আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদরে নদী শুকয়িে গলেো কমেন করে



নদীমাতৃক বাংলাদেশে জালের মতো বিস্তৃত নদীগুলোর দু’তীরের মানুষের জীবন আসলে নদীকেন্দ্রিক। প্রধানত উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবহমান এই নদীগুলোর অধিকাংশই এদেশে প্রবেশ করেছে ভারত থেকে। বলা হয়ে থাকে কমপক্ষে ৫৪টি নদী ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢুকেছে। যদিও শাখানদী-উপনদী নিয়ে তার সংখ্যা আসলে কয়েকশোর মতো। নদী নির্ভরশীল বাংলাদেশের এখন প্রধান সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছেÑ শুকনো মৌসুমে পানির স্বল্পতা এবং বর্ষা মৌসুমে জলাধিক্য ও নদীভাঙন।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর এদেশের অধিকাংশ মানুষের মধ্যে সরকারি-বেসরকারি নানা পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারের কারণে বিশ্বাস জšে§ যে, শুকনো মৌসুমে (শীতে) ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে এদেশের নদীগুলো শুকিয়ে ভরাট হয়ে নাব্যতা হারাচ্ছে, বিপরীত দিকে বর্ষা মৌসুমে ভারত তার পানি বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দিয়ে ভাটির এ দেশটিকে ডুবিয়ে মারছে। এ দেশের শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে কোটি কোটি মানুষ এই কথাগুলো বিশ্বাস করার কারণে তাদের বর্তমানে দুর্ভোগের জন্যে ভারতকে দায়ী করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। নদীসৃষ্ট আমাদের বর্ণিত দুর্ভোগ্যের জন্যে প্রকৃতপক্ষে ফারাক্কা তথা ভারত সত্যি কি দায়ী? না কেবলমাত্র প্রতিবেশী একটি বন্ধু রাষ্ট্রের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি ও তা টিকিয়ে রাখার এটি একটি ষড়যন্ত্র? বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করা যেতে পারে। এদেশে প্রবহমান নদীগুলোর প্রায় সবগুলোর উৎস ‘উজান’ তথা ভারতে এবং মোহনা তথা ‘মিলনস্থল’ বাংলাদেশে। যেমন গঙ্গার উৎস ‘গঙ্গোত্রী হিমবাহ’ এবং ব্রহ্মপুত্রের উৎস ‘মানস সরোবরে’।

নদীর ধর্মানুযায়ী নদী তার প্রবাহিত গতিপথে সব রকম বাধা ও অসমতা এড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায় এবং পর্যায়ক্রমে গতিবেগ হ্রাস পাওয়ায় আঁকাবাঁকা পথে প্রবাহিত হয়। সৃষ্ট সর্পিল বাঁকের কারণে ক্ষয়ক্রিয়া তথা ভাঙনের সৃষ্টি হয়। প্রথাগতভাবে নদীগুলোর জীবনকাল ‘যৌবন’, ‘পরিণত’ এবং ‘বার্ধক্য’ Ñএই তিন পর্যায়ে বিভক্ত। উৎসে নদীগুলো ‘যৌবন’দীপ্ত তথা খরস্রোতা থাকলেও বাংলাদেশে নদীগুলো মূলত তারুণ্য যৌবন হারিয়ে ‘পরিণত’ বয়সে এবং অনেক নদী কেবল ‘বার্ধক্যে’ এদেশে প্রবেশ করে বলে নাব্যতা হারায়। তাছাড়া এ অঞ্চল গঠনগত প্রকৃতি তথা নদীগুলো দক্ষিণমুখী, সর্পিল, চরোৎপাদি বা বিনুনি, সরলাকার, সূক্ষ্ম বালুকণাময় তলদেশ, নরম পলল গঠিত ভূমি, পরিমিত ঢাল, ভাঙনপ্রবণ তীর ও পরিবর্তনশীল নদী খাতজাত বৈশিষ্ট্যের কারণে উজান থেকে নদী ভাঙনজাত প্রায় ২.৪ বিলিয়ন টন মাটি-পলি বা উপজাত পদার্থ ভাটিতে নিয়ে এসে নতুন চরের সৃষ্টি করে, যে কারণে নদীগুলো চর সৃষ্টি হওয়ায় ভরাট হয় এবং বর্ষায় পানি প্রবাহ উপচে অকাল বন্যার সৃষ্টি করে।

এই নদীগুলো কেবল ভারত থেকে ২.৪ বিলিয়ন টন নরম মাটি-পলিই নিয়ে আসে না, বর্ষা মৌসুমে প্রবল জলস্রোতে অনেক নুড়িপাথর বহন করে, যা বাংলাদেশে সিলেটসহ বেশ ক’টি জেলায় সংগৃহীত হয় এবং এদেশের নির্মাণশিল্পে তা ব্যাপকভাবে ব্যবহƒত হয়, সে অর্থে নদী প্রবাহ কিছুটা উপকারও করে বটে। ফারাক্কা বাঁধের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলেও কিংবা বাঁধ নির্মাণের অনেক আগেই পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ধানসিঁড়ি, মধুমতি, কপোতাক্ষ, যশোরের ভৈরব, আপার মেঘনাসহ অনেক নদী নাব্যতা হারিয়ে প্রাকৃতিক কারণে এখন মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে ও সরকারি তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত ১০০ বছরে রাজশাহীর ১০টি নদীর মধ্যে ৯টিই এখন মৃত নদী। যশোরের ৮টি নদী, কুড়িগ্রামের ১২টি নদী মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছে। কিশোরগঞ্জ জেলার ৬টি নদী সংস্কারের অভাবে ভরাট হয়ে আবাদি জমিতে পরিণত হয়েছে।

গাইবান্ধার তিনটি প্রধান নদীতে শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদ হচ্ছে। পঞ্চগড়ে প্রবাহিত ২০টি নদীর মধ্যে ১০টি নদী, রংপুর জেলার ১০টি নদী ইতোমধ্যেই বিলুপ্ত হয়েছে। দিনাজপুর জেলার মৃত নদীর তালিকায় রয়েছে তিনটি নদী। কুমিল্লার তিনটি নদীর অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। বৃহত্তর বরিশাল জেলা থেকে হারিয়ে গেছে ৬টি নদী।

টাঙ্গাইল থেকে তিনটি, ফরিদপুর থেকে তিনটি, নড়াইল থেকে ৪টি নদী, কুড়িগ্রাম থেকে ১০টি, গাইবান্ধা থেকে তিনটি, মানিকগঞ্জ থেকে ২টি, খুলনার তিনটি, ঝিনাইদহের ২টি, বগুড়ার ৫টি, পাবনার ২টি, নেত্রকোনার ১২টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ২টি এবং সুনামগঞ্জের ১০টি নদী বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে প্রাকৃতিক কারণে। এছাড়া মাদারীপুর, চুয়াডাঙ্গা, জয়পুরহাট, শরিয়তপুর থেকেও একাধিক নদী বিলুপ্ত হয়েছে একই কারণে। এমনকি বৃহত্তর ঢাকা জেলার ওপর দিয়ে এক সময় ৩১টি নদ-নদী প্রবাহিত হতো। এর মধ্যে ১২টি নদী মজে গেছে কিংবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে বর্ণিত কারণে। এভাবে আমরা গত ১০০ বছরে হারিয়ে ফেলেছি ১০০-এর বেশি নদী।

হারিয়ে যাওয়া এই নদীগুলোর জন্যে কিন্তু ফারাক্কাকে দায়ী করার কোনো উপায় নেই। এর অধিকাংশ নদীর সঙ্গে ফারাক্কার কোনো যোগসূত্র ছিল না কিংবা নেই। তাহলে দেখা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের নদীর গঠনগত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নাব্যতা হারায়, ভাঙন ও চর সৃষ্টি হয় এবং বর্ষায় প্রবল জলপ্রবাহের কারণে বন্যা এবং শুকনো মৌসুমে প্রাকৃতিকভাবে কম জল প্রবাহের কারণে সকল নদীতে (কেবল গঙ্গায় নয়) নাব্যতা সঙ্কটের সৃষ্টি হয়। হ্যাঁ, যদিও শুকনো মৌসুমে ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে পানি প্রত্যাহারের কারণে গঙ্গা তথা পদ্মায় কম পানি আসে কিন্তু এটিই নাব্যতা সঙ্কটের জন্যে একমাত্র কারণ নয়। মনে রাখতে হবে, গঙ্গার পানি আমাদের যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন গঙ্গার তীরবর্তী ভারতের নাগরিকদেরও।

যাঁরা সড়কপথে ভুটান বা নেপাল ভ্রমণ করেছেন, তাঁরা দেখেছেন জলপাইগুড়ি বা কুচবিহার জেলার এমনকি ভুটানের ফুল্টসলিং এলাকার শুকনো নদীগুলো কিভাবে ২-৩ ইঞ্চি পানি নিয়ে চিক চিক করছে, সেতুগুলো ঠায় চরের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, মানুষ পায়ে হেঁটে নদী পার হচ্ছে। সে তুলনায় ভাটির দেশ হিসেবে আমরা কিছুটা ভালো অবস্থানে আছি। সে ক্ষেত্রে আমাদের উচিত হবে, বাস্তবতায় ফিরে এসে অযথা নদী সঙ্কটের জন্যে ভারতকে দায়ী না করে, সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে যৌথভাবে ড্রেজিং, জলাধার নির্মাণ, গতিপথ সহজীকরণ ইত্যাদির মহাপরিকল্পনা গ্রহণ ও উভয় দেশের নদীনির্ভর মানুষকে বাঁচানোর জন্য যৌথভাবে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ, যাতে নদীকেন্দ্রিক বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় মানুষই বাঁচতে পারে।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.