আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ত্রিশ লক্ষ শহীদদের প্রশ্ন

Quazi Hassan’ World of Writings

"তুই" বাংলা ভাষার একটা অনবদ্য, অতুলনীয় শব্দ। একেবারে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যাকে ভালবাসা যায়, তাকেই শুধু তুই বলে ডাকা যায়। কিছু মানুষ এই শব্দকে তুচ্ছার্থে ব্যবহার করলেও, তুই র একটা অন্য রকম বিশেষ আবেদন আছে। আপনি হলো সম্মানের, তুমি হলো সাধারণ সম্বোধনের। আর তুই হলো একান্ত ভালবাসার।

একমাত্র খুবই ঘনিষ্ট বন্ধু অথবা খুবই প্রিয় মানুষরা এই পদবি পাওয়ার যোগ্যতা রাখে। আমার যে জীবন সঙ্গিনী তার সাথে আমার পরিচয় যুগ যুগান্তরের। হৃদয়ের সবটা নিংড়ে দিয়ে একে অপরকে তুই বলতাম। কিন্তু বিয়ের পরে পরিবার থেকে আপত্তি আসল, স্বামীকে তুই বলাটা যাবে না। যাই হোক, তুই পরবর্তিত হয়ে তুমি হলো।

অবশ্য এর সাথে সাথে একটা বাড়তি উপহারও আসল। নতুন একটা নাম পেলাম আমার সঙ্গিনীর থেকে, "ওগো"। সম্ভবত শব্দটা বাঙালী ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির ফসল। বিবাহিতা বাঙালি নারীর মুখ থেকে তা স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে বেরিয়ে আসে। অন্য ভাষা গুলোতে এর প্রতিশব্দ পাওয়া গেলেও, তুই শব্দের দোসর অন্য কোন ভাষায় একেবারেই বিরল।

বাংলা আর বাংলাদেশ নিয়ে আমাদের গর্বের শেষ নাই। ভাষার নামে আর কোনো কি দেশ পৃথিবীতে আছে? আমার জানা মতে নেই। কোন ভাষার জন্যে কি আর কোনো জাতি রক্ত দিয়েছে? বাংলা ভাষার জন্যে শুধু বাংলাদেশের বাঙালীরাই রক্ত দেয় নি , আসামের বাঙ্গালীরাও একই কারণে প্রাণ দিয়েছ। এই ভাষায় কি আছে, যে তার অবমাননা হলে মানুষ প্রাণ দিতে পর্যন্ত দ্বিধা করে না। তিরিশ লক্ষ প্রাণ যে দেশের মানচিত্রটা ছিনিয়ে আনলো, তার নামও হলো সেই ভাষার নামে "বাংলাদেশ"।

যেই ভাষা তার চারিদিকের সবুজ শ্যামল বনানী, নীল আকাশ আর বহমান নদীর মাঝের পরিবেশ থেকে উঠে এসেছে, যেই ভাষার সাথে তার প্রতিটা মানুষের আত্মার সম্পর্ক , যেই ভাষা তাদের সব গুলো অনুভূতিকে নির্ভিগ্নে কোমল করে বের করে আনে, যেই ভাষা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল আর জসিমুদ্দিনের পরিচয়, সেই ভাষার মানুষরা তাদের ভাষার আর তাদের মানচিত্রের অতন্দ্ররক্ষী হবে , তাই তো স্বাভাবিক। সেই শক্তিই তাদের বলীয়ান করেছে, জিন্নাহর মুখের উপর না বলতে, রাজপথকে বুকের তরতাজা রক্ত দিয়ে রাঙিয়ে বাংলা ভাষাকে তার যোগ্য জায়গায় বসাতে। তারপরে যখন হায়েনার আক্রমন এসেছে, ভাষা আর মানচিত্রের উপর, দ্বিধাহীন বাঙালি তা রুখে দাড়িয়েছে। আরো বিশাল ভাবে প্রমান করেছে বাংলা আর তার নামের দেশের জন্যে তারা যে কোনো মূল্য দিতে সব সময় প্রস্তুত। এই বাংলা ভাষায় আমার মায়ের আদর, এই বাংলা ভাষায় মাকে মাগো বলে জড়িয়ে ধরা, এই বাংলা ভাষায় আমার প্রিয়াকে তুই বলে কাছে টেনে নেয়া আর এই বাংলা ভাষাতেই আমার প্রিয়ার ওগো বলে সম্ভাষণ।

এই বাংলা আমার অস্থিত্ব, আমার বেচেঁ থাকার অহংকার। এই বাংলা আমার স্বপ্ন আর বাস্তবের মাধ্যম। এই বাংলা আমার পরিচয়। এত প্রচন্ড ভাবে ভাষা অন্য কোনো জাতির সাথে জড়িয়ে নাই। তার পরে আমাদের কাধেঁ আছে, যাদের রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীন দেশ আর ভাষা পেয়েছি, তাদের রক্তের ঋণ।

আমরা আজকে, পৃথিবীর যেখানে থেকে যাই করি না কেন, তাদের ত্যাগ ছাড়া আজকে আমরা তার থেকে অনেক, অনেক পিছিয়ে থাকতাম। বাংলায় কথা বলা, শুধু কথা বলা না, একটা সংস্কৃতিকে ধারণ করা। যেই সংস্কৃতিতে সংকীর্ণতা নাই, আছে প্রকৃতির মত বিশালতা। আর আছে মায়ের ভালবাসা। সমাজ আর দেশের জন্যে সৎ ভাবে জীবন যাপনের অঙ্গীকার।

মাকে, প্রেয়সীকে আপন করে না নিলে নিজেকে ভালবাসা যায় না। বাংলা ভাষা আর তার সংস্কৃতিকে থেকে বিছিন্ন হলে নিজেকে নিজের শেকর থেকে ছিড়ে ফেলা হয়। যারা ইংরেজী, হিন্দী, উর্দু ভাষা অকারণে ব্যবহার করেন, তাদের মনে যত বড় আত্মতুষ্টি থাকুক না কেন , তারা বাস্তবে নিজেকেই হেয় করছেন। তবে একথা বলা হচ্ছে না, আমরা অন্য ভাষা শিখব না। আমরা নিশ্চিত করব, আমাদের মানুষ যাতে বুক ফুলিয়ে, মাথা উচু করে বাংলায় কথা বলে।

সময়ের সাথে আমাদের ভাষার বিবর্তন হয়েছে এবং হবে, কিন্তু আমরা আমাদের মৌলিক গুনাবলী কখনই ছেড়ে দেব না। বাংলা ভাষায় কিছু বিদেশী শব্দের অনুপ্রবেশ তারই উদাহরণ। এখানে অকারণ বিতর্ক সৃষ্টির কোনো সুযোগ নাই। যারা অন্য ভাষার চটকদার কিছু গান, বাজনা রপ্ত করে চটুল কাজকর্ম করেন, তাদের বলছি ভেবে দেখুন আরেকবার। আমাদের শহীদদের রক্তের ঋণ শোধ করার দায়িত্ব আমার, আপনার ,সবার।

যারা অন্য ভাষার মানুষদের জীবন সঙ্গী করেছেন, তাদেরও একই কথা বলি। আমরা যদি পরের প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতিকে আর বাংলাদেশকে পৌছিয়ে দিয়ে না যাই, তা হলে সালাম, বরকত আর ত্রিশ লক্ষ শহীদদের কাছে আমাদের উত্তর কি হবে। বছরের একটা দিন ঘটা করে শহীদ মিনারে ফুল দেয়া, ছবি তোলা আর মাস জুড়ে বই মেলা করা কি তাদের ঋণের পূর্ণ শোধ হতে পারে ? ২১ শে ফেব্রুয়ারী, ২০১১


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।