আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেদিনও বসন্ত ছিলো (২১)



ফোন বেজে চলেছে। বেজেই চলেছে। অসম্ভব মাথা ধরা নিয়ে বিছানায় এপাশ-অপাশ করছে কম্পাস। জিসানদের বাড়ি থেকে চলে আসার পর থেকেই মাথায় ভোতা ধরণের যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল। সেটা এখন সহ্যের সীমানার শেষ প্রান্তে গিয়ে পৌঁছেছে।

তার মনে হচ্ছে কেউ একজন হাতুড়ী দিয়ে টাস্ করে মাথায় একটা বাড়ি দিলে হয়ত ব্যথা কমে যাবে। ফোন বাজছে। হাত বাড়ালেই ফোনের রিসিভার নাগাল পাওয়া যাবে। তার হাত বাড়াতে ইচ্ছে করছে না। নিশ্চই জিসান ফোন করেছে।

ওভাবে না বলে চলে আসায় বেচারা নিশ্চই অনেক কষ্ট পেয়েছে। সে কী করবে? সে তো আর বসে বসে মুসকানের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। কিংবা জিসানকে বলতেও পারে না- “বন্ধু, তোমার স্ত্রী’র সাথে আমার দেখা না হওয়াই ভাল। আমাকে জোর করে এনে ভালবাসার পাঠশালায় ও-ই ভর্তি করিয়েছিলো। এক সময় সে আমাকে পাগলের মত ভালবাসতো, আমিও।

সময়ের নিষ্টুরতায় অথবা মুসকানের উচ্চাবিলাসী আকাংখার মঞ্চায়নে আমি পিছিয়ে পড়ি বাস্তবতার আঘাতে। আমার স্বপ্নের পবিত্র আঙিনা থেকে সে তাকে বের করে সোপর্দ করে দেয় তোমার বাহুতে। ” ক্রিং... ক্রিং...শব্দে ফোন বেজেই চলেছে। যেন রিসিভার না উঠালে এই রিং অনন্তকাল পর্যন্ত বাজতেই থাকবে। কম্পাস ইচ্ছে করলে ফোনের লাইন ডিসকানেক্ট করে ফেলতে পারে।

মোবাইল তো বন্ধই আছে। অবশ্য তাতে কোনো লাভ হবে না। ফোন যদি জিসানই করে থাকে, তাহলে লাইন খুলে ফেললে সে ষ্টেইট বাসায় চলে আসবে। ঠিকানা যোগাড় করা তার জন্য কোনো ব্যাপারই না। তার’চে বরং রিসিভ করে ফেলাই ভাল।

আস্তে আস্তে সে হাত বাড়ালো ফোনের দিকে। ‘হ্যাঁ---লো ! ওপাশ থেকে জিসানের অভিমানী কন্ঠ ভেসে আসলো- ‘কম্পাস, কাজটা তুই ভাল করিস নি। তোকে কষ্ট দেয়া বা অপমান করার মত কিছু বলেছি বলে তো মনে হয় না। তারপরও নিজের অজান্তেই যদি অন্যায় কিছু করেও থাকি, তাহলে সেজন্য তো তুই আমাকে শাস্তি দিতে পারতি। এভাবে না বলে চলে যাবি? মাত্র ক’টা দিনই তো আর আছি।

’ কম্পাস বললো, ‘মাত্র ক’টা দিন মানে? তোরা কি খুব শিগ্গিরই চলে যাচ্ছিস নাকি?’ ‘আমরা নয়, আমি। আমি একা যাচ্ছি। ’ ‘একা যাচ্ছিস মানে? আমি তো তোর কথার আগামাথা কিছুই বুঝতে পারছি না !’ ‘আরে গাঁধা, বুঝবি কী করে। বলার সুযোগ না দিয়েই তো চলে গেলি। শোন, ডাক্তার বলেছে অলৌকিক কিছু না ঘটলে বড়জোড় মাস দু’এক।

’ ‘মাস দু’এক মানে? কী বলতে চাইছিস তুই? আরে ব্যাটা, এত প্যাঁচিয়ে কথাবলা তুই কবে শিখলি? খুলে বল, ঝেড়ে কাশ। ’ ‘শোন কম্পাস। আমি অসুস্থ। খুব খারাপ এবং দুর্বোধ্য কোনো রোগে আমাকে চেপে ধরেছে। দুর্বোধ্য এই অর্থে বলছি যে, ডাক্তাররা রোগ ধরতে পারছে না।

তবে এটা বুঝতে পারছে হার্টের রক্ত সঞ্চালন ঠিকমত হচ্ছে না। হার্টবিটও কমে যাচ্ছে। খুব দ্রুত কমে যাচ্ছে। ডাক্তার আমাকে পরিষ্কার ইংরেজী ভাষায় যা বলেছে, তার বাংলা করলে দাঁড়াবে- ‘জিসান সাহেব, আমাদের সম্ভাব্য সবরকম চেষ্টাই শেষ। স্যরি।

সব’চে ভাল হয় যদি শেষ ক’টা দিন নিজের দেশের মাটিতে গিয়ে কাটান। ’ আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘ডক্টর, দেশে আমার শেষ ভিসার মেয়াদ কতদিন?’ ডাক্তার নির্লিপ্তভাবে জবাব দিয়েছে ‘খুব বেশি হলে দু’মাস। ’ বাকরুদ্ধ হয়ে রইলো কম্পাস। সারা শরীর তার ভারি হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে শরীরের শেকড় গজিয়ে গেছে।

একটুও নড়াচড়া করতে পারছে না। কত স্বাভাবিকভাবেই না জিসান কথাগুলো বলে ফেলেছে। যেন মৃত্যু কোনো ব্যাপারই না, ঢাকা থেকে চিটোগংগামী এক্সপ্রেস ট্রেনে চেপে বসার মত অতি স্বাভাবিক একটি ব্যাপার! কম্পাস জিজ্ঞেস করলো- ‘এই সংবাদটি কি মুন, আই মিন তোর স্ত্রী জানে?’ ‘আরে না, পাগল হয়েছিস? সে যে আমাকে কী পরিমাণ ভালবাসে, সেটা আমি তোকে বলে বুঝাতে পারবো না। একদিনের জন্য ওকে ছেড়ে কোথাও যেতে চাইলে ও রীতিমত কান্না জুড়ে দেয়। তাকে বললে আমার আগেই সে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যাবে।

আমি যে কোনো কষ্টই সহ্য করতে পারবো কিন্তু মুসকানের মৃত্যুর কষ্ট সহ্য করতে পারবো না। ওকে বলেছি, খারাপ ধরণের জ্বরের ভাইরাস আমার শরীরে বাসা বেধে বসে আছে। ডাক্তার বলেছে তিনমাস রেষ্টে থেকে নিয়মিত ওষুধ খেলে ভাল হয়ে যাব। ’ কিছুক্ষণ নিরব হয়ে গেল জিসান। হয়ত ভিজে উঠা চোখ দুটো মুছে নিচ্ছে।

তারপর খুব আবেগমাখা সুরে বললো- ‘জানিস কম্পাস, এই যে আমি মারা যাচ্ছি, এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। কম তো আর বাঁচা হলো না। শিশু মৃত্যুর রেকর্ড সৃষ্টিতে অভ্যস্ত একটি দেশে জন্ম নিয়ে ৩৫/৪০ বছর বেঁচে থাকাটাও কম ভাগ্যের ব্যাপার না। আমার শুধু কষ্ট হয় যখন ভাবি, আমার মৃত্যুর পর আমার লাশের পাশে বসে মুসকান কাঁদছে। আমার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে, ভাবতেই আমার বুকটা শুকিয়ে যায় রে! কম্পাস, শুনতে পাচ্ছিস আমার কথা?’ কম্পাসের দু’চোখ গড়িয়ে পানি পড়ছে।

মনের জানালায় ভেসে উঠছে জিসানের সাথে কাটানো দুরন্ত কৈশোর, চাঞ্চল্যেভরা তারুণ্য। গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না তার। সে মাথা উপর নিচে করে ‘হ্যাঁ’ সুচক মাথা নাড়লো। সঙ্গতকারণেই টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে এই মাথা নাড়ানো দেখতে পেল না জিসান। সে আবারো জিজ্ঞেস করলো- ‘কিরে! কথা বলছিস না কেন? আমার কথা কি শুনা যাচ্ছে?’ অনেক কষ্টে কম্পাস বললো, ‘হুঁ।

’ জিসান বললো, ‘শোন কম্পাস, আমি দেশে এসেছি এক মাসেরও বেশি হয়ে গেছে। সুতরাং স্বাভাবিক হিসেবেই আর মাত্র ক’'টা দিন। আমি কি আমার জীবনের শেষ ক’'টা দিন আমার একমাত্র বন্ধুর সাথে কাটানোর আশা করতে পারি না?’ কম্পাস আবারো চুপ করে রইলো। মুসকান না থাকলে সে ঠিকই গিয়ে বসে থাকতো জিসানের হাত ধরে। এখন যদি সে জিসানের কাছে যায়, নিশ্চই মুনের মুখোমুখি হতে হবে।

মুন বিব্রত হবে। আত্মগ্লানিতে ভোগবে। ব্যাপারটি জিসানের কাছেও ধরা পড়তে পারে। মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুটি মৃত্যুর আগে জেনে যাক তার প্রাণাধিক প্রিয়তমা স্ত্রী শুধু তাকেই ‘জীবনের’চে বেশি ভালবাসি’ বলেনি, তার আগে অন্য কাউকেও এরকম বলেছে। এটা ঠিক হবে না।

কিছুক্ষণ নিরবে কেটে যাবার পর বেশ দীর্ঘ একটি নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে জিসান বললো- ‘ঠিক আছে কম্পাস। তোর অনেক কাজ থেকে থাকবে। সব কামকাজ ফেলে রেখে আমার পাশে বসে থাকার দরকার নেই। আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে আমার একপাশে মুসকান এবং অন্যপাশে তোকে রেখে বিদায় নিই। শেষ বেলায় তুই থাকবি না আমার পাশে?’ ********************* ********************* বাহাত্তর ঘন্টা থেকে জিসান ডীপ কোমা’য় আছে।

আপাতত তাকে রাখা হয়েছে ইন্সেন্টিভ কেয়ার ইউনিটে, এ্যাপোলো হাসপাতালে। হাসপাতাল ঢাকায়। মূল ডাক্তার ইন্ডিয়ান। তাঁরা অনেক ভাষাতেই কথা বলতে পারেন কেবল বাংলা ছাড়া। অবশ্য বাংলা যে একেবারেই জানেন না, সেটা বলা ঠিক হবে না।

“ঢন্যবাড, কুনু চিন্টা কড়বেন না” টাইপ কিছু শব্দ তারা এরই মধ্যে শিখে ফেলেছেন! রোগী সম্বন্ধে হিন্দি এবং ইংরেজির মিশেলে তারা যে মতামত দিয়েছেন, প্রকৃতিপ্রেমী কোনো লেখককে সেটা ব্যাখ্যা সহ অনুবাদ করতে দিলে ব্যাপারটি দাঁড়াবে এমন- “দিন গড়িয়ে বিকেল এসে গেছে। শেষ বিকেল। সারাদিন প্রচন্ড উত্তাপ ছড়ানো সুর্যটা আস্তে আস্তে পশ্চিমের বুকে মুখ লোকাতে ব্যস্ত। উড়ন্ত পাখিগুলো ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা নেমে আসবে।

আস্তে আস্তে অন্ধকারের চাদর ঘিরে ফেলবে সবকিছু। চতুর্দিক এক সময় নিরব হয়ে যাবে। নিস্তব্ধ হয়ে যাবে। থেমে যাবে। এই অন্ধকার কখনো সরে যাবে না।

এই সূর্য আর কখনো আকাশে উদিত হবে না। তবে, প্রকৃতি যদি বিশেষ কোনো কারণে তার পরিকল্পনায় কিছুটা চেঞ্জ আনে, সে মোতাবেক যদি রাতটা কোনো রকমে কেটে যায়, তাহলে আশাবাদী হবার কারণ ছিল। পরদিন থেকে আবার নিয়মিত সূর্য উঠতো। গাছে-গাছে পাখি ডাকতো। সমুদ্র ফিরে পেত উত্তালতা।

তবে সে সম্ভাবনা খুবই কম। শতকরা দশমিক শূন্য শূন্য এক ভাগ। ...চলবে


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.