আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

একটি বেড়াল এবং ভেঁজা জ্যোৎস্না…নীলাঞ্জনা নীলা

আনন্দবতী মেয়ে আমি হাওয়ায় উড়াই চুল,চোখের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ মনের ভেতর নীল ঘাসফুল মধ্যরাতে ঝনঝন করে ভেঙ্গে পড়লো কাঁচের প্লেট । বেড়ালটা নিজেই ভয় পেয়ে গেছে , আর তাই মিউ মিউ করে ডাক শুরু করলো । চৈতির ঘুম ভেঙ্গে গেছে , পুরো শরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার । বুঝলো যে লোডশেডিং । আজ অসম্ভব গরম পড়েছে ।

কার বাড়ীর বেড়াল কখন যে এসে ঢুকেছে ঘরে , বিরক্তি নিয়ে বিছানা থেকে নামলো । একে কি নিশ্চিন্তের শয্যা বলে , কে জানে ! তোষকের ভেতরে যে তুলো ছিলো তা একেবারে সমান , কাঠের সাথে মিশে গেছে । খুব ব্যথা করে পিঠে । আজ অব্দি একটি সংসার হলো না তার । তবে না হয়ে ভালোই হয়েছে , নিজের মতো করে জীবনটাকে যেভাবেই হোক সাজিয়ে তো নিয়েছে ! এরই মধ্যে আবারও বেড়ালের ডাক , “উফ কি যে জ্বালা ! দরজাটা যখন বন্ধ করে , একটু কি খেয়াল করবে না শুভ্র ?” নিজের মনেই কথাগুলো বললো ।

শুভ্র আর স্নিগ্ধ এই হলো তার সন্তান । শুভ্র একেবারে ওর বাবার মতো , আর তাই ভাবে না ওকে নিয়ে চৈতি । তবে স্নিগ্ধকে নিয়ে খুব চিন্তা । যদিও ছেলে , তাও ভাবে তার নিজের মতো জীবনটা যদি হয় ? মেয়ে চাইতো সবসময় আর যখন শুভ্র হলো তখন কি প্রার্থনা ! তবুও নিজেরই তো সন্তান । মনের চাওয়া এখানে বিফল হলেও খারাপ লাগে না ।

কষ্ট হয়না । কি অদ্ভূত , ভাবে চৈতি ! আর স্নিগ্ধ তো আসার আগেই নাম রেখে দেয়া স্নিগ্ধা । স্নিগ্ধ এখনও বলবে , “কি যে মেয়েলি নাম রেখেছো মা , বন্ধুরা ক্ষ্যাপায় স্নিগ্ধা বলে । ” আবারও বেড়ালটা ডাকছে , এই অন্ধকারে কোথায় খুঁজবে ? এতো রাতে যে দরজা খুলে দেবে ওটাকে বেড়ুবার জন্যে , সেটাও ভাবতে পারছে না । বেড়াল মোটেও সহ্য হয়না চৈতির ।

বেড়ালটাকে খুঁজতে হলে আগে মোমবাতি খুঁজতে হবে । কিন্তু সেসব কি আর গোছানো থাকে ? তবুও হাতড়ে হাতড়ে পেয়েই গেলো । এখন খোঁজো দিয়াশলাই । একদিক থেকে শান্তি কোনো ছেলেই সিগারেট খায়না । অবশ্য স্নিগ্ধকে দিয়ে সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না ।

রান্নাঘরে যেতেই আবার সেই মিউ ডাক । “তার মানে আপনি এখানে বেড়াল মশায় ? আরে মেয়েও তো হতে পারে ! এই যা তো , কি শুরু করেছিস ? ঘুম তো দিলি ভাঙ্গিয়ে । ” এই একা একা কথা বলার অভ্যেসটা এখনও গেলো না । মনে পড়ে মা বলতো , “একা একা কথা যে বলিস , জানিস অনেক একা হয়ে যাবি ?” কোথায় মা , আর কোথায় বাবা । এখন তো নিজেরই বয়স হয়ে গেছে ঠিকই বুঝতে পারছে , তা নইলে কি এভাবে অন্ধকারে হাতড়ে বেড়ায় ? নাহ ছেলেগুলো যদি সিগারেট খেতো , ভালোই হতো মনে হয় এখন ।

শুভ্র যদিও এড়িয়ে চলে তার মাকে , স্নিগ্ধ ততোটাই আঁকড়ে ধরে আছে । একদিন বাসায় ঢুকতেই জিজ্ঞাসা করলো চৈতি , “এই কি রে তুই কি সিগারেট খাচ্ছিস ? গন্ধ পাচ্ছি কেন ?” অমনি স্নিগ্ধর উত্তর , “যা টাকা দাও হাত-খরচ , সেটা দিয়ে প্রেম করাই অসম্ভব হয়ে পড়ছে , তা আবার সিগারেট !” চৈতি কিছুক্ষণ গজগজ করতে থাকে এই যুগ আর এ সময়ের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে । অথচ একসময় চৈতি তার নিজের যুগের অনেক আগেই এগিয়ে গিয়েছিলো । অবাধ স্বাধীনতা মাঝে-মধ্যে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরী করে যে , তখন এমন কিছু ঘটে যায় জীবনে , যার জন্যে মৃত্যু পর্যন্ত বয়ে নিতে হয় সেই ভুলের বোঝা । তাই তো চৈতি নিজের বাবা-মায়ের মতো হয়নি ।

নিজের হাসিমাখা মুখটাকে রোজ আয়নায় নিয়ে দাঁড় করায় । এখন পর্যন্ত তো হেরে যায়নি । মন খারাপ হয়না যে তা নয় । সেসময় আকাশের দিকে চেয়ে আর গানের সাথে মিশিয়ে দেয় নিজেকে । অনেক আগে একদিন রেণুকে দেখেছিলো কাঁদতে আর তাও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ।

সেদিন বলেছিলো চৈতি , “রেণু চোখের জল আকাশের কাছে ঢালিস , আয়নার কাছে না । আয়নার সামনে নিজের হাসি-হাসি মুখটা দেখাস । দেখবি আনন্দ তোকে জড়িয়ে আছে সর্বক্ষণ । ” চৈতির খুব প্রিয় বান্ধবী রেণু । ওর কান্না ছিলো তার গন্তব্যে পৌঁছুতে পারেনি ।

যেখানে সবাই অসহ্য এবং বিরক্তিকর প্রেমের জন্যে চোখের জল ফেলে , সেখানে রেণুর কান্না স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছিলো প্রায় তখুনি বিয়ে । কি জানি কোথায় আছে এখন ! এবার আবার শব্দ । একেবারে হাতের কাছেই কি জানি পড়লো । কেন জানি মনে হচ্ছে মুড়ির টিন । “উফ এসব কি সহ্য হয় ?” সকালেই আবার ছুটতে হবে , কাল আবার অফিসে অডিট ।

এর মধ্যে সারা দেশে আন্দোলন হচ্ছে মানবতা বিরোধী রাজাকারদের ফাঁসি নিয়ে । ধর্মের নামে রাজনীতি যে কবে বন্ধ হবে ! একদিন গিয়েছিলো শাহবাগ । জীবনে একাত্তর দেখা হয়নি , আন্দোলন দেখেছিলো সেই স্বৈরাচারী এরশাদের সময়ে উনিশশো নব্বই সালে । মনে আছে মিছিলও করেছিলো চৈতি , গণতন্ত্র মুক্তি পাবার পর । সেদিন শাহবাগ যাবার পর ফিরে আসতে ইচ্ছে করেনি ।

নিজেকে যেনো একজন মুক্তিযোদ্ধা মনে হচ্ছিলো । সেদিন শ্লোগানও দিয়েছিলো । স্নিগ্ধকে বলেছিলো , “আমাকে নিয়ে যাবি ? খুব ইচ্ছে করছে রে যেতে । ” স্নিগ্ধ অবাক হয়ে বললো , “মা তুমি যেতে চাও ? আমি জানো তোমাকে ভয়ে বলিনি আমি না রোজ ওখানে যাই মা । ” চৈতি দু’ চোখ ভরে চেয়ে দেখছিলো স্নিগ্ধকে ।

এ কোন স্নিগ্ধ ! এতো বড়ো হয়ে গেছে ? এতো কিছু বোঝে তার সন্তান ? তারপর মা আর ছেলে দুজনে মিলে শাহবাগ । স্নিগ্ধকে দেখেই একটি মেয়ে ছুটে এসেছিলো , চৈতিকে লক্ষ্য করেনি । এসেই বললো “এতো দেরী কেন ? সেই কখন থেকে এসেছি ?” সাথে সাথেই স্নিগ্ধ বললো , “মা ওর নাম পিয়া । ” বুঝে গেলো চৈতি । মেয়ে তো হতভম্ব ! কি করবে বুঝতে পারছে না ।

তখন চৈতি নিজেই বলে উঠলো , “পিয়া বাসায় এসো , কেমন ? আমি শ্লোগান দেই কিছু সময় । ” ভালো লেগেছে পিয়াকে , নিষ্পাপ চেহারা । মিষ্টি মুখ । আর বেশ লাজুক । চৈতির একেবারে বিপরীত ।

নাহ একটা দিয়াশলাই কি কোথাও নেই ? চুলার পাশে নেই , যেখানে যেখানে থাকার কথা ছিলো সেখানেও নেই । গেলোটা কোথায় ? নাহ স্নিগ্ধটাকে ওঠাতে হবে । কেন জানি মনে হচ্ছে স্নিগ্ধ বোধ হয় সিগারেট খাওয়া শুরু করেছে । এই একটা জিনিস একেবারেই অপছন্দ চৈতির । এই সিগারেটের জন্যে অনেক কিছুই হারিয়েছে চৈতি ।

খুব কষ্ট হচ্ছে । শুভ্র যখন পেটে ওটাকে দেখার কি ইচ্ছে । কবে নিজের সন্তানের মুখ দেখতে পাবে এমন প্রতীক্ষায় যে কি আনন্দ ! তখন মা বলেছিলো , “চৈতি পেটে আছে ওটার চেয়ে আর কোনো শান্তি নেই রে । যখনই আলো-হাওয়া লাগবে সেই থেকে যে চিন্তা শুরু হবে , মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুক্তি নেই । কি জানি মৃত্যুর পরেও হয় কিনা !” ধ্যৎ এতো ভাবনার কি আছে ? এমন কিছুই না ।

অনেক ছেলেই সিগারেট খায় , নিজেকে আবার স্বান্তনা দেয় । কিন্তু তখুনি মনে পড়ে যায় নিজের জীবন । বিড়বিড় করতে থাকে চৈতি , “যেনো এমন না হয় হে ঈশ্বর । ” অনেকক্ষণ ওই অন্ধকারে দাঁড়িয়ে রইলো । হঠাৎ পেছন থেকে কেউ যেনো জড়িয়ে ধরেছে , “মা কি খুঁজছো ? দিয়াশলাই ? আমি নিয়ে গিয়েছিলাম আজ সাথে করে ।

মোমবাতি প্রজ্জ্বলন ছিলো আজ শাহবাগে । স্যরি মা , এমন আর হবে না । সকালে উঠেই নিয়ে আসবো দোকানে গিয়ে , ঠিক আছে ?” আবার বেড়ালের ডাক খুব ভালো লাগছে চৈতির সেই ডাকটা । কি জানি বেড়ালটা হয়তো তার বাচ্চাকে খুঁজছে , নয়তো বাচ্চা বেড়ালটা তার মাকে । এই অসম্ভব গরমের মধ্যেও এতো শীতলতা ! আর ঘন অন্ধকারের ভেতর দিয়ে এতো আলো আলোকিত করেছে সারাটি ঘর ।

ছোট্ট একটা ভ্যান্টিলেটরের ফাঁক দিয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে জ্যোৎস্নার আলো আর ভিঁজিয়ে দিচ্ছে চৈতির সমস্ত মন । হ্যামিল্টন , কানাডা ২৫ ফেব্রুয়ারী , ২০১৩ ইং । ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.