আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আসছে বাকশাল। আসছে ফ্যাসিজম..................

জগ বিএনপি নেতা ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের একটা কথা এসে বুকে তীরের মতো বিদ্ধ হলো। তিনি বলেছেন, ‘এই সরকার দেশকে পরিকল্পিতভাবে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ’ গত ১৭ ডিসেম্বর দেখলাম সহযোগী একটি দৈনিক এর ওপর একটি অনলাইন জরিপ চালিয়েছে। জরিপে অংশ নেন ১০০০ পাঠক। দেখা গেল, ৯৭.২ ভাগ পাঠক ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে একমত।

এদিকে গতকাল একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন প্রবীণ সাংবাদিক এবিএম মূসা। তার কথা, এই সরকার দেশকে দু’ভাগে ভাগ করেছে। সংঘর্ষ অনিবার্য। দুই নেত্রীকে সংলাপে বাসিয়েও আর লাভ হবে না। তাহলে বলতে হবে ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের মতো প্রবীণ-অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ কিংবা এবিএম মূসার মতো প্রাজ্ঞ সাংবাদিকই শুধু নন, সাধারণ মানুষের মধ্যেও একই ভয়।

অযুত-নিযুত উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা আর দুশ্চিন্তা। বর্তমান সরকার তাদের দুর্নীতি, দুঃশাসন, চুরি, ডাকাতি, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, গুম, খুন, ধর্ষণ, অপহরণ, দখল, চাঁদাবাজি, ঘৃণা, বিদ্বেষ, বিভেদ, হানাহানি, বিরোধী কণ্ঠ দলন, নিপীড়ন, জেল-জুলুম, হামলা, মামলা, নির্যাতনের মাধ্যমে দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে ১০ নম্বর মহা বিপদ সঙ্কেত। ঘরে-বাইরে কোথাও কেউ আজ নিরাপদ নয়। বিরোধী দলগুলোকে ঠেলতে ঠেলতে সরকার যেখানে নিয়ে গেছে, সেখান থেকে আর পেছানোর জায়গা নেই। সভা সমাবেশ মিটিং মিছিলের ওপর হামলা পরিণত হয়েছে নৈমিত্তিক ব্যাপাারে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাত্রলীগ ও যুবলীগকে মাঠে নামিয়েছেন প্রতিবাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করার কাজে। পুলিশ এখন স্রেফ দলীয় ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী। প্রশাসন পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপ। বিচার ব্যবস্থা মোটামুটি ভেঙে পড়েছে। জেলখানা খালি করে ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসীদের দেদারসে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

তারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর স্বজনহারাদের পরিবার-পরিজন বেড়াচ্ছেন পালিয়ে। দেশ নিরাপত্তাহীন। মানুষ নিরাপত্তাহীন। সঙ্গত কারণে ঘুম নেই কারও।

সরকারের নিয়ন্ত্রণহীন, বেপরোয়া, অসহিষ্ণু আচরণে পারদের কাঁটা চড় চড় উঠছে উপরে। এর মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রণহুঙ্কার, এ দেশ বঙ্গবন্ধুর ও তার কন্যা শেখ হাসিনার। তাদের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে তাদের এদেশে থাকার কোনো অধিকার নেই। সবচেয়ে বড় সমস্যা আগামী নির্বাচন নিয়ে। আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা বাতিল করে গায়ের জোরে পিটিয়ে, হাত-হাড্ডি ভেঙে বিরোধী দলগুলোকে ঠেলে তাদের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার জন্য সর্বশক্তি প্রয়োগ করছে।

বিরোধী দল তত্ত্বাবধায়ক ছাড়া নির্বাচনে যাবে না। সমাধানের কোনো আলামত কোথাও নেই। সব মিলিয়ে বোঝা যাচ্ছে, আসছে বাকশাল। আসছে ফ্যাসিজম। ফলে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য।

সরকার জোর করেই দেশকে নিয়ে যাচ্ছে গৃহযুদ্ধের দিকে। বাংলা অভিধানে গৃহযুদ্ধ সম্পর্কে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্ষমতা দখলের জন্য বা অন্য কারণে সংঘটিত সংঘর্ষ বা খণ্ডযুদ্ধই Civil war বা গৃহযুদ্ধ। এটি দীর্ঘস্থায়ী, ধ্বংসাত্মক, বর্ণবাদী ও রক্তক্ষয়ী হয়ে থাকে। পত্রিকার জরিপ অনুযায়ী পাঠকের আশঙ্কা মতো সেই ভয়াবহ দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে যদি সরকার বাংলাদেশকে নিয়ে যায়, যদি গৃহযুদ্ধ বাধে, যদি দেশজুড়ে বয়ে যায় রক্তগঙ্গা, যদি বাংলাদেশ পরিণত হয় সিয়েরা লিয়ন, রুয়ান্ডা কিংবা কঙ্গো কিংবা বসনিয়ায়, যদি নীল হেলমেট আসে, যদি আরেকটি পলাশীর পুনরাভিনয় হয়—তাহলে বলে রাখছি বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এদেশের মানুষ কোনোদিন ক্ষমা করবে না বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে। মানুষের অভিশাপ তাদের তাড়া করে ফিরবে জল-স্থল-অন্তরীক্ষে।

সেজন্যই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বেছে নিতে হবে তিনি কোন পথে যাবেন। গাদ্দাফি, আসাদের পথ, নাকি মাহাথির কিংবা ম্যান্ডেলার পথ? দুই. আমাদের অতি বাক্যবাগীশ আইন প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, হরতালের নামে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করবে, তাদের মির্জা আলমগীরের ভাগ্য বরণ করতে হবে। বানরে সঙ্গীত গায় শিলা ভাসে জলে! মেষের চামড়া গায়ে জড়িয়ে নেকড়ে ভাষণ দিচ্ছে বিশ্ব শান্তির। মীরজাফর আর ক্লাইভ নির্ধারণ করছে সিরাজউদদৌলার ভাগ্য। দস্যু বাচ্চাই সাক্কার দরবার শেখায় নীতিকথা।

কিছু দিন আগে আওয়ামী লীগের একজন তরুণ এমপি এক টিভি টকশোতে বলেছিলেন, বিএনপির সৌভাগ্য যে তারা মির্জা আলমগীরের মতো সুশিক্ষিত, পরিমার্জিত ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের একজন নেতাকে পেয়েছে মহাসচিব হিসেবে। আওয়ামী লীগের দুর্ভাগ্য, তাদের মধ্যে এমন কেউ নেই। সেই পরিচ্ছন্ন মানুষটিকে গালমন্দ করছে কে? কামরুল সাহেব। কামরুল সাহেব কে? বাংলাদেশের একজন প্রতিমন্ত্রী। তার অতীত ইতিহাস কী? ১৯৭১ সালে কোথায় ছিলেন? সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার পদে দাঁড়িয়ে কে গোহারা হেরেছিলেন? ডিবি ড্রাইভার জালালের মামলা থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল কেন? থাক এ প্রসঙ্গ।

কারণ সময় বড় ইতর হয়ে গেছে। সেজন্যই দাঁতে আধ কেজি ময়লা নিয়ে আরেকজনের দাঁত পরিষ্কারের মাজন বিক্রি করতে বাধে না কারও। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হরতালের আগে বলেছিলেন, দয়া করে কেউ দোকানপাট খুলবেন না। গাড়ি-ঘোড়া বের করবেন না। আমরা শান্তিপূর্ণভাবে হরতাল পালন করে দেখিয়ে দিতে চাই, এই সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা নেই।

দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে আমরা যাব না। এ ধরনের সভ্য, শোভন, রুচিশীল আবেদন তো আর কামরুল সাহেবদের কাছে আশা করা যায় না। তারা এর মর্মও বোঝেন না। তো গ্রেফতার করা হলো মির্জা আলমগীরকে। বলা হলো তিনি সিটি করপোরেশনের মামলা ফেলার ট্রাকে আগুন দিয়েছিলেন।

পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদকে অপরিচ্ছন্ন গাড়ি পোড়ানোর দায়ে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে জেলে। অসুস্থ মানুষটিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মৃত্যুর দিকে। এর আগেও একবার তাকে জেলে আটকিয়ে অপার আনন্দ উপভোগ করেছে শেখ হাসিনার সরকার। কী অদ্ভুত ব্যাপার! সুস্থতাকে পচিয়ে মারা হচ্ছে জেলে, আর অসুস্থতা ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বাইরে। পরিচ্ছন্ন মির্জা আলমগীর জেলে, আর শীর্ষ সন্ত্রাসী খুনি বিকাশরা বীর দর্পে ঘুরে বেড়াচ্ছে বাইরে।

তিন. জেলখানাগুলো ভরে ফেলা হচ্ছে রাজবন্দী দিয়ে। আর খুনি, ডাকাত, ধর্ষণকারী, চাঁদাবাজ, দখলবাজসহ ১ লাখ অপরাধীকে সরকার অব্যাহতি দিয়েছে জেলখানা ও মামলা থেকে। ঢাকাসহ দেশের ৬৬টি কারাগারে ধারণক্ষমতা ২৭ হাজার। সেখানে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীসহ আটকে রাখা হয়েছে ৭৪ হাজার বন্দী। সিরিজ ধরে কিলারদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।

বলা হচ্ছে কারাগারের চাপ কমানোর জন্যই তাদের ছাড়া হচ্ছে। অথচ নিরপরাধ রাজবন্দীরা মিথ্যা মামলায় ভোগ করছেন অসহনীয় নির্যাতন। দেশে সত্যি আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি বেসামাল। সরকারের বিগত ৪০ মাসে হত্যাকাণ্ড হয়েছে ১৩ হাজার, অপহরণ ১৩৫০, ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে ৫০০ জনকে, এরা কেউ বিচার পায়নি। গুপ্তহত্যার সংখ্যা ৮০।

অথচ রাষ্ট্রপতি তার ক্ষমতা ব্যবহার করে, একশ’ ভাগ দলীয় বিবেচনায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৩ খুনিকে ক্ষমা করে প্রকারান্তরে অন্য খুনিদের উত্সাহিত করেছেন। সন্ত্রাসীদের হাতে হাতে এখন লাইসেন্স করা অস্ত্র। গড়ে দেশে প্রতিদিন খুন হচ্ছে ১৫ জন। এক চট্টগ্রাম কারাগার থেকেই ছেড়ে দেয়া হয়েছে ১৪০ জন সন্ত্রাসীকে। নাটোরের উপজেলা চেয়ারম্যান সানাউল্লাহ নূর বাবুকে প্রকাশ্যে যারা পশুর মতো পিটিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে, সেই ২০ খুনি আজ জামিনে মুক্ত হয়ে পরিণত হয়েছে ‘আওয়ামী বীর’-এ।

সরকারি সার্কিট হাউসে তাদের ঘটা করে ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। আর বাবুর অসহায় স্ত্রী ও ছেলেমেয়েদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা হয়তো আর হবে না। আমিনবাজারে নিষ্পাপ ৬ তরুণ কোনোদিন বিচার পাবে না। নরসিংদীর মেয়র লোকমান হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত মন্ত্রীর ভাই-বেরাদর।

সেজন্য তারা আইনের আওতায় পড়বে না। বিশ্বজিত্ এদের মধ্যে একমাত্র ভাগ্যবান শহীদ, যার মৃত্যু নিয়ে নানা নাটক সাজানোর বিফল প্রয়াস শেষে ধরা হয়েছে কয়েজনকে। কিন্তু বিচার হবে না হয়তো। কারণ শোনা যাচ্ছে, বিশ্বজিতের শরীরে নাকি কোনো কোপানোর দাগই ছিল না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জ্ঞানী ম.খা. আলমগীর এর মধ্যেই বলে দিয়েছেন, পত্রিকার কাটিং আর টিভি ফুটেজ দেখে তো আর বিচার হবে না।

কাউকে অপরাধীও বলা যাবে না। হায় সেলুকাস! অ্যাডভোকেট নূরুল ইসলামকে খুন করে তার লাশ কেটে টুকরো টুকরো করে মেঘনা নদীতে ছড়িয়ে দিয়েছিল যে খুনি, সেই বিপ্লব (লক্ষ্মীপুরের গডফাদার আবু তাহেরের ছেলে) শুধু আওয়ামী লীগ করার সুযোগে আজ রেহাই পেয়েছে মৃত্যুদণ্ড থেকে। ১৮ বছরের জেল হয়েছিল আওয়ামী লীগ নেত্রী সাজেদা চৌধুরীর ছেলে শাহদাব আকবর লাবুর। তিনি পলাতক ছিলেন। তিনি ক্ষমার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে কোনো দরখাস্তও করেননি।

তারপরও আমাদের মহামহিম দয়ালু রাষ্ট্রপতি তাকে ক্ষমা করে দিয়েছেন। হাইকোর্ট পর্যন্ত এই ‘আওয়ামী ক্ষমা’র মচ্ছব দেখে তাজ্জব বনে গেছে। বলতে বাধ্য হয়েছে, এ ধরনের ক্ষমা আসলে স্বেচ্ছাচারিতা। এটা হলো ক্ষমতার অপব্যবহার। কারণ ক্ষমা প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো জেল কোড মানা হয়নি।

আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নেয়া হয়নি। ফলে এতে জনমনে আদালতের প্রতি অনাস্থা সৃষ্টি হবে। তারপরও খুনি সন্ত্রাসীরা ক্ষমা পেয়েই যাচ্ছে। জামিন পেয়েই যাচ্ছে। আর দেশের মানুষ বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে দেখছে এই তাণ্ডব।

ভিটেছাড়া হয়ে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো। এই অবস্থায় পদ্মা সেতুর আবুল, হলমার্কের মোদাচ্ছের কিংবা রেলের টাকার কালো বিড়াল সুরঞ্জিতের প্রসঙ্গ তুলে আর কি হবে! চার. ডিসেম্বর মাস বিজয়ের মাস। পরাধীনতা, জুলুম, নির্যাতন থেকে মুক্তির মাস। জাতিকে তার হৃত গৌরব ফিরিয়ে দেয়ার মাস। মুক্তিযোদ্ধা, সাধারণ মানুষ ও বুদ্ধিজীবীদের রক্তে ভেজা মাস।

সেই মাসে নারী নির্যাতনের এক মধ্যযুগীয় জঘন্য নজির স্থাপন করেছে সরকার। যা দেখে বিবেকশূন্য, অন্ধ, হিংস্র কতিপয় ‘মানুষ’ ছাড়া পুরো জাতি লজ্জায়, বেদনায়, ক্ষোভে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। বিজয় দিবসের এক দিন পর অর্থাত্ ১৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও রমনা থানা পুলিশ প্রায় দুই ঘণ্টার এক ‘বিশাল অভিযান’ চালিয়ে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে জামায়াতে ইসলামীর কারারুদ্ধ সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার স্ত্রী ও জামায়াতের মহিলা কর্মপরিষদের সদস্য মিসেস সানোয়ারা জাহানসহ ছাত্রী সংস্থার ২০ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। আটককৃত এই ছাত্রীরা সবাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের পর্দানশিন সন্তান। তাদের প্রায় সবাই মেধাবী।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ ও বুয়েটে পড়াশোনা করেন। ইসলামী ছাত্রী সংস্থা একটি বৈধ সংগঠন। নিষিদ্ধ কিংবা গোপন কোনো সংস্থা নয়। তারা প্রায় প্রতিদিন যেভাবে তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যায়, সেদিনও সেভাবেই গিয়েছিল। সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড নিয়ে আলাপ-আলোচনা, নৈতিক চরিত্র গঠনে তাদের কর্ম পদ্ধতি এবং সংগঠনটির ভাষায় ইসলামী দাওয়াত পরিচালনা বিষয় নিয়েই কথা বলছিল।

সেই সময় আমাদের ‘মহান’ সরকার ও তাদের পুলিশ বাহিনীর কাছে ‘গোপন সূত্রে’ খবর আসে যে ওখানে ছাত্রীরা অত্যন্ত বিপজ্জনক রাষ্ট্রবিরোধী ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে! রাষ্ট্রবিরোধী তত্পরতা বলে কথা! পুলিশ কী আর বসে থাকতে পারে! তারা বিশাল সশস্ত্র লটবহর নিয়ে, বন্দুক উঁচিয়ে হা রে রে করে ছুটে আসে। দেড় ঘণ্টা ধরে ঘিরে রাখে অফিসটি। তারপর বীরদর্পে নিরস্ত্র-নিরীহ, নিরপরাধ মেয়েগুলোকে ধরার জন্য ঢুকে পড়ে ভবনে। একেবারে যাকে বলে হাতেনাতে ধরে ফেলা! বিজয়গর্বে মদমত্ত হয়ে সরকারি মহল থেকে যেন বলা হলো, যাক বাবা এ যাত্রা দেশ বেঁচে গেল। নইলে তো গিয়েছিলাম আর কী! আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই বলেছেন, চিন্তা করেছেন বিষয়টা? জামায়াত কত ফ্রন্টে কাজ করে দেশকে জঙ্গিবাদী মৌলবাদী বানানোর চক্রান্ত করছিল? রমনার ওসি শাহ আলম বললেন, রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

এসি শিবলী নোমান জনালেন, থানায় এনে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছি। মিসেস সানোয়ারা জাহান ছিলেন নিজ বাসায়। হৈ চৈ শুনে বাইরে আসেন দেখতে, তিনিও গ্রেফতার হলেন। হাবিবা নাসরিন কান্তা ছিলেন ৫ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। তাকেও ছাড় দেয়নি পুলিশ।

কারণ তার পেট থেকে হয়তো বের হবে নতুন আরেক জঙ্গি! তারপর পুলিশ তছনছ করে সংস্থার কার্যালয়টি। ভেঙে ফেলে দরজা-জানালা। একটি কক্ষে বন্দী করে রাখে সবাইকে। তারপর এই নিরপরাধ ছাত্রীদের বেঁধে নিয়ে যায় থানায়। তারপর তাদের রমনা থানার হাজতখানায় গাদাগাদি করে আটকে রাখে।

অন্তঃসত্ত্বা কান্তা অসুস্থ হয়ে পড়েন। রাতভর তাদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। ১৮ ডিসেম্বর দুপুরে পুলিশ যেন দামামা বাজিয়ে তাদের নিয়ে যায় সিএমএম আদালতে। কান্তাসহ সবাইকে সিঁড়ি ভাঙতে বাধ্য করে তাদের তোলা হয় ৮ম তলার কোর্টে। এই যে পুরো প্রক্রিয়া, এতে একজন-দু’জন ছাড়া বাকি সবাই ছিলেন পুরুষ পুলিশ।

ভদ্র ঘরের পর্দানশিন মেয়েদের গায়ে হাত তুলেছে পুলিশ। টানা-হেঁচড়া করেছে তাদের নিয়ে। এ লজ্জা, এ ক্ষোভ রাখি কোথায়? মজার ব্যাপার হলো, রাষ্ট্রদ্রোহিতার ধুয়া তুলে যাদের গ্রেফতার করে এই হেনস্তা করা হলো, শেষ পর্যন্ত তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা করেছে ৫৪ ধারায়। অর্থাত্ কোনো কারণ ছাড়া শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার জন্য, নির্যাতন করার জন্য, বিরোধী কণ্ঠ দলনের জন্য। রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপবাদ দিয়ে গ্রেফতার করে যখন বুঝল এটা প্রমাণ করার মুরোদ তাদের নেই, তখন দায়ের করল ৫৪ ধারায় মামলা।

যা কিনা স্রেফ ‘সন্দেহ’ বোঝায়। পর্বতের মূষিক প্রসব! যে ধারায় কাউকে গ্রেফতার করা না গেলেও আমাদের পুলিশ ও আদালত হরদম তা করে যাচ্ছে। তো পুলিশ দাবি করল, আসামিরা গুরুতর অপরাধী। তাদের রিমান্ডে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা অতিব প্রয়োজন। অভিযুক্তদের আইনজীবীরা আদালতকে বললেন, আটককৃতরা সবাই ছাত্রী।

তাদের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের বইপত্র উদ্ধার করা হয়নি। তারা কোনো রাজনৈতিক সংগঠনের সদস্য নয়। তারা রিমান্ডে নেয়ার মতো কোনো কাজই করেনি। তাদের বিরুদ্ধে কোনো সুনির্দিষ্ট অভিযোগও নেই। তাদের অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে।

কেননা, প্রতিষ্ঠিত ছাত্রী হোস্টেলেই ছাত্রীরা বসে গল্প করে আড্ডা দেয়। তাই এদের গ্রেফতার করলে, রিমান্ডে দিলে কোনো ছাত্রী আর হোস্টেলে থাকতে পারবে না। আসামিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বিচারে বাধা দেয়ার কোনো ষড়যন্ত্র করার প্রশ্নই ওঠে না। তারা পর্দানশিন নারী শিক্ষার্থী। মুসলমান ধর্মের বিধান অনুযায়ী পর্দা করা আবশ্যক।

কেউ পর্দা মেনে চললেই যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষ অবলম্বন করে ষড়যন্ত্র করবে, এই অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। তাই এদের রিমান্ড মঞ্জুর না করে জামিন দেয়া হোক। কিন্তু চাইলেই তো সব পাওয়া যায় না। সে চাওয়া যদি মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে হয় কিংবা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধেও হয়, তবুও নয়। কারণ পুলিশ বলেছে তারা ভয়ানক।

কী ভয়ানক তা কিন্তু বলতে পারেনি পুলিশ। বলেছে রিমান্ডে নিয়ে জানতে হবে। অর্থাত্ এটা একেবারেই বাংলাদেশের প্রচলিত আইনের মানবাধিকারের, নারী অধিকারের সরাসরি লঙ্ঘন। কিন্তু কী করা, বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তারেক মইনুল ইসলাম ভূঁইয়া পুলিশের দাবি মোতাবেক, চাহিবা মাত্র দুই দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে এই মেয়েদের ওপর নির্যাতন চালানোর অনুমতি দিয়ে দিলেন। রিমান্ড শেষে আরেকজন বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তাদের জামিনের আবেদন বাতিল করে জেলে পাঠিয়েছেন।

এই দুটি অনুমতি দেয়ার সময় আমার বিশ্বাস তাদের নিজের স্ত্রী, মা কিংবা মেয়েদের কথা মনে পড়েনি। যদি তাদের নিজ সংসারের কথা মনে হতো তাহলে স্বাক্ষরের সময় তাদের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠত। তবে অন্তঃসত্ত্বা কান্তাকে তিনি রিমান্ড থেকে বাদ দিয়ে মানবিকতার এক মহা কীর্তি স্থাপন করে গেলেন। আর প্রমাণিত হলো, জামায়াত বা শিবিরের গন্ধ যদি থাকে, আর যদি ধর্মপ্রাণ কেউ হয়, তাহলে নারী হলেও তারা ‘মানুষ’ নয়, তাদের রিমান্ডে দেয়া যায়— তদুপরি পর্দানশিন হলে তো কথাই নেই। পাঁচ. জঙ্গিবাদ, মৌলবাদ, যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষাবলম্বন ও রাষ্ট্রবিরোধী জটিল কুটিল ষড়যন্ত্র করার বদনাম ছড়িয়ে, ঢাকঢোল পিটিয়ে যে ২১ জন মেয়েকে গ্রেফতার করেছে আমাদের পুলিশ, তাদের কাছ থেকে নাকি পাওয়া গেছে বিপুল পরিমাণ জেহাদি বই।

সাংবাদিকদের জিজ্ঞাসাবাদে নাস্তানাবুদ কর্তারা শেষ পর্যন্ত বলেছেন, বিপুল পরিমাণ ইসলামী বই, কোরআন শরীফ, হাদিস গ্রন্থ ও চারটি কম্পিউটার জব্দ করা হয়েছে। অর্থাত্ ইসলাম সংক্রান্ত বইপত্র পাওয়া গেছে তাদের কাছে। এর মধ্যে ষড়যন্ত্র কোথায়? রাষ্ট্রদ্রোহিতা কোথায়? নাশকতা কোথায়? ভয়ঙ্কর কিছু কোথায়? আর জেহাদ সম্পর্কে আমাদের মূর্খ কর্তারা বোঝে কী? মারামারি? খুনোখুনি? মিথ্যা অপবাদ দিয়ে কাউকে রিমান্ডে নিয়ে ঠ্যাং ভাঙা? ঘুষ খাওয়া? দুর্নীতি করা? খুন করা? ধর্ষণ করা? গায়ের জোরে অন্যের সম্পদ কেড়ে নেয়া? আমি নিজে এক অর্থে জন্মসূত্রে নামকাওয়াস্তে মুসলমান। পড়াশোনাও খুব বেশি নেই। ইসলাম নিয়ে কিছু বলাও আমার জন্য ঠিক নয়।

তবু যতটুকু জানি, জেহাদ শব্দের আভিধানিক অর্থ চেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায়, ধর্মযুদ্ধ, সত্কর্ম সাধনে প্রচেষ্টা ও অধ্যবসায়। কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা প্রভুর পথের দিকে আহ্বান কর প্রজ্ঞা ও সদুপদেশের মাধ্যমে এবং প্রকৃষ্টতর উপায়ে তাদের সঙ্গে বিতর্ক কর। ’ হাদিসে বলা হয়েছে, ‘অত্যাচারী শাসকের মুখের ওপর হক-কথা বলা, এটাই কঠিনতম জিহাদ। ’ কোরআন আরও বলছে, ‘নিশ্চয় নিজের মনের বিরুদ্ধে জেহাদ করাই শ্রেষ্ঠ জেহাদ। ’ হাদিসে আছে, ‘নফসকে দমন করাই সর্বোত্তম জেহাদ।

’ এখানে অন্যায়ের কী আছে? ভুল কী আছে? জিহাদ তো ইসলামের অন্যতম স্তম্ভ। যারা মুসলিম তারা যদি এই জিহাদের ওপর বইপত্র পড়ে, তবে তা রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ হবে কেন? ইসলামী বইপত্র পড়া অপরাধ হবে কেন? কোন কারণে? যদি সত্যি সত্যি আমাদের সরকার ও পুলিশের চোখে এসব ‘গর্হিত’ কাজ হয়ে থাকে তাহলে পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান, মূল গ্রন্থ, সবচেয়ে বড় জেহাদি গ্রন্থ আল-কোরআন পড়াও অপরাধ! রাষ্ট্রদ্রোহমূলক কাজ! যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের সরকার ও পুলিশকে বলব, পার্লামেন্টে তো আপনাদের ভয়াবহ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, আর পুলিশও যা খুশি তাই করতে পারে, এছাড়া আছে আপনাদের নিজস্ব খুনি বাহিনী; এত যখন ক্ষমতা আপনাদের হাতে, তাহলে আল কোরআনকে নিষিদ্ধ করে দিন। আমাদের সব মসজিদ-মাদরাসা বন্ধ করে দিন। নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত নিষিদ্ধ করে দিন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে ‘দেশরত্ন হাসিনা ফাউন্ডেশন’ বানিয়ে নিন।

হেজাব পরা বন্ধ করে দিন। দাড়ি রাখা, টুপি মাথায় দেয়া নিষিদ্ধ করে দিন। হজরত শাহজাহালের মাজার কামান দেগে গুঁড়িয়ে দিন। শাহ মখদুম, শাহ পরান, খান জাহান আলী, কেরামত আলীর মাজার গুঁড়িয়ে গড়ে তুলুন ‘বঙ্গবন্ধু মহিলা প্রচার কেন্দ্র’। ঈদগাহগুলোতে বড় বড় সুপার মার্কেট বানিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের ক্যাডারদের দান করুন।

কিশোরগঞ্জের সোলাকিয়া ময়দানকে রেসকোর্সে পরিণত করুন। সরকারি ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে হাঁস-মুরগির খামারে পরিণত করুন। যেখানে যেখানে ‘ইসলামী’ নাম পাবেন, সেটাই আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিন। আপনাদের নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের দ্বিতীয়বার আকিকা করে নাম থেকে ইসলাম খতম করে দিন। নূরুল ইসলাম নাহিদকেও এই কর্তন অপারেশন থেকে বাদ দেবেন না।

মজলুম জননেতা ভাসানীর নামের আগে মওলানা ছিল। তারও প্রয়োজনে মরণোত্তর বিচার করুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদকে জাদুঘর বানিয়ে উদ্বোধন করুন এসব ‘মহত্’ কাজের। পারবেন এই সব করতে? যদি তা না পারেন, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে অনুরোধ করবো—‘নন্দিত কর, নন্দিত কর, উদ্ধত তব শির’। ছয়. আগেই বলে রাখি শোনা কথা।

মওলানা ভাসানী একবার শেখ মুজিবকে বলেছিলেন, আমার কাগমারীর মওলানা মোহাম্মদ আলী কলেজটিকে সরকারিকরণ করে নাও। এটা স্বাধীনতার পরের কথা। জবাবে শেখ মুজিব নাকি বলেছিলেন, ‘হুজুর নিতে তো পারি। কিন্তু ওই পশ্চিমের মোহাম্মদ আলী টোহাম্মদ আলী এখন আর চলবে না। এখন সময় বদলে গেছে।

দেশ স্বাধীন হয়েছে। পশ্চিমমুখী খারাপ প্রবণতা আর কত? এবার পূর্বমুখী হতে হবে। এটা আপনার নামে হলে এখনই সরকারিকরণ করে দেব। মৃদু হেসে মওলানা ভাসানী বলেছিলেন—মজিবর, তুমি সেরেস্তাদার লুত্ফর রহমানের পোলা। এখন জাতির পিতা হয়েছো।

তুমি তো সবই পারো। তোমার কথাই তো আইন। তো পশ্চিমের যদি সবই খারাপ হয়, তাহলে এক কাজ কর—একটা আইন জারি করে আমাদের পশ্চিমের নবীও বাতিল করে দাও। একেবারে ঝামেলা চুকে যাবে। একথার জবাবে শেখ মুজিব কী বলেছিলেন আমি জানতে পারিনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.