আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যাযাবর সময় ১


সিংগাপুরের শেষ দিন গুলো এখনও মনে পরে। আমদের ফার্নিচার প্যাক করা শুরু হলো ২২শে নভেম্বর। সবার আগে প্যাক হলো আমাদের বেড। ২য় বেডরুমে ঘুমাতে গিয়ে ঘুমানো গেল না। একেতো বিছানাটা ছোট তার উপর নতুন বিছানা।

কোন ভাবে জেগে ঝিমিয়ে রাত পার করলাম। এভাবে চলল তিন দিন। ২৫ শে নভেম্বর প্যাক হলো বাকি সব কিছু আর কন্টেনারে চলেও গেল। বাড়ি খালি। নাই কোন প্লেট গ্লাস পর্যন্ত।

প্লাস্টিকের প্লেট, গ্লাস ও চামচ কিনে আনলাম। একটা পুরোনো হয়ে যাওয়া প্যান রেখেছিলাম ফেলে আসবার জন্য। সারাদিন পরে তাতে করে টিনের ট্যুনা দিয়ে প্যাস্তা বানালাম ডিনারের জন্য। ঐ পরিস্থতিতে সেই কোন মতে বানানো পাস্তা খেয়েও ক্লিফ তৃপ্তির ঢেকুর তুলল। ।

পরের দিনটা চলে গেল টুকি টাকি হাজারো কাজে। সন্ধ্যায় আবারো সেই প্যানে করে একটু চাল আর সব্জি দিয়ে এক ধরনের খিচুর বানালাম। বাইরে গিয়ে খাওয়ার মত শক্তি তখন দুজনের ছিল না সারা দিনের খাটনির পর। সেই কোন মতে বানানো খিচুরি তখন যেন স্বর্গের সুধার মতন গিললাম। রাতে ফ্লোরিং করে শুলাম শুধু মাত্র একটা পাতলা চাদরের উপর।

বহু দিন এমন শুধু শক্ত মেঝেতে শোয়া হয়নি। অভ্যাস না থাকলে যা হয়। সকালে পর্যন্ত পৌছাতে সারা গা ব্যথা হয়ে গেল ঘুম তো দুরের কথা। সেদিন আমরা ব্যংকক যাবো। চার পাঁচ দিন এই ঘুমের কষ্ট করতে করতে মন মেজাজ দুজনের ই খুবই বাজে।

তার উপর যে শহরে এত গুলো বছর কাটালাম সে শহর ছেরে অন্য কোন দেশে গিয়ে নতুন করে শুরু করবার ইমোশনটাও কাজ করছিল। তাই মন অপেক্ষা করে ছিল কখন ব্যংকক পৌছাব হোটেলে যাব আর একটা শান্তিতে ঘুমানোর মতন বিছানা পাবো। আমি আগে কখনও ব্যংকরে বা থাইল্যন্ডে যাই নাই। আমাদের ব্রিসবেনের ফ্লাইট ৩ রা ডিসেম্বর। আমাদের যেহেতু থাকবার কোন জায়গা নেই সিংগাপুরে সেহেতু আমারা ঠিক করলাম হোটেলে যখন থাকতেই হবে তখন ব্যংকক গিয়ে ক'টা দিন কাটিয়ে আসবো।

এতে সিংগাপুরে এক্সপেনসিভ হোটেলে থাকবার চাইতে কম খরচ হবে আবার আমার ব্যংকক দেখাও হবে। তবে ব্যংকক দেখবার চাইতে আমার মন ব্যকুল ভাবে একটা বিছানার জন্য অপেক্ষা করছিল ব্যংককে যেখানে ঘুমাতে পারব শান্তিতে। ক্লিফের ও একই অবস্থা। প্রথম দিন পৌছেই ঢুলু ঢুলু চোখে গেলাম ডিনার করতে। আহ এত ঝাল দেয়া খাবার যে খুবই কষ্ট হলো খেতে।

তবে তাতে কি বিছানা একটা তো পাবো ক্লিফের আমাকে একটু ঘুরিয়ে দেখাবার শখ ছিল কারন আমার প্রথাম ব্যংকক যাওয়া যদিও ক্লিফ কাজের জন্য প্রায়ই যায়। কিন্তু আমি পারলাম না ঘুরতে ক্লান্তিতে। হোটেলে ফিরেই নরম বিছানা পয়ে যেন হাতে স্বর্গের প্রশান্তি পেলাম। দু'মিনিটেই গভির ঘুমে কাত। ঠিক করলাম আমরা শুধু একটা টেম্পল দেখব।

কারন কেম্বডিয়া আর ভিয়েতনাম গিয়ে ঐ একই ধরনের এত টেম্পল দেখেছি যে টেম্পল দেখার ব্যপারে আমার আগ্রহ তেমন বেশি ছিল না। থাই ও কেম্বডিয়ান টেম্পলের মধ্যে পার্থাক্য হলো - থাই টেম্পলে গোল্ডেন কালারের কাজ বেশি আর কেম্বডিয়ান টেম্পল একই ডিজাইন কিন্তু গোল্ডেনের কাজ কম। বের হতেই দেখলাম পথের পাশে এক মেয়ে থাই স্যুপ রান্না করছে আর খাবার বিক্রি করছে। এখানে পথের পাশের এই খাবার গুলো যে এত মজা আর প্রচুর সব্জি দেয়া!! আর স্যাতে গুলো দেখলেই জিভে পানি চলে আসে!! মাছ থেকে শুরু করে বিফ, চিকেন এমন কি ব্যং পর্যন্ত আছে ওখানে। আর কি চমৎকার সব ডেজার্টের দোকান।

নানান রং এর ডেজার্ট সাজিয়ে বসে আসে, দেখলেই মুখে পানি চলে আসে। সবই এত সস্তা!! উমম সিংগাপুরের চাইতে অনেক সস্তা। শপিং মল গুলো ক্রিসমাসের জন্য বিভিন্ন রং এ সাজছে যে যেমন পারে। আমারা দুজন হেটে হেটে এসব দেখতে দেখতে চললাম। পথ চলতে চলতে কিছু দুর পরপরই একটা করে টেম্পল।

খুবই চমৎকার করে ছোট ছোট টেম্পল গুলো সাজান। আর ফুলে ফুলে ভরা। আবার কিছু দুর পর পর একটা করে মাঝারি টাইপের বড় টেম্পল যেখানে মানুষ জন সব সময়ই ভির করে হলি ওয়াটার নিচ্ছে বা যাষ্ট পার্থনা করতে আসছে। আমরা এমনই একটা টেম্পল দেখে ঢু মারলাম আগে। সর্বত্র সোনা রং আর ফুল।

নিজেও কিছু হলি ওয়াটার নিলাম মাথায়, বলাতো যায় না কোথা দিয়ে সৃষ্টি কর্তা কি ভাগ্য ফেলেন। আমাকে ভাগ্য দিতে তো উনকে একটা স্কোপ দিতে হবে, তা আমার স্ট্রাটেজি হলো "যেখানে দেখ ছাই উড়াইয়া দেখ তাই পাইলেও পাই্তে পারো অমুল্য রতন...." দিন শেষে আমরা সবাই ঐ একজনের কাছেই তো প্রার্থনা করি। যেখানে সেখানে চমৎকার ইন্টেরিয়র ও এক্সটেরিয়র করা ফুট ম্যাসাজের দোকান। রাস্তা গুলো দেখে মনে হলো এমন কি বেশি আমার দেশের চাইতে? আমাদের দেশটাও এমনই শুধু পার্থক্য এরা এদের সৌন্দর্য মেইনটেন করে, যত্ন করে, ধরে রাখে লালন পালন করে আমরা ধংস করি যা আছে তা। সুন্দরকে আমরা সুন্দর রাখিনা।

এখানেও একই রকম রাস্তার পাশে পুটপাথে অস্থায়ি দোকানিরা সস্তা পসরার দোকান সাজিয়ে বসেছে। দিনশেষে গুটিয়ে নিয়ে ঘরে চলে যায়। এই রাস্তা গুলোর সাথে আমাদের দেশের রাস্তা গুলো তুলনা করলে দেখা যাবে একই শুধু আমরা দের গুলো ভেঙে ফেলেছি আর নোঙড়া করে রেখেছি চির দিনের অভ্যাস মত। অবশেসে ট্যাক্সি নিলাম। সেই ট্যাক্সির ভেতরও আরেক দেবতা দঁাত মুখ কেলিয়ে আছেন।

গেলাম যে টেম্পলটায় বিশাল বুদ্ধা স্ট্াচুটা শুয়ে আছে। টেম্পলে ঢুকতেই দু'পাশে দুই দেবতা চোখমুখ কটকিয়ে দরাজায় পাহারা দিচ্ছে। ইচ্ছে করল ওর নাকটা টেনে দিয়ে রাগি রাগি মুখটা তে হাসি দিয়ে দেই। কিন্তু বেটা এতই লম্বা যে আমার নাগালের বাইরে ওর নাক। তাই সামনে আরেকটা ছোট দেবতাকে পেয়ে ওটারই নাক টিপে দিলাম হাসে নাকি দেখার জন্য ভেতোরে সোনার রং গায়ে মেখে বিশাল বুদ্ধা শুয়ে আছেন ধ্যানে।

কি চমৎকার সেই স্টাচুর কাজ!! দেয়ালে ও ছাদ জুরে চমৎকার সব সুক্ষ হাতের পেইনটিং। সেই পেইনটিং গুলো শুধুই ছবি নয় তবে ইতিহাসও। অসাধারন সোনা রং চারিদিকে আর ইতিহাস তার উপর গল্প বলে যাচ্ছে। বুদ্ধার পায়ের তালুতেও কি চমৎকার কাজ। যেন স্লেটের উর কেউ ইতিহাস লিখে গেছে।

যাদিকে তাকাই সোনার ঝিলিক দেখি। টেম্পেলের চুড়ায় বলুন আর শত শত বুদ্ধার স্ট্াচুতেই বলুন না কেন। চমৎকার কারিগরি হাতের কাজ সব গুলো গম্বুজে আর স্তুপা গুলোতে। টেম্পটা ঘুরে ঘুরে দেখতে গিয়ে আরেক শান্ত শিষ্ট দেবতা কে পেয়ে তার দাড়িতে হাত বুলিয়া একটু গল্প করে নেবার সাধটাও আর অপুর্না রাখলাম না এর পরেই দেখি এক ইংলিশ দেবতা। কি আশ্চর্য আগে কখনও তো এমন এক চোখ কানা ইংলিশ দেবতা দেখিনি এর পরে আরো কিছু স্তুপা ও গম্বুজ মত টেম্পল দেখলাম ঘুরে ঘুরে।

সোনা রং এর কি বাহার!! চোখ ধাঁধিয়ে যায় একেবারে। দেখা হলো চাঙ্কু বুড়ো বুড়ি আর কিছু টেম্পলের দোকানে ঘুরে সেদিনের মতন দিন শেষ করলাম। হোটেলে ফিরে গত কালের বহু কস্টের পরে সদ্য প্রাপ্ত বেডটা কে আরেকবার ছুয়ে দেখাবর জন্য মন ব্যকুল হলো। আহ ঘুমানো জন্য একটা বিছানা সৃষ্টি কর্তা ফাইনালি দিয়েছেন বলে কথা!!
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।