আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সত্য এবং জয় পরাজয়ের কষ্টকাব্য

ঝর্ণার পাশে বাড়ি/ জলের তেষ্টায় মরি/ জীবনের খেলাঘর/ বেঁধে যাই নিরন্তর।

মানব সৃষ্টির শরু থেকেই সত্য ও মিথ্যার পথ চলা শুরু। মিথ্যা সব সময় মহা আয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সত্য বিনাশে; ধ্বংসের হুংকারে নেভাত চায় সত্যের আলো। কিন্তু সত্য চরিদিনই আপন পথে অবিচল। নিঃশঙ্ক।

দুর্বার। সত্য কখনও নিজেই প্রমাণিত। কখনও মিথ্যার পাহাড় ডিঙ্গিয়ে তাকে প্রমাণ করতে হয়। অসুন্দর আছে বলেই সুন্দরের প্রকাশ। অন্ধকার আসার কারণেই আলোর অপেক্ষা।

ধ্বংসের জন্যই নির্মানের আকাঙ্ক্ষা। মিথ্যার জয়রথ থামাতেই সত্যের উন্মেষ। কষ্ট আছে তাই সুখের পিছু ছুটা। রাত এলেই দিনের প্রত্যাশা। বিরহ-ঘৃণা আছে বলেই ভালবাসার বেঁচে থাকা।

ঠিক তেমনি অসত্য আছে বলেই সত্য অমৃত। সত্য মধুর। সত্যই ধ্রুব। সত্যই সুন্দর। সত্যই চূড়ান্ত।

সত্যকে ধারণ করতে হয়। সত্য চায় ত্যাগ। সত্যকে চাইতে হয়। ভালবাসত হয়। হতে হয় সত্যসন্ধানী।

সত্যের পথ বন্ধুর। কণ্টকাকীর্ণ। জাকজমকহীন। নশ্বর চমকশুণ্য। অবিনশ্বর আরম্বরতায় পূর্ণ।

একাকাশ মেঘ চূড়ান্ত লড়াইয়ে একটা সূর্যের সাথে হেরে যায়। মিথ্যার সাজানো ধমক নিমিষেই পরাস্ত হয় এক চিলতে সত্যের আগমনে। হতাশার জমাট অন্ধকার ছিড়ে সত্য সহসাই বিজয়ীর বেশে উদ্ভাষিত হয় নব আনন্দে। মূহুর্তেই উধাও হয় জীবন অতিষ্ট করা মিথ্যার দুর্গন্ধ। জীবনে নেমে আসে স্বস্তির সমীরণ... বার্ষিক পরীক্ষার পনের দিন বাকি।

বোর্ডিংয়ের নিয়মে রাত দশটায় রুমের লাইট অফ। পড়তে হয় বারান্দায়। আমিও বসলাম। পড়তে পড়তে রাত দুইটা। আশপাশে কেউ নেই।

অজান্তেই মনে একটা ভয়ের শিহরন লাগে। বই-পত্র নিয় উঠি। কিন্তু কপাল খারাপ! ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। বেশি শব্দে ডাকা যাবনো। অন্যের ঘুমের ক্ষতি হবে।

অনেকেই আবার শেষ রাতে উঠে পড়বে। ওদের মেজাজ খারাপ হবে ঘুম ভাঙ্গলে। আমার অবস্থা করুণ। ভরা গ্রীষ্মেও কাঁপছে শরীর। দাঁতে দাঁত লেগে ঠক্ ঠক্ শব্দ হচ্ছে।

ভয়ে আতঙ্কে সিক্স পড়ুয়া আমি কাঁদি আর দরজায় নক করি। কাঁচের জানালা দিয়ে দেখি দু-একজন নড়া-ছড়া করছে। দরজা খুলছে না। মনে হয় ওরাই দরজা লক করেছে। বিপদের সময় নাকি ভয়ের সব কথা মনে পড়ে।

আমারও মনে হল বোর্ডিয়ে নাকি জ্বীন থাকে। জ্বীনের কথা মনে হতেই উত্তেজনা আর ভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠি। কান্নার শব্দে হযরত আলী ওঠে। দরজা খোলে দেয়। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচি।

গোল বাঁধল সকালে। হোস্টেল সুপার তলব দিলেন। বললেন, রাতে নাকি আমি সিনেমা দেখে এসে দরজা বন্ধ থাকায় সবার মা-বাপ মিয়ে আজেবাজে গালিগালাজ করেছি। জুহরের পর মসজিদে বিচার হবে। আমি সব অভিযোগ দৃঢ় অথচ বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করলাম।

সত্য ঘটনাও খুলে বললাম। হোস্টেল সুপার বললেন, তোর সম্পর্কে এমন একটা অভিযোগ! আমি অন্তত বিশ্বাস করিনা। কিন্তু ওদরে সাক্ষী আছে। তোরও শাস্তি এড়াতে হলে সাক্ষী লাগবে। এবার আমি অনেকটাই নির্ভার।

কারণ অনেকেই দেখেছে আমি বারান্দায় পড়ছিলাম। বিচার শুরু হল। মসজিদ ভরা ছাত্র-শিক্ষক। আমার পক্ষে কোন সাক্ষী পেলাম না। এক ক্লাস ওপরে পড়ুয়া বড় ভাইয়ার সাক্ষ্যও গৃহীত হলনা।

রায় হল। ঘুমের ক্ষতি করে গালিগালাজ করার জন্য প্রতিষ্ঠানের নিয়মে বেত্রাঘাত। আর আবাসিক আইন অমান্য করে সিনেমা দেখার জন্য বহিষ্কার। আমি আমার পরিণতি দেখতে পাচ্ছি। তিনটি বেত হাতে অংক স্যার এগিয়ে আসছেন।

প্রথম আঘাতটির অপেক্ষায় চোখ বন্ধ করেছি। আর দুঃস্বপ্নের মত দেখতে পাচ্ছি; ক্ষত-বিক্ষত শরীর নিয়ে ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ বাড়ি ফিরছি। শুরু হচ্ছে আরেক দফা শুনানি। বাবার কটমট চাহনি। মায়ের অস্ফুট আর্তনাদ।

কেন বহিষ্কার হলাম? এই প্রশ্নে নির্বাক আমি মাটির সাথে মিশে যাচ্ছি। বিজয়ী বন্ধুত্রয়ের হাসির চাঁপা আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। চোখের অশ্রূরা ছুটছে অবিরাম... হঠাৎ একটা কন্ঠ। থামেন! চোখ খোলে দেখি বোর্ডিং সুপার আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে। তিনি অভিযোগকারী তিন জনকে দাঁড়াতে বল্লেন।

প্রশ্ন করলেন, তোমরা তিন জনের কেউতো দরজা খোলনি? তারা বল্ল, না। আমরা দরজা খোলিনি। আমরা ওর ডাকও শুনতে পাইনি। তিনি হযরত আলীকে জিজ্ঞেস করলেন, আলী তুমি কি সাইফের বকা শুনেছিলে? সেও বল্ল, না। আমি ওর কোন বকা শুনিনি।

আমি শুধু ওর কান্না শোনে দরজা খোলেই শুয়ে যাই। বোর্ডিং সুপার তিন জনকে বল্লেন, তোমরা সাইফের ডাক শুননি; বকা শুনলে কেমনে? বকা শুনলে কিন্তু দরজা খোলনি কেন? এবার আমার বন্ধুরা কোন জবাব দেয়না। তিনি বলতে শুরু করলেন, সাইফ সিনেমা দেখতে যায়নি। কিন্তু গত রাতে যারা তার সাথে বারান্দায় পড়ছিল তারা মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যায়। এরা তিন জনও যায়।

এদেরটা কেউ জানেনা। তাই ওরা তিন জন সবাইকে হুমকি দিয়েছে। ওরা যদি সাইফের পক্ষে সাক্ষ্য দেয় তাহলে তারা ওদেরকেও ফাঁসিয়ে দেবে। ফলে কেও সত্য বলেনি। কিন্তু ওদের ষড়যন্ত্রটা আমার ছোট ছেলে শুনে ফেলে।

তাকেও হুমকি দেয়া হয়। সে বিচারের অবস্থা দেখে সহ্য করতে পারেন। তাই কেঁদে উঠে। তাকে নিয়ে বাইরে যেতেই সে সব ঘটনা খোলে বলে। সব শুনে আমি প্রায় দৌড়ে এলাম।

“ওফ যদি আর একটু পরে আসতাম! কি যে হতো... আল্লাহ সত্যিই মহান” । একটানা কথাগুলো বলে তিনি হাফিয়ে উঠলেন। মূহুর্তেই বদলে গেল সব। চোখের বাঁধ ভেঙ্গে গেল আমার ও ভাইয়ার। আমার সমগ্র সত্তা জুড়ে খেলে গেল মুক্তির নব তরঙ্গ।

মনে হল আমার চারপাশ কত সুন্দর! কত ধ্রুব! বোর্ডিং সুপার আমাকে ও বিপর্যস্ত ভাইয়াকে বল্লেন, তোমরা কী চাও? ইপস্থিত ছাত্র-শিক্ষক সবাই বল্লেন, ওরা তিন জনকেই বহিষ্কার করা হোক। কান্নার তীব্র গমকে আমি কিছু বলতে পারিনি। ভাইয়াক বলতে শুনলাম, ওদেরকে মাফ করে দিলে কেমন হয়? যদিও আমার মন চাচ্ছিল ওদেরও শাস্তি হোক... এভাবেই আমার জীবনাকাশ থেকে মিথ্যার একাকাশ কাল মেঘ হারিয়ে গেল দূর দিগন্তে। সত্য তার আপন আলোয় নিজস্ব মহিমায় উদ্ভাসিত হল। সত্য চিরকালই এমন স্বপ্নময়।

এমন মধুর। চরম দুঃস্বপ্নের ধ্বংস্তুপ থেকে সত্যের উন্মেষ আরো সুমধুর। আরো প্রাণবন্ত। আরো বহুমাত্রিক অনুপমতায় পরিপূর্ণ। ১২.০৩.০৯ রাজনগর কেন্দুয়া নেত্রকোনা।

[অ.ট.- এই লেখাটি একটি পাঠ প্রতিযোগীতার জন্য লিখিত হয়েছিল। কিন্তু পাঠ প্রতিযোগীতায় সেই তিন জনের একজন উপস্থিত ছিল এবং ১৬ বছর আগের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটির জন্য বার বার দুঃখ প্রকাশ করছিল। তাই আমি এই লেখাটি পাঠ করিনি। আন্য একটি লেখা পাঠ করেছিলাম]

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.