আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সর্বস্তরে বাংলা কখনোই হয়নি, হচ্ছে না

সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বৃটিশের ভারত থেকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই তৎকালীন পাকিস্তানের শাসকগণ বাঙ্গালি ও বাংলা ভাষার প্রতি ক্রমগত ঘৃণা প্রদর্শন করে যাচ্ছিল। বাংলা যেন তাদের কাছে অস্পর্শ হিন্দুয়ানি ভাষা। তাদের মনোভাব ছিল বাঙ্গালি আবার কিসের মুসলমান। বাঙলা কিছুতেই মুসলমানদের ভাষা হতে পারে না।

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্নে আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব দেন। এরপর জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন- উর্দু এন্ড উর্দু এলোন মাস্ট বি দি স্ট্যাট ল্যাঙ্গুয়েজ অব পাকিস্তান। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে স্বয়ং জিন্নাহর সন্মুখে ছাত্ররা প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। জিন্নাহ সে সময় থেমে গেলেও ষড়যন্ত্রের নীল নকশা বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া চলছিল। বর্তমান শিল্পপতি সালমান এফ রহমানের পিতা তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দু হরফে বাংলা লেখার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।

আন্দোলনের মুখে সে পরিকরল্পনাও ভেস্তে যায়। ছাত্রদের অন্যতম দাবি বাঙলাকে উর্দুর সম-মর্যাদা দান, খাজা নাজিমুদ্দিন মুখে মেনে নিলেও বিশ্বাস ঘাতকতা করেন। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি ঢাকার এক জনসভায় ঘোষণা করেন, পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দ। এরপরে ছাত্ররা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্র“য়ারি হরতাল আহবান করেন। আর কুখাত নুরুল আমীন দমননীতি গ্রহণ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।

ছাত্ররা মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেলে সরকারি হুকুমে পুলিশ গুলিবর্ষন করে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনে শহীদ বরকত, সফিক, রফিক, সালাম, জব্বার, আওয়ালসহ আরো অনেকে। এভাবেই জন্ম নেয় অবিস্মরণীয় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্র“য়ারির। ভাষা নিয়ে এদেশের মানুষের সমস্যা পাকিস্তানি আমলেই শুরু নয়, মুসলমানদের ভারত বিজয়ের পর থেকে দাপ্তরিক কার্য ফার্সিতে সম্পাদিত হতো। এদেেশর লোকেরা অনেক পরিশ্রম করে ফার্সি শিখতে চেষ্টা করতো।

শিক্ষিত হওয়ার জন্য বাঙালির পক্ষে ফার্সি শেখা সহজসাধ্য ছিল না। ১৮৩৫ সালে ফার্সির পরিবর্তে ইংরেজি প্রচলন ঘটলে বাঙ্গালি একশত বার বছর ইংরেজি শেখার চেষ্টা করে। চেষ্টায় হিন্দুরা একটু বেশি আর মুসলমানরা একটু কম তৎপর ছিল। ১৯৪৭ এ ইংরেজরা বিদায় নিলে আবার চাপে উর্দু। ১৯৭১ সালে এদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সারা পাকিস্তানে উর্দুই অধিকতর দাপটে ছিল।

১৯৭১ এর পর থেকে চেপে ধরেছে ইংরেজি। স্বাধীনতার পর থেকে ৪০ বছর আমরা ইংরেজি শেখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। এখন ইংরেজি শেখার চেয়ে মহৎ কোন কাজ নেই আমাদের। ইংরেজি শেখার মধ্যেই যেন পৃথিবীর তাবৎ জ্ঞান নিহিত রয়েছে। যেন ইংরেজি শিখলেই গণিত শেখা হবে, বিজ্ঞান শেখা হবে, সমাজ শেখা হবে, ভূগোল শেখা হবে, পরিবেশ শেখ হবে।

যারা ইংরেজি শেখেন তারাতো শুধু ইংরেজি বলতে, পড়তে ও লিখতে শিখেন। এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠাগুলোতে চাকুরি করতে গেলে দক্ষতা, জ্ঞান ও মনোভাবের চেয়ে তারা যাচাই করে প্রার্থী কতোটা ইংরেজি জানে। একজন ব্যাংকার, বীমাকর্মী, সরকারি কর্মকর্তা, এনজিও কর্মিকে কিজন্য ইংরেজি জানতে হবে? আমরা ইংরেজি শেখার জন্য চেষ্টা করতে গিয়ে যতটা সময় ব্যয় করেছি তার বিনিময়ে কি পেয়েছি ভেবে পাইনা। যদি ইংরেজি একেবারেই না জানতাম তাকে কি ক্ষতি হতো? জাপানি, ইতালিয়ানদের যদি ইংরজি শিখতে না হয় তবে আমাদের ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে এতো তোড়জোড় কেন? ইংরেজি শিখতে গিয়ে বহু ছাত্র-ছাত্রি অকালে ঝরে যায়। এসএসসিতে শিক্ষার্থিদের অকৃতকার্য হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ ইংরেজিতে অকৃতকার্য হওয়া।

ইংরেজি ভীতি কাটেিয় উঠা সহজ নয়। একজন সাধারণ ছাত্র ও একজন মেধাবি ছাত্রর ইংরেজি শেখার দক্ষতা সমান নয়। মেধাবিরেদর কাছে ইংরেজি শেখা সহজ। পরে প্রয়োজনীয় সময় ইংরেজি শিখে নিলেই যথেষ্ট। একজন ইংরেজি ভালভাবে শিখে যদি প্রয়োজনীয় বইপত্র বাংলায় অনুবাদ করে, তবে সকল শিক্ষার্থীদের জন্য তা অনেক সহজ হয়।

যদি এটা না করে সকল শিক্ষার্থীকে ইংরেজি শিখতে বাধ্য করা হয় তাহলে তার শেখাটা কখনোই পূর্ণঙ্গ হয় না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো আভ্যন্তরীণ চিঠিপত্রে যোগাযোগ ইংরেজি করতে আগ্রহী। ব্যাংকগুলোও চিঠিপত্র ইংরেজিতে লিখে। তাদের অনেক ফরম এখনো ইংরেজিতে। যেখানে গ্রাহণগণ টিপসহিও দেয়।

সবচেয়ে ইংরেজির দাপট দেখা যায় উচ্চ আদালতে। এসব ক্ষেত্রে ইংরেজিতে কেন কাজ করতে হবে? মানুষকে হয়রানি করা ছাড়া কোন কারণ থাকতে পারে না। উচ্চ আদালতে একটা আর্জি লিখলেও ইংরেজিতে লিখে। বিচারকগণ কি ইংল্যান্ড থেকে এসেছেন? আইন পাশ হয় সংসদে। সাংসদরা ও স্পীকার বাংলাদেশি।

অনেক সাংসদও রয়েছেন অল্প শিক্ষিত। বাংলায় পাশ করা আইন ইংরেজিতে পালন করতে হবে কেন? যেখানে বিচারক, উকিল ও মক্কেল সকলেই বাংলাদেশি। ধনীক শ্রেণীর কাছে ইংরেজি চর্চাটা একটা মানসিক বিষয়। ভিনদেশি মুসলিম শাসকদের সময়ে দেখেছি একটা শ্রেণী ফার্সির প্রতি ঝুঁকে পড়েছে, বৃটিশদের শাসনের সময়ে এ শ্রেণীটাই ঝুঁকেছিল ইংরেজির প্রতি, পাকিস্তানের সময়ে ঝুঁকেছিল উর্দুর প্রতি আর বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এই শ্রেণীটাই ঝঁকেছে ইংরেজির প্রতি। সাধারণ মানুষ প্রতিটা ক্ষেত্রে হয়েছে ক্ষতিগ্রস্থ।

ধনীক শ্রেণীর সন্তানদের জন্য ইংরেজি স্কুল রয়েছে। তারা অঢেল অর্থ সন্তানদের ইংরেজি শেখার পেছনে ব্যয় করে। সাধারণ মানুষের সন্তানদের অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে। স্বাধীন হওয়ার পরে সর্বস্তরে বাংলা চালুর বিষয়টি সকলেই চেয়েছি। কাগজে কলমে ঘোষণাও ছিল।

কিন্তু বাহাত্তরের সংবিধানটি প্রথমে রচিত হয়েছিল ইংরেজিতে, পরে রূপান্তর করা হয় বাংলায়। যারা সংবিধান রচনা করেছিলেন তারা কেউই ইংরেজ ছিলেন না। তাহলে পথম সংবিধানটি ইংরেজিতে কেন করা হল? ইংরেজিতে লেখা সংবিধানের তৃতীয় অনুচ্ছেদে লেখা চিল প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। প্রহসন আর কাকে বলে? প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে উচ্চ আদালতে বাংলার প্রচলন না থাকাটা সংবিধান পরিপন্থী কিনা আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রের বহু বিষয়ে ইংরেজি ঢুকে পড়েছে।

এ্যাডভোকেট, জর্জ, লীগ, পেডারেশন, ব্যলেন্সশীট, রোড, এভিনিউ, প্রেসিডেন্ট ইংত্যাদি অসংখ্য শব্দের বাংলা বিলুপ্ত হচ্ছে বাংলা শব্দ থাকা সত্বেও। এর মধ্যে প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রের প্রধান। তাঁর পদটিও ইংরেজি দখল করেছে। সর্বস্তরে ইংরেজি চালু হলে ক্ষতি কি? ক্ষতি তেমন নেই তবে লাভ অনেক। ইংরেজি শিখতে সময় ব্যয় করতে হয়, অর্থ ব্যয় করতে হয় যারা ইংরেজিতে দক্ষ নয় তাদের বোধগম্য নয় ইংরেজি ভাষা।

ইংরেজি শিখতে যতটা সময় অপচয় হয় সে সময়ে প্রয়োজনীয় কাগিরি বিষয়ে শেখা যায়। ইতিহাস শেখা যায়, সাহিত্য পড়া যায়। এতে অনেকের শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি ঘটে। ইংরেজি বলতে শিখলে মানুষের মননশীলতা ও সৃজনশীলতা বৃদ্ধি পায় না। মেধার বিকাশও হয় না।

অপ্রয়োজনে ইংরেজি শিখে লাভই বা কি? যাদের প্রয়োজন তারা ইংরেজি শিখে নিলেই হবে। ১৯৫২ সারের পরে আরো আটান্ন বছর পেরিয়েছে। বাংলা এখন গরিবের ভাষায় পরিনত হয়েছে। গরিবের ভাষা কখনোই সর্বস্তরের ভাষায় পরিণত হবে না। ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর সবচেয়ে সহজ প্রয়োজনীয় পথ হল, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা।

[মুজিব রহমান, সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.