আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

খুনিদের দায়মুক্তি চলবেই?

রক্তের দাগ অনেকের হাতেই লেগে রয়েছে। হাত থেকে রক্তের দাগ ধুয়ে ফেলার অতি জরুরি প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। একনজরে দেখা যাক।

১.
ধসে পড়া রানা প্লাজার তৃতীয় ও চতুর্থ তলায় ২৩ এপ্রিল একটি স্তম্ভের পলেস্তারা মড়মড় করে খসে পড়ে এবং বিম ও দেয়ালের সংযোগস্থলে এক জায়গায় ফাটল দেখা দেয়। সেদিনই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কবীর হোসেন সরদার ভবনটি পরিদর্শন করেছিলেন।

কিন্তু তিনি ভবন ধসে পড়ার কোনো কারণ দেখতে পাননি, তাই ভবনটিতে মানুষের প্রবেশ রোধ করতে কোনো ব্যবস্থাও নেননি। এখন তদন্ত করে ‘দায়ীদের’ বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে তিনি সাংবাদিকদের আশ্বস্ত করেছেন। আমিন!

২.
ভবনটির তৃতীয় থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত পাঁচটি পোশাক কারখানা ছিল। মরেছেন বেশি এগুলোর শ্রমিকেরাই। এসব কারখানার মালিক চারজন—মাহবুবুর রহমান তাপস, বজলুস সামাদ আদনান, মো. আমিনুল ইসলাম ও মো. আনিসুর রহমান।

এঁদের নিশ্চয় মাল পাঠানোর তাড়া ছিল। তাই পরদিন শ্রমিকদের ডেকে এনে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানায় জোর করে ঢুকিয়ে কাজ করাতে এঁরা বাধ্য হয়েছেন। আমিন!

৩.
রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ আশ্বস্ত করেছে, কারখানাগুলোর কর্মপরিবেশ মানসম্মত ছিল। তা ছাড়া, বিজিএমইএ নাকি আগের দিন কর্মকর্তা দল পাঠিয়ে ভবনটি পরীক্ষা করিয়ে ওই মালিকদের মৌখিকভাবে কারখানা বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছিল। অচিরেই বিজিএমইএ বিশেষজ্ঞদের এনে ভবনটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাত।

কিন্তু ভবনটি তার আগেই তড়িঘড়ি ভেঙে পড়ল। তবে বিজিএমইএ এখন আহত ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা, পর্যবেক্ষণ, পুনর্বাসন—সবই দেখভাল করছে। আমিন!

৪.
দুর্বল ভিত্তির ওপর ফাঁকিবাজি করে নির্মিত ভবনটির মালিক স্থানীয় যুবলীগের নেতা সোহেল রানা। তিনি সরকারদলীয় সাংসদের ডানহাত, সরকারি দলের সাদা বা নোংরা কাজগুলো সারার হাতিয়ার। ধসের মুহূর্তে তিনি নিজেও নাকি ভবনের ভেতরে তাঁর অফিসে থেকে হরতালবিরোধী মিছিলের লোক গোছাচ্ছিলেন।

তিনি সম্ভবত জীবিত উদ্ধার হয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছেন। আমিন!

৫.
সোহেল রানা বালু ফেলে ডোবা ভরে ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল অবধি তিন বছর ধরে ‘রানা প্লাজা’ বানিয়েছিলেন, সবার চোখের সামনে। অনুমতি দেওয়ার কথা ছিল রাজউকের, কিন্তু সেটা দিয়েছিল সাভার পৌর কর্তৃপক্ষ। রাজউকের জ্ঞানচক্ষু খুলেছে ভবনটি ধসে পড়ার পর। তারা ইমারত নির্মাণ আইনে ভবনমালিকের বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

আমিন!

৬.
সাংবাদিকেরা আগের দিন ফাটল দেখে এসেছেন। তাঁরা এখন বিপর্যয়ের তথ্য সংগ্রহ করছেন, ছবি তুলছেন, মর্মস্পর্শী কাহিনিগুলো দেশবাসীকে জানাচ্ছেন। দুর্ঘটনার আশঙ্কা বা ভবন নির্মাণের অনিয়মের কথা আরও আগে মানুষকে জানানো দরকার ছিল? কিন্তু এমন শত শত দৃষ্টান্তের এই দেশে সাংবাদিকেরা তেমন নজরদারির কাজ কীভাবে করবেন? স্পেকট্রাম, তাজরীন ইত্যাদি ইত্যাদি ঘটনার বিচার ও শাস্তির ঘাটতি তাঁরা লেগে থেকে অনুসন্ধান করছেন না? কীভাবে তাঁরা তা করবেন, যখন এক ঘটনার জের শেষ হতে না হতে হাজারো অন্য ঘটনা হাজির হয়ে যায়। তা ছাড়া, রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতির বড় চালিকাশক্তি। সোনার ডিম পাড়া মুরগিটিকে বাঁচিয়ে লিখতে হবে ‘বৃহত্তর স্বার্থে’।

অতএব আমিন!
ওপরের তালিকার কেউই এ হত্যাযজ্ঞের দায় এড়াতে পারেন না, কিন্তু বিচার ও শাস্তি ইনশাআল্লাহ্ এড়িয়ে যাবেন। সাংবাদিকদের দায়টা বিবেকের কাছে, এড়ানো সহজতর।
সুতরাং আরও দু-তিন দিন লাশ গোনা চলবে। তদন্ত ও মামলা হবে। কে কত ক্ষতিপূরণ দিচ্ছেন, সেটা জাহির করা হবে।

খুনি পোশাকশিল্প বাজার হারানোর জুজু দেখিয়ে কর্মফল ধামাচাপা দেবে। বিজিএমইএ খুনি মালিকদের বাঁচাবে। খুনি ভবনমালিক সরকারের আশ্রয়-প্রশ্রয় পাবেন। হত্যাযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া শ্রমিকেরা আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ কর্মস্থলে কাজে ঢুকবেন।
আর রাবিশের ফোকর গলে বেরিয়ে আসা পা? কাপড়ে ঢাকা লম্বা লাইনের নিচ দিয়ে বেরিয়ে থাকা সারি সারি পা? এগুলো তো মৃত না-মানুষের পা।

না-মানুষের মরার এত গোনাগুনতি হিসাবে কাজ কী?
অতএব, হত্যাযজ্ঞের দিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি শপথ নেবেন। বিজ্ঞ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাদুর চশমা এঁটে দেখতে পাবেন, মৌলবাদী ও বিএনপির ভাড়াটে লোকজন স্তম্ভ ঝাঁকি দিয়ে ভবনটি ভাঙছে। তিনি এ কথা বিবিসিকে জানাবেন। তাঁর এই অন্তর্দৃষ্টি হয়তো পোশাক খাতের বিরুদ্ধে নয়া ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জন্ম দেবে।
ঘেন্না ধরে গেছে।

নিজেদের ওপর, অর্থনীতির লোভী ও খুনি চালিকাশক্তির ওপর, রাষ্ট্রের ওপর। দায়মুক্তির নিশ্চিন্ত আরামে ‘সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার’ এই প্রতিযোগিতা আর কিছুতেই নেওয়া যাচ্ছে না।
কুর্রাতুল-আইন-তাহিমনা: সাংবাদিক। ।

সোর্স: http://www.prothom-alo.com     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.