আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সেদিনও বসন্ত ছিলো- ৬



পূর্ব প্রকাশিতের পর কম্পাস মুসকান অধ্যায়টি ভুলেই গেছে। মোবাইল কন্যার প্রতি তার কোনো আগ্রহ তৈরি হয় নি। কিছু ছেলে আছে যাদের কাজই হলো চেষ্টা তদবীর করে মেয়েদের মোবাইল নাম্বার যোগাড় করা। তারপর শুধু কথা আর কথা। অবশ্য সমান অধিকারের এই যুগে কথা-চালাচালির এই অর্থহীন খেলায় মেয়েরাও পিছিয়ে নেই।

এই গ্র“পের ছেলে-মেয়েদের কাছে একাধিক সীম থাকে। কথাবলার লোকও থাকে অনেক। মলির সাথে কথা শেষ হলে পলির নাম্বারে ডায়াল করা অথবা জামালের সাথে কথা বলে কামালের নাম্বারে ট্রাই করা। মাঝে-মধ্যে সিরিয়াল মেন্টেন করে ডেটিং। অবশ্য মিস টাইমিং এর কারণে একাধিক বয়ফ্রেন্ড বা গার্ল ফ্রেন্ড মুখোমুখি হয়ে গেলে ডেটিং তখন ডেথিং এর দিকে মোড় নেয়।

কম্পাস এই ধরণের ছেলে না। ফোনে মেয়েদের সাথে কথা বলায় কোনো দিনই তার আগ্রহ ছিল না। তাছাড়া মোবাইল নামক বস্তুটি উপরও সে পুরোপুরি সন্তুষ্ট না। এটা মানুষের যোগাযোগের ক্ষেত্রে কিছুটা উপকার করলেও উপকারের চাইতে ক্ষতি করছে অনেক বেশি। বলা চলে এর সাইট অ্যাফেক্ট ভয়াবহ পর্যায়ের।

যেমন- ১. এই বস্তুটি সু-কৌশলে মানুষকে মিথ্যাবাদী হবার ট্রেনিং দিচ্ছে। দেখা যাচ্ছে কাকরাইল মোড়ে দাঁড়িয়ে মগবাজারের ফুফুকে বলছে, এই তো ফুফু, চলে আসছি। এই তো মালিবাগ মোড় ক্রস করলাম! ২. লোকজনকে অলস করে দিচ্ছে এই যন্ত্রটি। দ্বিতীয় তলায় বসে নিচ তলায় ফোন করে বলা হচ্ছে, ‘উপরে এককাপ চা পাঠাও তো। ’ ৩. পাওনাদার বাসার সামনে এসে মোবাইলে রিং করার পর বেডরুমে শুয়ে শুয়ে বলা হচ্ছে, ‘স্যরি ভাই, আমি তো ঢাকার বাইরে আছি।

দু’একদিনের মধ্যেই ফিরবো। প্লিজ, কিছু মনে করবেন না। আমি ফিরে এসেই আপনার সাথে যোগাযোগ করবো। ’ দ¯ু—র মত ধোকাবাজী। ৪. অপরাধীদের জন্য মোবাইল যন্ত্রটি হয়েছে পোয়াবারো।

দেখা যাচ্ছে, পুলিশ অপরাধীকে ধরার জন্য তার কাছে গিয়ে পৌছার আগেই মোবাইলের কল্যাণে অপরাধীদের কাছে সংবাদ পৌছে যাচ্ছে। কম্পাস বিশ্বাস করতে চায় পুলিশের ভেতরের কেউ অপরাধীকে সংবাদ পৌছে দিয়ে সতর্ক করে দেয় না। কিন্তু পুলিশের ভেতরের পরিকল্পনা ও অপারেশন শিডিউল তো বাইরের কারো জানারও কথা না। তাহলে সংবাদটি পাঠায় কে ?? ৫. এছাড়া চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই এর ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনের ভূমিকা ভয়াবহ গুরুত্বপূর্ণ। কেউ ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে বাসায় যাচ্ছে।

দেখাগেল আঙুল কাটা কালু নাক কাটা লালুকে মোবাইলে বলে দিচ্ছে, ‘শোন, কালো কালারের ব্রিফকেসে করে দশ লাখ টাকা নিয়ে এই মাত্র এক লোক ইস্টার্ণ ব্যাংক কাকরাইল ব্রাঞ্চ থেকে বেরিয়েছে। লোকটির পরনে মেরুন কালারের সাফারী। আমরা বিজয় নগর মোড় থেকে তাকে ফলো করছি। সে যাচ্ছে পল্টনের দিকে। তুই গাড়ী নিয়ে ফকিরাপুল মোড়ে থাক...’ ৬. মোবাইলের আরো অনেক ভয়াবহ দিকও আছে।

তবে যে ব্যাপারটি কম্পাসকে বেশি ভাবায় এবং যে ভাবনায় সে কোনো কুল-কিনারা খোঁজে পায় না, সেটা হল, অই মা-বাবা বা অভিভাবকরা কেমন অভিভাবক, যারা তাদের স্কুল পড়–য়া ছেলে-মেয়ের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দেন! আর দেশের মোবাইল কোম্পানীগুলো অই ভয়াবহ দায়িত্বশীল অভিভাবকগণের সাথে পাল্লা দিয়ে রাত ১২টার পর কলরেট কমিয়ে দেয়। আবার কিছু কিছু কোম্পানী বিজ্ঞাপন দেয় ‘কথা চলুক সারারাত’। কম্পাস ভেবে পায় না এমন ফাজলামো টাইপ প্রচারণার (অথবা প্রতারণার) মানে কী? আরে বাবা, সারারাত যদি কথাই চলবে, তাহলে ঘুমানো হবে কখন? না ঘুমালে দিনের বেলায় কাজকর্ম করবে-টা কে? রাত ১২টার পর এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকে না যে, খুববেশি ফোনে কথা বলতে হয়, কেবল তিন দল ছাড়া। (১) আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা। তো তাদের জন্য সরকারি ওয়ারলেস রয়েছে।

(২) সন্ত্রাসী গ্র“প। এদের জন্য কলরেট কমানো কি যুক্তিসঙ্গত? (৩) রোমিও জুলিয়েট বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী। কম্পাস মূলত এদের নিয়েই শংকিত। কম্পাস জানে, অনেক কিশোর-কিশোরীরা সন্ধ্যার পর যখন পড়ার টেবিলে বসে, তখন মনে মনে কথা গুছাতে থাকে। আর অপেক্ষা করতে থাকে রাত ১২ টা বাজা’র।

রাত ১১টার পর তাদের হাত মুখ কান উস-খুস করতে থাকে। ঠিক ১২ টা বাজার সাথে সাথে কয়েক লক্ষ শক্ত এবং কোমল আঙুল ব্যস্ত হয়ে পড়ে বাটন টেপা-টেপিতে। শুরু হয় সারারাত কথা বলার প্রতিযোগিতা। কথা চলছে তো চলছেই। কোনো বিরাম নেই, কোনো বিরক্তি নেই।

কোনো তাড়াহুড়া বা ধৈর্য্যচ্যুতি নেই। বাংলাদেশ ক্রিকেটের টেষ্ট স্কোয়াডকে অই রাত ১২ টার পর ওয়ালাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যাপারটি ম্যানেজমেন্ট বিবেচনা করে দেখতে পারে। কথার ধরণ-ও মাশাআল্লাহ। সুটকী তরকারীতে ঝাল বেশি হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে স্কুলের অংক আপার থুতনিতে কালো তিলের উপর গজানো একগাছি দাড়ি পর্যন্ত, কিছুই বাদ যায় না। আবার এই কথাবলার প্রতিযোগিতাও চলে খুব সাবধানে।

ওয়ানডে ক্রিকেটের পাওয়ার প্লে’র মত ১৫ গজ বৃত্তের মধ্যেই থাকে তাদের আওয়াজ। কথা চালাচালিতে মাঝে মধ্যে কপট রাগ অভিমানের ফুলটস কিংবা ইয়র্কার আসে। আসে নিখুঁত লেনথের বডিলাইন বাউন্সার। কিশোর কিশোরীরা সাবধানে গা বাঁচিয়ে নেয়। আর বল একটু লোজ হলে সোজা হুক কিংবা পুল করে পাঠিয়ে দেয় সীমানার বাইরে।

সোজা চার। ভাগ্য ভাল হলে ছয়। এভাবে সারারাত কথা বলে সোনামণি যখন ঘুমুতে যান, তখন পুর্বাকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। সকাল ৭ টার দিকে ঐ সন্তানের অতি সচেতন মা দরজা ধাক্কা-ধাক্কি করেন আর ডাকতে থাকেন প্রিয় কন্যাকে, (পুত্রও পড়া যাবে। সমস্যা নেই) ‘ওঠ মা, আর কত ঘুমোবি? সাতটা বেজে গেছে! তাড়াতাড়ি উঠে হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা খেতে আয়।

তা না হলে আবার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে যে!’ কিন্তু সোনামণির তো ঘুম ভাঙে না। অবশ্য ভাঙার কথাও না। অই মা তো আর জানেন না, সারারাত কত পরিশ্রম করে বেচারী ঘুমুতে গেছে ভোরবেলা। মায়ের প্রচন্ড চেঁচামেচি ও ডাকাডাকির এক পর্যায়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও উঠতে হয় মেয়েটিকে। আলু-তালু বেশে আধা ঘুম আধা জাগা অবস্থায় কোনো রকম নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে চলে যাচ্ছে স্কুলে।

গিয়ে বসছে পেছনের বেঞ্চে। কারণ ঘুমানোর জন্য পেছনের বেঞ্চ নিরাপদ। সামনের বেঞ্চগুলোতে টিচারের নজর থাকে বেশি। স্যার যখন তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে বানরের উপরে উঠার অংক করাচ্ছেন, তখন সে গভীর ঘুমে অচেতন। আর ঘুমই তার জন্য বেশি জরুরী।

আফটার অল শরীর স্বাস্থ্যও তো ঠিক রাখতে হবে। তাছাড়া গত রাতের অবশিষ্ট ঘুমকে পুষিয়ে নিতে না পারলে আসছে রাত কথা বলায়ও তো সমস্যা হবে। সেটা কোনো অবস্থাতেই হতে দেয়া যায় না.......। আজকাল মোবাইল কোম্পানীগুলো গ্রাহকসেবার জন্য ভয়াবহ রকমের অস্থির। তাদের এই আগ্রহের সিংহভাগ জুড়েই রয়েছে টিনএজ ছেলে মেয়ে এবং তরুণ-তরুণীরা।

আজকালকার ছেলে-মেয়েদের মোবাইলে রিং করলে বিভিন্ন রকমের সুর ভেসে আসে। এই প্রক্রিয়ার সাথে অপরিচিত কেউ হলে সে ভাববে-হয়ত ভুল করে সে কোনো ঋগ ব্যান্ডের রেডিও ষ্টেশনে কানেকশন করে ফেলেছে। কেউ কেউ আবার নিজেকে শালিত ও মার্জ্জিত রূপে প্রকাশ করতে ওয়েলকাম টোনে কোরআন তেলাওয়াত সেট করে রেখে দিয়েছে। মক্কার ইমাম সাহেবের তেলাওয়াত। হঠাৎ করে এক সময় তেলাওয়াত স্টপ হয়ে কানে ভেসে আসে-‘কীরে দোস্ত, নাইট শো’ দেখতে যাবি নাকি?’ ‘আহারে! কোরআনের কী কদর তাদের কাছে!’ কম্পাসের ধারণা বর্তমানে দেশে যে সব অপরাধ সংঘটিত হয়, সেগুলোর অধিকাংশের মূলেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে মোবাইল ফোন।

প্রেম এবং পরকিয়া সংক্রান্ত সবগুলো দুর্ঘটনার মূলেও রয়েছে এই মোবাইল। ‘কী রে! চোখ বন্ধ করে কী ভাবছিস?’ কম্পাস চোখ মেলে তাকালো। জিসান দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সে বললো, ‘কী ব্যাপার জিসান! মনে হচ্ছে একটু আগেই চলে এসেছিস?’ জিসান বললো, ‘ভাবলাম একটু আগে ভাগে এসে তোর কাছ থেকে কিছু জ্ঞান নিয়ে নিই। তা আজ কোন্ ব্যাপারে জ্ঞান দিবি, কিছু ঠিক করেছিস?’ একটু হাসলো কম্পাস।

জিসান বললো, ‘কী নিয়ে ভাবছিলি?’ কম্পাস বললো, ‘মোবাইল ফোন। ’ ‘মোবাইল ফোন আবার তোর কী ক্ষতি করলো?’ ‘ক্ষতি শুধু আমার না, গোটা দেশটারই বারোটা বাজাচ্ছে এই মোবাইল। মোবাইল ফোন অনেকটা মহামারি আকার ধারণ করেছে। আচ্ছা জিসান, এইডস এবং মোবাইল এ দু’টির মধ্যে কোন্টি বেশি ডেঞ্জারাস, বলতো?’ বিব্রত ভঙ্গিতে তাকাচ্ছে জিসান। সে ভেবে পাচ্ছে না এইডস’র সাথে মোবাইলের সম্পর্কটা কী? কম্পাস বললো, ‘ও আচ্ছা, তুই ভাবছিস এইডস’র সাথে মোবাইলের যোগসূত্র কোথায়? তাই না? আচ্ছা শোন।

এইড্স যেমন ছুঁয়াছে রোগ, একজন থেকে অন্য জনের শরীরে চলে যায়, ঠিক তেমনি মোবাইলও একধরণের ভাইরাস বহন করে। যে কোনো খারাপ জিনিস মুহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। এক মোবাইল থেকে অন্য মোবাইলে সংক্রমিত হয় মন্দ বিষয়গুলো। এসএমএস, এমএমএস-এর মাধ্যমে নোংরা স্থির ও চলমান চিত্র আদান-প্রদান হতে থাকে দেদারছে। আমার তো মনে হয় মোবাইল ভাইরাস এইড্স’র চে’ও মারাত্মক।

’ জিসান বললো, ‘আচ্ছা কম্পাস, এইড্স এত তাড়াতাড়ি কীভাবে ছড়ায়? আমাদের দেশের সংস্কৃতি তো এখনো পশ্চিমাদের মত খোলা- মেলা হয় নি। তবুও দিন দিন এদেশে এইডস রোগী বাড়ছে কীভাবে?’ কম্পাস বললো, ‘জিসান, দিন-দুনিয়ার খবর তো রাখিস না, বুঝবি কিভাবে? আমরা আমাদের দেশি সংস্কৃতিকে তালাবদ্ধ করে রেখে আমাদের সমাজে আমন্ত্রণ জানিয়েছি ওয়েষ্টার্ণ কালচারকে। আকাশকে মুক্ত করে দিয়েছি। ঘরে বসে পশ্চিমা সংস্কৃতির নোংরা দিকগুলো প্রাক্টিস করছে এদেশের উগ্র কিছু ফ্যামিলি। একটি মজার জোকস্ শুনবি নাকি? তাহলে কিছু আন্দাজও করে ফেলতে পারবি।

’ জিসান আগ্রহ নিয়ে তাকালো কম্পাসের দিকে। কম্পাস বললো... ...চলবে

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.