আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি...আসছে ভ্যালেন্টাইন...কিন্তু স্মরণে কি আছে...রক্তের অক্ষরে লেখা শহীদের নাম ভেসে গেছে ভ্যালেন্টাইনের জোয়ারে

প্রকৃতিকে করো তব দাস-চে দ্য আইডল (ব্লগার নং - ৩১৩৩৯)
ভ্যালেন্টাইন তুমি যেমন ভালোবেসেছিলে ওরাও বেসেছিলো ভালো গরীবের শিক্ষা কে অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা কে গণতন্ত্রের- সমাজতন্ত্রের শিক্ষা কে তাই রুখে দিতে বিকৃত মস্তিষ্কের শিক্ষানীতি ওরা ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছিলো বুক... তারপর গরম জল রায়ট কার তপ্ত বুলেট ঘাতক ট্রাক 'শুয়োরমুখো ট্রাক' 'লেফটেন্যান্ট জেনারেল ট্রাক' আর রক্ত! অনেক রক্ত! মগজমিশ্রিত জমাট রক্ত! ভ্যালেন্টাইন দিনটি ছিলো ফেব্রুয়ারির চৌদ্দ তুমি এসে কি চমৎকার ভুলিয়ে দিলে! তোমার বদ্ধ প্রকোষ্ঠের তীব্র প্রেমের জোয়ারে হারিয়ে গেল সেই রক্তাক্ত ইতিহাস হারিয়ে গেল জয়নাল-দীপালী-কাঞ্চনদের মুখ হারিয়ে গেল বাঙালির প্রেমোৎসব-পহেলা ফালগুন... (ভ্যালেন্টাইন...যখন ভালোবাসা পিছলে যায় রক্তে.../পাপতাড়ুয়া'কবিতার অংশবিশেষ) ১৯৮২ সালের ২৪শে মার্চ অবৈধপন্থায় ক্ষমতাদখল করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রথমেই গণগ্রেফতার ও নির্যাতনের মাধ্যমে দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোকে অসহায় বাধ্য করেন সামরিক শাসন মেনে নিতে। কিন্তু ছাত্ররা স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন গড়তে শুরু করে প্রথম থেকেই। সামরিক শাসন জারির প্রথম দিনেই বিক্ষোভ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রা। কলাভবনে একইদিন পোস্টার লাগাতে গিয়ে গ্রেফতার হন ছাত্রনেতা শিবলী কাইয়ুম,হাবিব ও আ.আলী। পরে সংক্ষিপ্ত সামরিক আদালতে তাঁদের প্রত্যেকের সাতবছর করে কারাদন্ড হয়।

সেই থেকে মূলতঃ সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের আন্দোলন ও সংগ্রাম শুরু হয়। সরকারি ফরমান ও তৎপরতার কারণে এই সময় সরাসরি রাজনৈতিক কর্মকান্ড প্রায় স্থগিত হয়ে পড়লেও ছাত্রদের স্বৈরাচারবিরোধী দেয়াল লিখন-পুলিশের মুছে ফেলা-পুনর্লিখন চলতে থাকে। এভাবেই ছাত্র রা দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠে। সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গঠন শুরু থেকেই বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন,ছাত্রলীগ,বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রী এককভাবে আন্দোলন চালিয়ে আসলেও সামরিকদমন ও নির্যাতনের সমান্তরালে এবং পূর্ববর্তী সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় কলুষিত ছাত্রদল ও সাম্প্রদায়িক শিবিরের ছাত্রস্বার্থ পরিপন্থী কর্মকান্ড ঠেকাতে একটি সর্বদলীয় আন্দোলনের প্ল্যাটফরম অপরিহার্য হয়ে উঠে। যার ফলাফলে গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ।

সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে স্বৈরাচারবিরোধী লিখিত বিবৃতি প্রদানের মধ্য দিয়ে যাত্রা করে এই পরিষদ। মজিদখান শিক্ষানীতি রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পরপরই এরশাদপ্রবর্তিত অধ্যাদেশ মোতাবেক তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মজিদ খান নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করেন। এরশাদ সরকার শুরু থেকেই ইসলাম ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার ও কলুষিত করছিলেন,যার প্রতিফলন শিক্ষানীতিতেও পড়ে। একই সঙ্গে শিক্ষার ব্যপক বাণিজ্যীকরণ করা হয় এবং শিক্ষাব্যয় বাড়ানোর সাথে সাথে শিক্ষাখাতে সরকারি ভর্তুকি ও কমিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ১৭ই সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবসে শিক্ষানীতি বাতিলের দাবি জানিয়ে শুরু হয় মজিদখান শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন।

সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ গণস্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান শুরু করে। সাথে চলে দেশের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জনমত গড়ে তোলার কাজ। ছাত্রদের এই কর্মকান্ড কে দমাতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ নেতা ও তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন সভাপতি খন্দকার মোহাম্মদ ফারুক কে গ্রেফতার করলে ছাত্ররা আরো ফুঁসে উঠে। ১৯৮৩ সালের ২৭ ও ২৮শে জানুয়ারি সারাদেশে ছাত্রধর্মঘট ও ১৪ই ফেব্রুয়ারি সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি দেয়া হয়। কি হয়েছিলো ১৪ই ফেব্রুয়ারি? ঘেরাও কর্মসূচির মিছিল সচিবালয় অভিমুখে যাত্রাপথে হাইকোর্ট গেট ও কার্জন হল এলাকায় ব্যারিকেডের সামনে পড়লে মিছিলের সম্মুখে থাকা শতাধিক ছাত্রী ও সাধারণ ছাত্র রা রাস্তায় বসে পড়ে এবং ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতা রা বক্তৃতা দেয়া শুরু করেন।

হঠাৎ ব্যারিকেড সরিয়ে সরকারি রায়ট কার মিছিলে গরম রঙিন পানি ছিটাতে শুরু করে,সাথে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ। ছাত্রদের পাল্টা ইট-পাটকেলের জবাবে পুলিশ গুলি করতে শুরু করে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হন জয়নাল নামের এক ছাত্র। পরে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে পুলিশ। একই সময় শিশু একাডেমীর অনুষ্ঠানে গুলি চালালে ঘটনাস্থলেই মারা যায় দীপালী সাহা নামের এক শিশু,যার লাশ পরবর্তীতে গুম করে ফেলা হয়।

এই সময় চট্টগ্রামে মিছিলে গুলি চালালে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান কাঞ্চন। পুলিশ সেদিন হত্যা করেই স্থির থাকে নি,পুরো ক্যাম্পাসে আর্মি-বিডিআর এক যুদ্ধপরিস্থিতির সৃষ্টি করে। অপরাজেয় বাংলার সমাবেশে হামলা ও ছাত্রনেতাদের গণগ্রেফতার,কলাভবন ও উপাচার্যের কার্যালয়ে হামলা,হলে হলে ঢুকে ছাত্রদের প্রহার ও গ্রেফতার। সেইদিন দুই সহস্রাধিক ছাত্র ছাত্রী,ঢাবি শিক্ষক আ খ ম জাহাঙ্গীর কে গ্রেফতার হন। ছাত্রদের আন্দোলনে উৎসাহ ও সহযোগিতা করার দায়ে গ্রেফতার হন অনেক জাতীয় নেতৃবৃন্দ।

পরে ১৯৮৩ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারি মজিদখান শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন স্তগিত ঘোষণা করা হয়। ভ্যালেন্টাইন ডে আমদানি কারস্বার্থে? বাঙালি আদিকাল থেকেই সংস্কৃতি,উৎসব ও প্রকৃতিপ্রিয়। অনেক আগ থেকেই পহেলা ফাল্গুন এই জনপদে বসন্তবরণ,ভালোবাসা ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছিলো। সেখানে নতুন করে ভ্যালেন্টাইন ডে আমদানি,তাও খোদ রক্তাক্ত ১৪ই ফেব্রুয়ারি তেই,কার স্বার্থে?মোটা দাগে দেখা যাক। ১. বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে আমদানি ও প্রচলনের মূল হোতা পাক্ষিক ম্যাগাজিন যায়যায়দিন(শুরুতে এবং বর্তমানে দৈনিক পত্রিকা),মাসিক মৌচাকে ঢিল (ম্যাগাজিন দুটি শুরু থেকেই মানহীন ও অশ্লীল লেখা ছাপিয়ে কুপরিচিত ছিলো) ও এইগুলোর সম্পাদক প্রকাশক শফিক রেহমান।

২. শফিক রেহমানের পত্রিকাটি এরশাদ সরকারের বিরোধিতার জন্য সেসময় নিষিদ্ধ হয়েছিলো। পরবর্তীতে সেই শফিক রেহমান ই এই রক্তাক্ত দিনটিতে ভ্যালেন্টাইন ডে প্রচলন করেন এবং প্রথম বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেন। কেন এই পরিবর্তন শফিক রেহমানের? বাঙলাদেশের সুবিধাবাদী রাজনীতির ধারায় এটা কোন গোপন চুক্তির ফল নয় তো? এখানে মনে রাখতে হবে, শফিক রেহমান কুখ্যাত সুবিধাবাদী নেতা,এরশাদের মন্ত্রীসভার প্রধানমন্ত্রীও উপ-রাষ্ট্রপতি , বিগত জোটসরকারের আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদের আশীর্বাদে অবৈধ প্রটোকল নিয়ে বিটিভি'তে লালগোলাপ নামক একটি অনুষ্ঠানের প্রযোজক ও উপস্থাপক ছিলেন। সন্দেহের তীর টা চলেই আসে! ৩.শোনা যায়, বিশ্বব্যপী শুভেচ্ছা কার্ড তৈরী প্রতিষ্ঠান আর্চিস ও হলমার্ক শফিক রেহমান কে বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে প্রচলনে আর্থিক সহায়তা প্রদান করে,বিনিময়ে এই দুইটি কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিশাল বাজার সুবিধা ভোগ করছে আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান ও সংস্কৃতি কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। দেখা যাচ্ছে,বাংলাদেশে ভ্যালেন্টাইন ডে প্রচলনে লাভ হয়েছে এরশাদদের,যাদের অপকর্ম ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ধার করে আনা উন্মাদনায়,লাভ হয়েছে আর্চিস-হলমার্কের,যাদের বাজার বিস্তৃত হয়েছে এই ব-দ্বীপেও,আর আমরা হারাচ্ছি দেশীয় অর্থ,সংস্কৃতি।

ক্ষতি হয়েছে বাঙালিয়ানার,পহেলা ফাল্গুন যখন নির্বাসিত একটি দিন। ক্ষতি হয়েছে বাংলাদেশের ইতিহাসের,যার একটি গুরুত্বপূর্ণ রক্তাক্ত অধ্যায় বিস্মৃত হতে চলেছে। কিন্তু সংস্কৃতির এই ক্ষতি,ইতিহাসের এই অচলাবস্থা আর কতকাল? তথ্যসূত্র: ১। রাজকূট,সংখ্যা ৭। ২।

আন্তর্জাল।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.