আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আদালতের ভাষা



একটি সভ্য সমাজে আদালতকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করা হয়। নাগরিকদের শেষ আশ্রয়স্থল থাকে আদালত। প্রবল পরাক্রমশালীরা আদালতের কাছে নতি স্বীকার করে। এ জন্য আদালতও সব ধরণের বিতর্কের উর্দ্ধে থাকার চেষ্টা করেন এবং বিচারকগণ নিজেদের আবেগ, ক্ষোভ, অনুরাগ-বিরাগ পরিহার করে চলেন। আদালতকে আমরা সেভাবেই চিন্তা করি।

নীচের খবরে আদালত যে ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা কেমন হয়েছে আপনারাই বলুন: আবুল মকসুদের বিরুদ্ধে মামলা করতে রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিলেন হাইকোর্ট বিচারকদের জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার অভিযোগ লেখক, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদের বিরুদ্ধে আদালতের বিচারকদের জীবন ঝুঁঁকিপূর্ণ করে তোলার অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ। একই সাথে সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখায় রাষ্ট্রবিরোধী কোনো উপাদান আছে কি না তা খতিয়ে দেখতে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার এবং শাহবাগ থানার ওসিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দীন চৌধুরী ও বিচারপতি শেখ মো: জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখিতভাবে মহাস্খানগড়ের হজরত সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহীসওয়ারের মাজার মসজিদ সম্পর্কিত আদালতের নির্দেশ ও বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানানোর পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। সৈয়দ আবুল মকসুদকে আদালত অবমাননার অভিযোগে গতকাল সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আদালতে দাঁড় করে রাখা হয়। এ ছাড়া আগামী ১৩ মার্চ সৈয়দ আবুল মকসুদকে আবারো আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

গতকাল সকালে সৈয়দ আবুল মকসুদ আদালতে হাজির হলে আদালত গত বুধবারের ন্যায় তাকে তিরস্কার করেন। আদালত সৈয়দ আবুল মকসুদকে উদ্দেশ করে বলেন, তিনি রাষ্ট্র ও সমাজের একজন শত্রু। নির্বোধ একটি লোক, এত বড় আহম্মক গান্ধী কী লিখেছেন তার কিছুই পড়েনি। অশিক্ষিত লোক বুদ্ধিজীবীর পোশাক ধারণ করলে দেশের কী অবস্খা হবে। তিনি আবার কলাম লেখেন।

আমি গাফ্ফার চৌধুরী ও এ বি এম মূসাকে বলব আপনারা বিদায় নেন। এই তথাকথিত বুদ্ধিজীবী কী লিখেছে তা দেখতে হবে, ষড়যন্ত্র হয়েছে কি না। সে আগুন জ্বালাতে বলেছে, এ সরকারের পতন ঘটাতে বলেছে। আদালত অবমাননা এখানে মামুলী ব্যাপার। বড় পণ্ডিত।

বড় হরিদাস পাল। আমার কাছে দাবি জানাচ্ছে, আমাদের শেখাচ্ছে। হাসিও পায় কান্নাও আসে। একটা অশিক্ষিত, মূর্খ লোক থেকে আমাদের শিখতে হবে­ আমরা কী পারি আর কী পারি না। বছরের পর বছর ধরে আইন শিখে একটি অশিক্ষিত লোক থেকে শিখতে হবে।

দুই দিনের বৈরাগী ভাতেরে বলে অন্ন। এ পর্যায়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এম কে রহমান আদালতকে বলেন, আদালত মহাস্খানগড় রক্ষার জন্য আদেশ দেন। আদালত বলেন, সাংবাদিকদের কাছে আদেশের সার্টিফাইড কপি সরবরাহ করুন। আদালত মসজিদ ভাঙ্গার ব্যাপারে কোনো আদেশ দেননি। আদালত এম কে রহমানকে বলেন, এটি লিখতে তাকে কেউ বলেছে কি না জিজ্ঞাসা করুন।

তখন এম কে রহমান সৈয়দ আবুল মকসুদকে জিজ্ঞাসা করেন, আপনাকে কি কেউ লিখতে বলেছে। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, কেউ বলেনি। নিজেই লিখেছি। এ সময় গত ১৫ জানুয়ারির দৈনিক যুগান্তরের একটি রিপোর্ট এম কে রহমান মহাস্খানগড়ের প্রত্নসম্পদ রক্ষা করা সম্পর্কিত আদালতে আদেশ পড়ে শোনান। তখন আদালত বলেন, হি ইজ থরোলি ইল্লিটারেট ম্যান।

সে কতদূর লেখাপড়া করেছে জিজ্ঞাসা করুন। আমি মসজিদকে ঐতিহ্য বলেছি, সে বলেছে উল্টো। সে যুগান্তরের রিপোর্ট দেখাচ্ছে। সে কি মূর্খ লোক, বাংলাও কি বোঝে না। এ সময় সুপ্রিম কোর্টের প্রবীণ আইনজীবী ড. এম জহির আদালতকে বলেন, আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি।

তিনি একজন সৎ ও ইন্টেলেকচুয়াল মানুষ। তখন আদালত বলেন, তিনি চরম দায়িত্বজ্ঞানহীন। ড. এম জহির বলেন, মসজিদ ভাঙলে তো আগুন জ্বলবে? না ভাঙলে জ্বলবে না। তখন আদালত বলেন, তিনি আমাকে বলেছেন আপনি উপলব্ধি করতে পারেননি। শোনেন ড. জহির, অশিক্ষিত না হলে সে এটি লিখতে পারে।

সে আমাদের শেখাচ্ছে, আমরা কী পারি আর কী পারি না। তার এই লেখা সারা দেশে একটি বিদ্রোহ সৃষ্টি করতে পারত। একে আমরা ছাড়ব না তাকে জানতে হবে, আমরা কী করতে পারি। সে চায় দেশে আগুন জ্বলুক। তখন ড. এম জহির বলেন, এসব বললে তো অর্ডার দিয়ে দিচ্ছেন।

তখন আদালত বলেন, ড. জহির সে আমাদের লাইফ রিস্কে ফেলেছে। পাকিস্তানের একজন মন্ত্রীকে মৌলবাদীরা গুলি করে হত্যা করেছে। তাকে বলেন উকিল ধরতে, আমরা তাকে ছেড়ে দেবো না। এরপর বেলা ১টার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের বিশেষ অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত তাকে গতকালের মতো অব্যাহতি দিয়ে আবার হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। অন্য দিকে আদালত বৃহস্পতিবার সকালে এক নির্দেশনায় সৈয়দ আবুল মকসুদের লিখিত বক্তব্যের কপি পুলিশের কাছে প্রেরণের নির্দেশ দেন।

একই সাথে আদালত ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। একই সাথে সৈয়দ আবুল মকসুদ রাষ্ট্রবিরোধী কোনো ষড়যন্ত্রে লিপ্ত আছেন কি না, তদন্ত করে সে বিষয়ে ব্যবস্খা নেয়ার জন্য পুলিশের মহাপরিদর্শককে নির্দেশ দেন। তবে অ্যাটর্নি জেনারেলের অনুরোধে আদালত তার আগের আদেশ সংশোধন করে আদালতের (বিচারকদ্বয়ের) জীবন ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলার অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত সৈয়দ আবুল মকসুদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে কেন শাস্তিমূলক ব্যবস্খা গ্রহণ করা হবে না, মর্মে রুল নিশি জারি করেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ আদালত থেকে বের হয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, দেশের ক্ষতি করলে আমাকে জুতা মারুন।

কিন্তু এভাবে অপদস্ত হতে হবে? যে ভাষায় গালি দেয়া হলো, এত গালি এই শেষ বয়সে এসে শুনতে হলো? আমি অসুস্খ মানুষ, দাঁড়িয়ে থাকতে পারি না। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। শেষ বয়সে আমার ভাগ্যে এত কিছু ছিল কল্পনাও করিনি। উল্লেখ্য, গত বুধবার মহাস্খানগড়ের হজরত সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহীসওয়ারের মাজার মসজিদ সম্পর্কিত আদালতের বক্তব্য ও নির্দেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বক্তব্য রাখায় লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদকে তিরস্কার করেন হাইকোর্ট। আদালত বলেন, কোর্ট সম্পর্কে আপনার কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই।

লিখিত বক্তব্যে যা লিখেছেন তা আদালত অবমাননার শামিল। এটা আপনার দায়িত্ববোধের বাইরে লিখেছেন। আপনি একজন শিক্ষিত মানুষ। এ ধরনের একটি ভুল লেখনী আপনার মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে। আদালত একপর্যায়ে বলেন, একটা লোক নিজেকে বুদ্ধিজীবী মনে করে, এটা একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন বক্তব্য।

সৈয়দ আবুল মকসুদ আদালতে পেশ করা লিখিত বক্তব্যে বলেন, সীমাহীন উদ্বেগ ও বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করছি, ওই মামলার (মহাস্খানগড়ে প্রত্নতাত্ত্বিক স্খাপনা রক্ষা) শুনানিকালে এবং কয়েক দিন আগেও একই মামলার শুনানিতে আপনি (আদালত) মহাস্খানগড়ে হজরত সৈয়দ সুলতান মাহমুদ মাহীসওয়ারের মাজার প্রাঙ্গণের মসজিদটি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া যায় কি না, সে পরামর্শ চেয়েছেন জেলা প্রশাসকের কাছে। আদালত সাড়ে চার শ’ বছর আগের মাজারটি সরানোর কথা বলেননি। তিনি বলেন, মসজিদ হোক, মন্দির হোক, প্যাগোডা হোক বা গির্জা হোক, ভেঙে সরিয়ে নেয়ার ঘটনা উপমহাদেশে নেই। মাজার প্রাঙ্গণের শতাধিক বছরের পুরনো মসজিদটি প্রত্নসম্পদেরই অংশ। আপনার মতো বিজ্ঞ বিচারক এ কথা নিশ্চয়ই জানেন যে, পৃথিবীর কোনো দেশের আদালতই সব ব্যাপারে বক্তব্য দেয়ার অধিকার রাখে না।

যেমন­ কোনো দিন কোনো দেশের আদালত বলতে পারে না ধর্মনির্বিশেষে রাষ্ট্রের সব পুরুষকে খাতনা করতে হবে অথবা করার প্রয়োজন নেই। আপনি উপলব্ধি করতে পারেননি যে ওই প্রাচীন মসজিদ ভেঙে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে নতুন করে বানাতে উদ্যোগ নিলে গোটা বাংলাদেশের প্রতিটি জায়গায় আগুন জ্বলবে। সে আগুন নেভানোর সাধ্য কোনো সরকারের কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর থাকবে না। পরিণামে বিপুল ভোটে নির্বাচিত এই সরকারের পতন ঘটবে। শুধু তা-ই নয়, চিরকালের জন্য আওয়ামী লীগের ও মহাজোটের অন্যান্য শরিকদের রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে।

মসজিদ ভেঙে সরানোর কথা বলে আপনি ইসলামি মৌলবাদীদের হাতে একটি বড় অস্ত্র তুলে দিয়েছেন। অসাম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ার জন্য আমাদের মন্দির-মসজিদের ওপর আঘাত হানার প্রয়োজন পড়ে না। একজন নাগরিক হিসেবে আমি আপনার কাছে বিশেষ দাবি জানাচ্ছি আপনার ওই বক্তব্য ও নির্দেশ প্রত্যাহার করুন এবং দেশকে সম্ভাব্য ভয়াবহ বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করুন। সূত্র: Click This Link

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.