্যে ৫৮% ঘটে শহুরে এলাকায়,আর ৬৯% গ্রাম্য এলাকায়। বাংলাদেশের অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। এর পেছনের মূল কারণ হয়তো তাদের অসচেতনতা এবং বাল্যবিবাহের ক্ষতিকরদিকগুলো সম্পর্কে অজ্ঞতা। তাদের এই সীমিত জ্ঞানের দায়ভার শুধুই তাদের একার নয়। জীবনের মারাত্নক ঝুঁকিপূর্ণতার প্রতি অজ্ঞতা ও অসচেতনতা তৈরি হওয়ার পেছনে কাজ করছে তাদের অশিক্ষা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ ব্যবস্থা।

আর অশিক্ষিত এই জনগোষ্ঠীকে অজ্ঞতার হাত থেকে মুক্তি দিয়ে জীবন সম্পর্কে সচেতন করার দ্বায়িত্ব আমাদের মত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর উপরেও বর্তায়। তাই লেজগুটিয়ে বসে না থেকে প্রতিবাদের দৃঢ় চেতনা আর সংশোধণের প্রয়াস অর্জন করা একান্ত কাম্য। ওইদিন ফুফুর বাড়িতে মেয়েকে উঠিয়ে দেয়ার পর আমার আর কিছুই বলবার ছিলনা। শুধু রাতে বাসায় ফেরার আগে ফুফুকে বলেছিলাম,”মেয়েটাকে একটু দেখে রাইখেন।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।